বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

গহনার শব্দে ঘুম ভাঙে বগুড়ার যে গ্রামের মানুষের

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ১৬ মে ২০২২, ০১:১৩ পিএম

শেয়ার করুন:

গহনার গ্রাম নামে পরিচিত বগুড়া শহরতলীর ধরমপুর। যে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এখন অ্যান্টিকের গহনা তৈরীর কারখানা। গহনা বানানোর খুট-খাট শব্দে প্রতিদিন ঘুম ভাঙে এই এলাকার মানুষের। এসব গহনা বগুড়া জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার মার্কেট দখল করে নিয়েছে। কারখানা গড়ে উঠেছে বারপুর, মাটিডালী, জয়পুরপাড়া, মগলিশপুর, আটাপাড়া, বৃন্দবানপাড়া গ্রামেও। রয়েছেন দুই হাজারের বেশি ব্যবসায়ী। কাজ করছেন ৩০-৪০ হাজার নারী, শিশু ও পুরুষ শ্রমিক। এরমধ্যে প্রায় দশ হাজারই নারী বলে জানা গেছে।

নারীদের  সাজগোজের জন্য স্বর্ণের চাহিদা চিরদিনের। তবে এর দাম দিন দিন বাড়তে থাকায় বিকল্প খুঁজছেন নারীরা। তাই চাহিদা বেড়েছে অ্যান্টিক গহনার। সোনার রং ও নিখুঁত কারুকার্যে তৈরি এসব গহনা এখন রমনীদের সাজের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। গহনা তৈরি করে এ অঞ্চলের ব্যাবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে যেমন লাভবান হচ্ছেন, বাড়ছে কর্মসংস্থানও। 


বিজ্ঞাপন


বগুড়ায় অ্যান্টিকের খুচরা ব্যবসায়ী আজমল হোসেন বলেন, বগুড়ায় থেকেই মাসে ৫ লক্ষাধিক টাকার এ্যান্টিক গহনা খুচরা বিক্রি করে থাকি। বর্তমানে এর এত চাহিদা যে, অনেক সময় গ্রাহকদের সময় মত সরবরাহ করা যায় না।

‘এখানে নিখুঁত ডিজাইনের চুড়ি, মালা, আংটি, টিকলি, সীতাহার, মনিপুরি চেইন, গলার কণ্ঠি, বিছাসহ প্রায় সব ধরনের গহনাই তৈরী হচ্ছে।’

তিনি আরও জানান, বর্তমানে এই অলংকারের চেইন, পাথরসহ কিছু ক্ষুদ্র মালামাল ভারত থেকে নিয়ে আসতে হয়। এগুলোও আমাদের দেশে তৈরি হলে সরকারের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

‘শুধু বগুড়া থেকেই মাসে প্রায় শত কোটি টাকার মাল পাইকারী বিক্রি হয়। স্বর্ণের কারিগররাও অনেকে এখন এই গহনা তৈরি করতে শুরু করেছেন।’
ornamentsধরমপুর গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারীরা বাড়ির আঙ্গিনায় বসে টুলের উপরে গহনা তৈরির কাজ করছে। এতো নিখুঁতভাবে গহনা তৈরি করছেন, দেখতে দেখতে যেন চোখের পলক আটকে যায়।


বিজ্ঞাপন


এদের মধ্যে পলি বেগম নামে একজন বলেন, গত তিন বছর ধরে এই কাজ করছি। মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় হয়। এ টাকা দিয়ে বাচ্চার প্রাইভেটের খরচ, নিজেদের কাপড়চোপড়সহ সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ করি। 

পলি জানান, তিনি সীতাহারের বেল্ট তৈরি করে প্রতি পিসে পান তিন টাকা, আংটি তৈরি করে প্রতি পিসে পান ২ টাকা, টিকলির চেইন তৈরি করে পান দুই টাকা। এতে তার যত পরিশ্রম হয় সেই হিসেবে তিনি পারিশ্রমিক পাননা। 

কথা বলে জানা যায়, আশপাশের ৮-১০টি গ্রামের শত শত নারী নিজেদের ঘরের কাজের পাশাপাশি অ্যান্টিক গহনার কাজ করছে। এ কাজ করে অনেকেই সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। পলির মতো, শিল্পি, আংগুরি, সালমা, রেখাকেও এই গহনা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়।

আমেনা নামের ৯ বছর বয়সী এক শিশুকে দেখা যায় মায়ের সাথে গহনা তৈরি করতে। তার কাছে জানতে চাইতে বলে, ‘হামি মালার বেল্ট তৈরি করে প্রতি দিন ৭ টাকা পাই। সেডা দিয়ে হামি সদায় কিনে খাই ‘ 

গত দুই বছর করোনার কারণে মুখ থুবড়ে পড়লেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে গহনার গ্রাম ধরমপুর। গহনা তৈরির কাজ করে পাল্টে গেছে আশপাশের গ্রামের মানুষেরও। 

শ্রমিকরা জানান, আগে সোনার গহনা তৈরির জন্য কয়লার আগুনে পিতলের নল দিয়ে গহনার জোড়া লাগানো হতো। এখন প্রযুক্তি পাল্টে গেছে। তারা গ্যাসের পটে চাপ দিয়ে গহনা জোড়া লাগান। তারা একটি মোমের ছাঁচে জোড়া দিয়ে তৈরি করেন নানা ডিজাইনের গহনা। এ গহনা তৈরি হয় তামা, পিতল ও দস্তার সংমিশ্রণে। অপূর্ব হতের কারুকাজে তৈরি হচ্ছে চোখ ধাঁধানো গহনা। এগুলো সোনা নাকি অন্য কোনো মূল্যবান পদার্থের তা পরীক্ষা না করে ধরার কোনো উপায় নেই।
ornaments মাসুদ নামের এক ক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি পেশায় কাঠ মিস্ত্রি। তার মেয়ের বিয়েতে গহনা দেবার সামর্থ নেই। তাই এখানে সেছেন গহনা কিনতে। তিনি বলছেন, এই গহনা বাজারে এসে আমাদের মতো গরিব মানুষের অনেক উপকার হয়েছে।

বগুড়ার ধরমপুর বাজারের সাধারন সম্পাদক ও অ্যান্টিক গহনার পাইকারী ব্যবসায়ী আবু জাকির হোসেন মিঠু জানান, ‘নব্বইয়ের দশক থেকে বগুড়ায় প্রথম শুরু হয় এই গহনার বেচাকেনা। সেসময় বগুড়ায় তিনজন ব্যবসায়ী ভারত ও চীন থেকে কিছু মালামাল নিয়ে এসে বগুড়ায় ব্যবসা করতো। সেসময় এর তেমন চাহিদা ছিল না। তাছাড়া কোনো স্বর্ণের কারিগরও এটি সহজে বানাতে চাইতো না। কিন্তু পর্যায়ক্রমে দেশে স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকলে এই গহনার চাহিদা বাড়ে। এখন বগুড়ায় এর বৃহৎ পাইকারী বাজার গড়ে উঠেছে। হাজারখানেক ব্যবসায়ী এর সঙ্গে এই ব্যবসা করছেন এখন। মাসে এখানে প্রায় শত কোটি টাকার অলংকার বিক্রি হয়। প্রতিদিন এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এসব অলংকার যাচ্ছে।’

বগুড়ায় বৃহৎ এ্যান্টিকের বাজার গড়ে উঠায় এখানকার  যুব সমাজ কর্মের পথ পেয়েছে,বেকারত্ব কিছুটা দূর হয়েছে। শ্রমিকেরা রক্ষা পেয়েছে।  জেলায় বর্তমানে প্রায় ৩০/৪০ হাজার শ্রমিক রয়েছে। যারমধ্যে প্রায় ১০ হাজার রয়েছে নারী শ্রমিক।

ধরমপুর বাজারের শামিম সরকার নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আগের চেয়ে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় গহনা বানিয়ে লাভ তেমন হচ্ছে না। ব্যবস্যা মন্দা যাচ্ছে। 

অ্যান্টিক গহনার এই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রসঙ্গে  জানতে চাইলে বগুড়া বিসিকের ডিজিএম জাহেদুল ইসলাম জানান, এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। কেউ সহায়তা চাইলে অবশ্যই তাদের সহায়তায় বিসিক এগিয়ে আসবে।

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর