সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ভূমি অফিসে সরকারি নিয়ম বহির্ভূতভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট একটি চক্র। অর্থের বিনিময়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজসে ভূমি অফিসে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে দালালদের দৌরাত্ম। জমির মালিকানায় পরিবর্তন, কর আদায়, পর্চা উত্তোলন, ওয়ারিশিয়ান সনদ, পরামর্শসহ কাগজপত্রাদী সহজীকরণের জন্য দালালদের সহযোগিতায় একমাত্র ভরসা হিসেবে বেছে নিতে হয় ভূমি অফিসে আগত সেবাগ্রহীতাদের।
ভূমি অফিস ঘিরে টাকার বিনিময়ে নামজারি (জমাখারিজ) করার অভিযোগ উঠেছে কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এ চক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো শামীম রেজা, সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ারসহ ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের। তাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দালাল চক্রের একটি সিন্ডিকেট। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিভিন্ন অনিয়ম, অনৈতিক ও ঘুষ বাণিজ্য বন্ধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত চিঠি প্রেরণ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগে জানা যায়, নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত ১ হাজার একশত টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ভূমি অফিসে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি কানুনগো শামীম রেজার ইঙ্গিত ছাড়া মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। টাকার বিনিময়ে সব অসম্ভবকেই সম্ভব করছে কানুনগো শামীম রেজা। তার নেতৃত্বে কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালালদের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই চক্রের সঙ্গে সমন্বয় হলে মিলছে একদিনেই খারিজ।
খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের আসিফ বাবু জমাভাগ (নামজারির) আবেদন করেন, যার কেস নম্বর- ১৪,১৬৫/২২-২৩। সংশ্লিষ্ট খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আব্দুল হালিমের নিকট কাগজপত্র জমা দিলে ভায়া দলিল অনুযায়ী জমিতে পর্যালোচনা করে দেখতে পায় জমিতে অংশ কাতে উল্লেখ করা আছে। পরে আবেদনটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেসটি বাতিল করে। পরে অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দালালের সঙ্গে কথা বলে মোটা অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ার ও কানুনগোর সঙ্গে চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২৫৯৬/২৩-২৪ কেস মূলে প্রস্তাব পাশের মাত্র একদিনেই খারিজ হয়ে যায়।
অপরদিকে, সাটিকাবাড়ী গ্রামের আনিছার রহমান ২৭/১২/২০০১ সালের ক্রয় করা ৮৬৭০ নম্বর দলিল মূলে সাড়ে এগার শতক জমি নামজারির (জমাভাগ) আবেদন করেন। যার কেস নম্বর-৯৬৮৩/২২-২৩। ওই দলিলে জমির অংশ কাতে উল্লেখ থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বাতিল করে দেয়। পরে সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ার ও কানুনগোর পরামর্শে দলিল জাল করে পুণরায় আবেদনের ৯৬৮৩/২২-২৩ কেস মূলে সাড়ে ১১ শতক জমি মোটা অঙ্কের বিনিময়ে প্রস্তাব পাশের মাত্র একদিনেই নামজারি (জমাভাগ) পাশ হয়।
![]()
বিজ্ঞাপন
শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিলন্দা গ্রামের শাহাদতের পুত্র রুবেল শিলন্দা মৌজার দেড় শতক জমি ৭৪৩৭ ও ২৩৫২ নম্বর দলিলমূলে ক্রয় করেন। গত বছরের ১৩ আগস্টে আবেদনের প্রেক্ষিতে ১১০৫ খতিয়ান ভুক্ত হয়ে নামজারি (খারিজ) পেয়ে যান। দখলে যাওয়ার বিষয়ে আর এস রেকর্ডসূত্রে মালিক ফিরোজগংরা জানতে পেরে শিয়ালকোল ভূমি অফিসে আসেন। জমিতে মালিকানা স্বত্বে ভোগদখলে একজন অথচ জমিতে খারিজমূলর অন্যজন এসে বিশৃঙ্খলা করছে। জমির শ্রেণি ও ভোগদখল না দেখে খারিজের প্রস্তাবের বিষয়ে সহকারী কর্মকর্তা হাছান আলী বলেন, আমার পক্ষে ঘুরে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। নামজারি করাতে দলিলমূলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এবিষয়ে দলিলমূলে মালিক রুবেল বলেন, খারিজ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দলিলে দাগ ও সাইট না মেলায় আজও ওই জমিতে যেতে পারিনি। এখন আমার ওই অবস্থাতেই জমির প্রকৃত মালিকদের কাছে জমি দিতে হচ্ছে।
নাম না বলা শর্তে দালালচক্রের আরেক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এক সেবাগ্রহীতা জানান, জমাভাগের জন্য নায়েব হাছান আলীর সঙ্গে যোগসাজসে একটি জমির নামজারি বাবদ সাড়ে তিন লাখ টাকার কথা হয়েছে। টাকা বেশি হওয়ায় আমি এখন পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান করতে পারছি না। ভূমি অফিসে পদোন্নতি হয়ে কানুনগো হওয়ার কথা শুনেছি। যদি ওই পদে হয়ে যান তাহলে নিমেষেই অন্যান্য জায়গারও সমস্যার সমাধান করা যাবে। সিরাজগঞ্জ জেলার নায়েবদের সভাপতি হওয়ায় তার পক্ষে সবই সম্ভব বলে তিনি জানান।
সেবা গ্রহীতারা বাইরে থেকে আবেদন করা হলে নিয়ম অনুযায়ী ২৮ দিনেই নামজারি হবে বলে জানিয়ে দেন সার্টিফিকেট পেশকার অথচ তার নিকট ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা দিয়ে আবেদন করলে আবেদনের পিছনে সংখ্যা বসিয়ে চিহ্নিত করে নেয়। পরে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস থেকে প্রস্তাব পাশের পর মাত্র ৩-৪ দিনেই নামজারি পাশ করে দেওয়ার সহযোগিতা করে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া প্রতিটি ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন ক্যাটাগরী চিহ্নিত করে ফাইল পাঠিয়ে দেন। এ সকল ফাইল সার্টিফিকেট পেশকার, সার্ভেয়ার, কানুনগো বিশেষ নজরদারিতে রাখেন বলে একাধিকসূত্রে জানা গেছে।
এত কিছুর পরও প্রশাসনকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে তারা স্বপদে থেকে প্রতিদিন অনিয়ম দুর্নীতি করে যাচ্ছেন যা প্রকৃত ভূমি মালিকদের সম্পদ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটছে। তবে এ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সদর এসিল্যান্ড এর সঙ্গে বেশ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে এ সকল কাজ করে থাকেন বলে জানা গেছে।
অফিসকে জিম্মি করে কিছু দালাল চক্রের মধ্যে খোকশাবাড়ী গ্রামের কোরবান আলী, পৌর এলাকার ধানবান্দি মহল্লার আব্দুল খালেক, হরিনারায়নপুর গ্রামের রায়হান, রায়পুরের ছাইফুল, মাসুমপুরের আব্দুল মতিন, কাজিপুর উপজেলার রউফ, সরাইচন্ডি গ্রামের শাহ আলম ও শিয়ালকোল রঘুনাথপুর গ্রামের আব্দুল মমিনসহ আরো ১০/১২ জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সরকারি অফিসের নথি ঘেটে যাবতীয় সমস্যা সমাধানের কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর তাদের সবকিছু দিয়েই সাপোর্ট করে মোটা অংকের টাকা নিচ্ছেন কানুনগো শামীম রেজা।
এবিষয়ে সার্টিফিকেট পেশকার জাহিদ হাসান বলেন, নামজারি পাশ করার ক্ষেত্রে আমাকে সার্ভেয়ার অনুমতি দিলে পাশ করি। না দিলে আমি আমার মতো করে সঠিকভাবে দেখি।
এ বিষয়ে সাবেক সার্ভেয়ার বর্তমান তাড়াশ উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত আব্দুল মোমিন মন্ডল জাল দলিল যাচাই করে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে মুঠোফোনে বলেন, এটা আমার দায়িত্ব ছিল না। এসিল্যান্ড স্যারের নির্দেশনায় কানুনগো স্বাক্ষর করার পর এটা যাচাই করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মাত্র একদিনেই পাশ হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো মো. শামীম রেজা জানান, মাত্র একদিনেই নামজারি (জমাভাগ) পাশ হওয়ার বিষয়ে এড়িয়ে গিয়ে রিপোর্ট না করার জন্য সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন।
এসব বিষয়ে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) গনপতি রায়কে অবহিত করলে তিনি প্রতিবেদককে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর কেস নম্বর দিতে বলেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
প্রতিনিধি/টিবি

