রেশম পোকা পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছে গাইবান্ধার ৪৫০ নারী উদ্যোক্তা। এতে স্বচ্ছলতা ফিরেছে তাদের সংসারে। এই নারী উদ্যোক্তাদের সফলতায় এখন অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে রেশম পোকা পালনে। এছাড়া এই পোকা পলানে নারীদের সবধরণের উপকরণ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে বলে জানায় সুন্দরগঞ্জ রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র।
সুন্দরগঞ্জ রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর ও পলাশবাড়ী উপজেলায় রেশম পোকার চাষ শুরু হয়। এসব এলাকায় প্রায় ৪৫০ জন নারী রেশম পোকা পালনে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। এরমধ্যে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ২০০ জন, সাদুল্লাপুরে ১৫০ জন ও পলাশবাড়ীতে ১০০ জন। রেশম পেকার খাদ্য হিসেবে তিনটি উপজেলায় প্রায় এক লাখ তুঁত গাছ লাগানো হয়। তুঁত গাছের ডাল রোপণের একবছর পর তুঁত পাতা সংগ্রহ করা যায়। রেশম পোকা তুঁত পাতা ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, কুমিল্লা ও ঝিনাইদহ থেকে রেশম পোকার ডিম গাইবান্ধায় নিয়ে আসছে। পরে এসব ডিম বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পোকা পালনে তাদেরকে বিনামূল্যে ১৪ হাত দৈর্ঘ্য ও ৯ হাত প্রস্থের একটি টিনসেড ঘরও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই ঘরে তারা রেশম পোকা পালন করেন। পোকা থেকে উৎপাদিত গুটি লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, ঝিনাইদহসহ মোট ১২টি ক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে রেশম গুটি থেকে সুতা তৈরি করা হয়। পরে সেই সুতা পাঠানো হয় রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁওয়ের কারখানায়। ওইসব কারখানায় টুপিস, থ্রিপিস, ওড়না, শাড়ী ও চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি হয়। যা পরে সারাদেশে বিক্রি হয়।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের আরাজি দহবন্দ গ্রামের রোজিনা বেগম (৩৮) বলেন, স্বামী ফরিদ মিয়া রিকশাচালক। পাঁচশতক বসতভিটা ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলে অষ্টম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। স্বামীর আয়ে ঠিকমত সংসার চলে না। উপরন্ত পড়াশুনার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয়। সংসারে বাড়তি আয়ের জন্য রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের সহায়তায় রেশম পোকা পালন শুরু করি। চার বছর ধরে কোনো খরচ ছাড়াই পোকা পালন করছি। রেশমের গুটি তৈরি করছি পোকা থেকে। এই গুটি বিক্রি করে প্রতি বছর ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। অভাব আর সংসারে হানা দিতে পারে না। রোজিনা বেগমের মতো গাইবান্ধার প্রায় ৪৫০ জন নারী রেশম পোকা পালনে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। তারা সংসারের চাহিদা মেটানোর পরও বাড়তি উপার্জন করছেন।
মোজেমা বেগম (৪২) বলেন, স্বামী মোয়াজ্জেম হোসেন পান-সুপারির দোকার করেন। ছেলে হাফিজার (২৪) রিকশা-ভ্যান চালান। হাফিজার বিয়ে করে আলাদা থাকেন। বসতভিটা চার শতাংশ জমি ছাড়া আর কোনো জমি নেই। রেশম পোকা পালন করে ছয় শতক জমি কিনেছি। সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। প্রতিবছর ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা আয় করছেন।
একই ইউনিয়নের ফতেহখাঁ গ্রামের আরেক গৃহবধূ মিলি বেগম বলেন, স্বামী সৈয়দ ফেরদৌস হাসান মানসিক রোগী। ঠিকমত সবকাজ করতে পারেন না। তাই মা-মেয়ে মুদি দোকান চালাই। দোকানের আয় দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। দুইবছর ধরে রেশম পোকা পালন শুরু করি। মূলধন ছাড়া শুধু শ্রম দিয়েই প্রতিবছর ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করছি।
বিজ্ঞাপন
আরও কয়েকজন জানান, যারা রেশম পোকা পালন করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন তাদের সফলতা দেখে অনেক নারী উদ্বুদ্ধ এই পোকা পালনে। তারাও চান রেশম পোকা পালন করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে।
সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ গ্রামের বন্দনা রানী (৫০) বলেন, তুঁত গাছের পরিচর্যা করে প্রতি মাসে টাকা পাচ্ছেন। ফলে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। আবার তুঁত গাছের ডাল রান্নায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সুন্দরগঞ্জ রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (সম্প্রসারণ) মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, দারিদ্রতা দূর করতে গাইবান্ধার তিনটি উপজেলায় রেশম পোকা পালনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করছে রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র। সুবিধাভোগীদের বিনামূল্যে ঘর নির্মাণ, ডিম সরবরাহ ও তুঁত গাছের পাতার যোগান দেওয়া হচ্ছে। তারা কেবলমাত্র শ্রম দিয়েই লাভবান হচ্ছেন। ভবিষ্যতে পুরো জেলায় এই কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এইউ

