সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

প্লেটে ভাত রেখে দৌড়ে যাওয়ার ৩০ মিনিট পরই আসে ইমনের মৃত্যুর খবর

জেলা প্রতিনিধি, নরসিংদী
প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৯ পিএম

শেয়ার করুন:

প্লেটে ভাত রেখে দৌড়ে যাওয়ার ৩০ মিনিট পরই আসে ইমনের মৃত্যুর খবর

কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে নরসিংদীতে নিহত হয়েছে দু’জন। তাদের একজনের নাম মো. ইমন মিয়া (২২)। ঘটনার দিন (১৮ জুলাই) বেলা পৌনে তিনটায় ভাত খেতে বসেছিলেন ইমন। বাবা বসে ছিলেন তার পাশেই। দুই নলা ভাত মুখে দেওয়ার পরই মোবাইলফোনে একটা কল আসে, এক গ্লাস পানি খেয়ে খাবার ফেলেই উঠে যান ইমন। ‘কই যাছ রে বাবা’—মায়ের এমন প্রশ্নে ইমনের জবাব ছিল, ‘খেলাত যাই।’ এভাবে খাবার ফেলে না উঠতে বাবা ধমক দেন তাকে। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ৩০ মিনিট পরই তার গুলিবিদ্ধ লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতালে পড়ে থাকার খবর পায় পরিবার।

ইমন পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের দড়িচর এলাকার বর্গাচাষি কাইয়ুম মিয়া ও মর্জিনা বেগম দম্পতির ছেলে তিনি। নরসিংদী আইডিয়াল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন ইমন।


বিজ্ঞাপন


গতকাল মঙ্গলবার ইমনের পরিবারের সদস্যরা বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে মর্জিনা বেগম শয্যাশায়ী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ইমন সবার ছোট। ৫ শতাংশ বসতবাড়ির ভিটা ছাড়া পরিবারটির আর কিছু নেই। অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে না পারা তার বড় ভাই ইয়ামিন মিয়া (২৫) দুই বছর আগে ধারদেনা করে সৌদি আরবে গেছেন। কয়েক মাস ধরে তিনি কিছু টাকা পাঠাতে শুরু করেছেন। বোন ইয়াসমিন আক্তারকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মাধবদীতে। বাড়িটিতে থাকতেন মা, বাবা আর ইমন। কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ইমনকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিলেন তারা।

ইমনের মা মর্জিনা বেগম কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘ওই দিন দুপুরে ইমন আমারে কইল, ‘খিদা লাগছে, ভাত দেও।’ তারে ভাত-তরকারি দিয়া ডাইল আনতে গেছিলাম। তার বাবা একটু আগে ভাত খাইয়া খাটের উপ্রে বইসা আছিল। কে জানি ফোনে হেরে কী কইছে, খাওন থুইয়াই হে উইঠা যায়। কই যাছ রে বাবা জিগাইলে উত্তর দেয় খেলাত যাই। পাতের খাওন থুইয়া উইঠা যাওয়ায় বাপে তারে একটা ধমকও দিছিল। কথা শুনে নাই, দৌড়াইয়া চইলা যায়। হুদা দুই নলা ভাত মুখে দিছিল হে।’

একটি ভাঙাচোরা ছোট টিনের ঘর দেখিয়ে মর্জিনা বেগম বলছিলেন, ‘ঘরটার মইধ্যে সারাডা দিন বইয়া বইয়া পড়ত। কলেজে যাওয়া, পড়ালেহা ছাড়া আর কিছুই করত না। বন্ধুগর লগে তারে আড্ডা দিতেও দেখা যাইত না। ওই দিন মরণ তারে হেন ডাইক্কা লইয়া গেছিল।’

১৮ জুলাই নরসিংদী শহরের ভেলানগর এলাকার জেলখানার মোড়ে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ইমন মিয়া। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বেলা তিনটা থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে স্লোগান দিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সেদিন পুলিশ সদস্যরা কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ছুড়ছিলেন আর আন্দোলনকারীরা ছুড়ছিলেন ইটপাটকেল। সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত আড়াই শতাধিক আন্দোলনকারী দুই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ইমন মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।


বিজ্ঞাপন


নরসিংদী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মাহমুদুল কবির বাসার জানান, মৃত অবস্থায় অজ্ঞাত ওই তরুণকে (ইমন) নরসিংদী সদর হাসপাতালে আনা হয়। ছররা গুলিতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠাতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থী ও তার স্বজনেরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে চলে যান।

ইমনের বড় বোন ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘বড় ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার দুই বছর পূর্ণ হওয়ার দিনই ইমন পুলিশের গুলিতে মারা গেল। বিকেলে তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসার পর স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজার পর রাতে দাফন করা হয়। ইমনের মৃত্যুর দিন থেকেই মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছেন, বাবাও ভেঙে পড়েছেন।’

সেদিন ভাতের থালা থেকে উঠে যাওয়ার ৩০ মিনিট পরই ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার কথা জানিয়ে কাইয়ুম মিয়া বলেন, ‘আন্দোলনে যাওয়ার কথা বললে ছেলেরে কোনোভাবেই যেতে দিতাম না। ঘর থেকে বের হওয়ার প্রায় ৩০ মিনিট পর আমার মোবাইলে একটি কল আসে। বলে, ‘ইমন গুলি খাইছে, হাসপাতালে আসেন।’ দ্রুত জেলা হাসপাতালে যাই। সেখানে দেখি শত শত গুলিবিদ্ধ কিশোর-তরুণ। কিন্তু ছেলেরে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওই নম্বরে আবার কল দিই, নরসিংদী সদর হাসপাতালে যেতে বলে। গিয়ে দেখি স্ট্রেচারের ওপর বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ছেলের লাশ। তখনই ছেলের লাশ নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। তার মোবাইলটাও পাইনি। পাইলে জানতে পারতাম, ছেলেকে কল দিয়ে কে ডাইকা নিছিল।’

কাইয়ুম মিয়া ভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘থানায় গিয়ে মামলা করার জন্য চেয়ারম্যান-মেম্বার অনেকেই বলেছিল। আমরা কোনো ঝামেলায় যেতে চাই নাই। বলছি, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা কইরা কি বিচার পামু? এমনিতেই ছেলের বুকটা ঝাঁঝরা কইরা দিছে, তার লাশে আর কোনো কাটাছেঁড়া করার দরকার নাই, তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহর জিনিস আল্লায় নিয়ে গেছে, বিচারও আল্লাহই করব।’

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর