২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ বাকি ছিল অর্ধেক। পরে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয় প্রকল্পের মেয়াদ। সঙ্গে বাড়ে ব্যয়ও। এমন অবস্থায় মে মাসে এসেও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৬৭ ভাগ। বাকি কাজও যে সহসা শেষ হবে তার কোনো আলামত নেই।
শনিবার (২১ মে) সকালে ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রাম মহানগরের প্রবর্তক মোড়, শুলকবহর, কাতালগঞ্জ, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, চকবাজার, কাপাসগোলা, পশ্চিম বাকলিয়া, জামালখান, বাগমনিরাম ও শুলকবহর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা। এর আগে ৫ মে সকালে ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ডুবে যায় নগরীর এসব এলাকার অলিগলি ও সড়ক।
বিজ্ঞাপন
ফলে নগরবাসীর মনে প্রশ্ন-বর্ষা এলে কী হবে চট্টগ্রাম মহানগরের পরিস্থিতি। এবারও কি ডুববে চট্টগ্রাম। আর কতদূরই বা জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ। কবে মিলবে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর মিলে চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর কথায়।
মালয়েশিয়া সফরে যাওয়ার আগে চসিকের এক অনুষ্ঠানে মেয়র বলেছিলেন, এবারও গলাসমান পানিতে ডুববে চট্টগ্রাম মহানগর। বর্ষার আগে খাল ও নালা থেকে মাটির বাঁধ না সরালে জলাবদ্ধতায় নগরবাসীকে পোহাতে হবে দুর্ভোগ।
এ কথার প্রতিক্রিয়ায় চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, জলাবদ্ধতার ভোগান্তি এ বছর কিছুটা কমবে। খালের স্লুইস গেটের কাজ শেষ হলে আগ্রাবাদে মা ও শিশু হাসপাতালে পানি উঠবে না। তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না হলে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের পুরোপুরি সফলতা পাওয়া যাবে না। খালে মানুষজন ময়লা-আর্বজনা ফেলে। পাহাড় কাটার মাটি এসে খাল ভরাট হয়ে যায়। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে হাসান বিন শামস বলেন, করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের অর্থছাড় ঠিকভাবে হয়নি। তাই কাজ সময়মতো শেষ হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ালেও অর্থসংকটসহ নানা কারণে কাজ শেষ করতে পারিনি। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৬৭ ভাগ। বাকি কাজ শেষ হতে আরও দুই বছর সময় লাগতে পারে। বাড়তে পারে প্রকল্পের ব্যয়ও।
বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম শহরে মোট ৫৭টি খাল ও ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালা আছে। প্রকল্পের অধীনে রয়েছে ৩০২ কিলোমিটার নালা। বাকি ১২৯৮ কিলোমিটার নালা চসিকের কাছে। প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খালের কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে ১০টি খালের সংস্কার কাজ শেষে হয়েছে। আটটি জুনে শেষ হবে। আরও ১৮টি খালের কাজ শেষ না হলে জলাবদ্ধতা দূর হবে না।
নগরবাসীর ভাষ্য, প্রকল্প এলাকায় খাল ও নালায় এখনও মাটির স্তুপ-বাঁধ আছে। এ কারণে সরু খালে পানি চলাচল করছে। কিছু কিছু জায়গায় পুরো খালই ভরাট হয়ে গেছে। নগরীর চাক্তাই রাজাখালী খালের মুখে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হলেও খালের মাঝে ও দুই পাশের মাটি এখনও সরানো হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতে সেখানে পানি জমে যাচ্ছে।
বহদ্দারহাট এলাকার মির্জাখালের বিভিন্ন পয়েন্টেও মাটির বাঁধ রয়ে গেছে। হালিশহরের আর্টিলারি ব্রিজের পাশে বয়ে যাওয়া খালের দুই পাশে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করা হলেও খালের মাঝে মাটির স্তুপ পড়ে আছে। এমনটি হলে আসন্ন বর্ষায় খালগুলোর পাশের এলাকাগুলো জলজটে পড়বে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
নগরীর ষোলশহর কে-ব্লকের বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, সারা বছর দেখি খালের কাজ করে। কিন্তু বর্ষা এলেই ভয়ে থাকি কোমর সমান পানি ডিঙিয়ে চলাচল করতে হয় কি না। শনিবার সকাল ও ঈদের পর এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় তা সহজেই অনুমেয় যে এ বছরও জলাবদ্ধতার করুণ দশা থেকে আমাদের মুক্তি মিলছে না।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ইতোমধ্যে ১০টি খালের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে। আরও আটটি খালের কাজও জুনের মধ্যে শেষ হবে। শুষ্ক মৌসুমে যেহেতু খালের কাজগুলো চলছিল, সেহেতু খালের মধ্যে মাটি ছিল, বাঁধ ছিল। এগুলো আমরা সব অপসারণ করে দিচ্ছি, যাতে পানিপ্রবাহে কোনো বাধা না থাকে। এ মাসের মধ্যে সব খালের বাঁধ অপসারণ হবে।
এছাড়া প্রকল্পের অধীনে টাইডাল রেগুলেটর আমাদের পাঁচটি কলাবাগিচা, মরিয়মবিবি, টেকপাড়া, ফিরিঙ্গিবাজার ও মহেশখাল। এর মধ্যে কলাবাগিচা ও মরিয়ম বিবি খালে রেগুলেটরের গেট স্থাপন হয়ে গেছে। টেকপাড়া ও ফিরিঙ্গিবাজারে চলতি সপ্তাহে গেট লাগানোর কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। ফলে এই চারটি গেট এ মাসেই ফাংশনাল হবে আশা করি। মহেশখালে কিছু গেটের যন্ত্রপাতি নেদারল্যান্ডস থেকে এখনও আসেনি। সেটিও জুলাইতে শেষ হবে।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, নালার পানি ৩৬টি খাল দিয়েই যায়। খাল যদি পানি টানতে না পারে, তাহলে জলাবদ্ধতা হবেই। প্রকল্পের বাইরে চসিকের অধীনে ২১টি খালের কথা বলা হলেও এসব খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তবে কাগজে-কলমে যেহেতু এসব খাল আছে, তাই এগুলো পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ৩৬টি খালের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১০টির কাজ শেষ হয়েছে। এগুলো জনগণের সঙ্গে উপহাস ছাড়া কিছুই না। খালগুলোতে এখনও প্রতিবন্ধকতা আছে। টাইডাল রেগুলেটরগুলোও রেডি না। এই অবস্থায় অতিবর্ষণ ও জোয়ার একসঙ্গে হলে অতীতের মতোই জলাবদ্ধতার শিকার হবে চট্টগ্রামের মানুষ।
আইকে/এমআর