বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট ও চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ লোৎস জয়ে চট্টগ্রামে বাবর আলীর বাড়িতে চলছে আনন্দ-উৎসব। আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুরা ছুটে আসছেন বাবরের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুড়িশ্চর নজুমিয়াহাট বাদশা মিয়া সিপাহি বাড়ি এলাকায়।
হাতে করে নিয়ে আসছেন নানারকম মিষ্টি। এতে বাবর আলীর বাড়িতে প্রচুর জনমানুষের ভিড় জমে।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (২১ মে) দুপুরে এ চিত্র দেখা যায় বাবর আলীর বাড়িতে। তবে ছেলের সাফল্যে গর্বিত বাবর আলীর বাবা লিয়াকত আলীর মুখে হাসি ফুটলে মা লুৎফুর নাহার জানালেন দুশ্চিন্তার কথা।
মা লুৎফুর নাহার বলেন, আমার দুশ্চিন্তা এখনও কাটেনি। প্রথমে দুশ্চিন্তা ছিল মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় ঠিকমতো উঠতে পারবে কিনা, তা কেটে গেছে। এরপর দুশ্চিন্তা ছিল সে সুস্থভাবে নেমে আসতে পারবে কিনা, তাও কেটে গেছে। এখন একই চিন্তা লোৎস পর্বতশৃঙ্গে ওঠা-নামা নিয়ে। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, বাবর যেন সুস্থভাবে ফিরে আসে।
মা লুৎফুর নাহার আরও বলেন, এভারেস্টজয় তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল কিন্তু আমাদের চাওয়া এটা ছিল না। কারণ এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর স্বপ্নযাত্রা। আমার প্রত্যাশা ছিল, ডাক্তার হয়ে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হয়ে ভালোভাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। সে চিকিৎসা পেশায় থাকুক, এটাই আমার চাওয়া।
বাবা-মা জানান, তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে বাবর আলী দ্বিতীয়। বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে থাকেন বাবর আলী। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল ছেলেটি পেশায় চিকিৎসক। ঘুরেছেন দেশ-বিদেশ। পেয়েছেন অসংখ্য পদক ও পুরস্কার। সেগুলো সাজানো আছে পুরো বাড়িতে। এর মধ্যে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পদক আছে।
বিজ্ঞাপন
![]()
দোতলা বাড়ির এক কক্ষে থাকেন বাবর। তার কক্ষে যেতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার আগে চোখ আটকে গেলো দেয়ালে। পর্বতারোহণের ছবি ও অর্ধশতাধিক পদক ঝুলছে দেয়ালজুড়ে। কোলকাতা পুলিশ সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ হাফ ম্যারাথনের, কাপ্তাই হাফ ম্যারাথন, সাইক্লিং ম্যারাথন জয়ের পদকগুলো দেখা গেল সিঁড়ির দেয়ালে। দোতলায় বসার ঘরে আরও কিছু পদক ও সম্মাননা রাখা ছিল। এসব দেখে কারও মনে হবে না, এভারেস্টজয়ী বাবর পেশায় চিকিৎসক।
এই দম্পতির ছেলে বাবর পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে ও লোৎসে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন। রোববার নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছান বাবর।
বাবরের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং লাখো শুভাকাক্ষীর দোয়ায় প্রকৃতিমাতা (এভারেস্ট) বাবরকে ক্ষণিকের জন্য স্থান দিয়েছেন নিজের চূড়ায়। খানিক আগে বেসক্যাম্প ম্যানেজার এবং আউটফিট মালিক আমাদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আর এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই অনবরত ফোন আসতে থাকে বাবরের বাবা-মায়ের কাছে। আত্নীয়-স্বজন, প্রতিবেশী বাবরের খোঁজ নেন। খোঁজ নেন বাবরের বন্ধুরাও। অনেকে শুভেচ্ছাও জানান। অনেকে বাড়িতে আসছে হাতে মিষ্টি নিয়ে। তাদের সবাইকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার (২১ মে) সকালে বিশ্বের চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে আরোহনের খবর আসে বাবরের। ছেলের সাফল্যে ভালো লাগলেও তার সুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকার কথা জানান বাবা-মা।
লিয়াকত আলী বলেন, আমি কুয়েত প্রবাসী ছিলাম। ২০১৭ সালে দেশে ফেরার পর আর যাইনি। এখন বাড়িতেই থাকি। আমার তিন ছেলে এক মেয়ে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বাবর। বড় ছেলে মামুন আলী ব্যারিস্টার। পরিবার নিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। দ্বিতীয় ছেলে বাবর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছে। মেয়ে হামিমুন তানজিন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কক্সবাজার আদালতে কর্মরত। ছোট ছেলে মো. আবির আলী বিকাশের কর্মকর্তা হিসেবে আছে।
ছেলের শৈশবের স্মৃতি জানতে চাইলে লিয়াকত আলী বলেন, ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল। স্কুল জীবনে প্রতিটি খেলাধুলায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছে। সৃজনী গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। লেখাপড়ায় ভালো ছিল। এ কারণে স্বপ্ন ছিল ডাক্তারি পড়াব। এমবিবিএস পড়ে সে স্বপ্নপূরণও করেছে। তবে তার স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হবে। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। পড়াশোনার পাশাপাশি ৬৪ জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে। ২০১৯ সালে পরিবেশ রক্ষার ব্রত নিয়ে ৬৪ জেলা হেঁটে পার করেছিল। কাশ্মীরে সাইকেল যাত্রায় অংশ নিয়েছিল। লিখেছে ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে বইও।
![]()
বাবরের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা। বইটির পরিচিতিতে লেখা হয়, পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়ি। এই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। জন্ম, বেড়ে উঠা ও শিক্ষাজীবন চট্টগ্রামে। এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে কাজ করছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবিতে।
বইতে লিখেছেন, ২০১৯ সালে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন ৬৪ জেলা। এতে সময় লেগেছে ৬৪ দিন। দেশ দেখা আর মানুষের সঙ্গে ভাব-বিনিময় ছাড়াও পদযাত্রাকালীন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য গণসচেতনতা তৈরি করেছেন। তাদের জানিয়েছেন পরিবেশগত ঝুঁকি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, সামুদ্রিক প্রাণের ঝুঁকির তথ্য।
পর্বত আরোহণের যাত্রা কীভাবে শুরু হয়েছিল জানতে চাইলে লিয়াকত আলী বলেন, ট্রেকিং জগতে হাতেখড়ি ২০১০ সালে। ওই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম পাহাড় চষে বেড়ায়। সফলতার সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর আত্নবিশ্বাস বেড়ে যায়। বান্দরবানের একাধিক পাহাড়ে উঠেছিল। এরপর কীভাবে বিশ্বের বড় বড় পর্বতে উঠবে, সেই পরিকল্পনা চলতে থাকে। পরে নেপালের পাহাড়ে ওঠে।
২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম চূড়া আমা দাবলাম (২২ হাজার ৩৪৯ ফুট) আরোহণ করে। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভাবনা শুরু হয়। এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন বুনতে শুরু করে। এই কথা শোনার পর দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই আমরা। নিষেধও করেছিলাম।
কারণ চূড়ায় উঠতে গিয়ে অনেকের মৃত্যুর কথা আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। নিষেধ করার পর থেকে আমাদের কিছু জানাতো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকে। তবে যাত্রার দিন বলেছিল। সর্বশেষ ১৫ মে শেষবার কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনও কথা হয়নি। অবশেষে স্বপ্নপূরণ হয়েছে। বাবা হিসেবে গর্ববোধ করছি।
![]()
যেভাবে রচিত হলো ইতিহাস
গত ১ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে নেপালের উদ্দেশে রওনা হন বাবর আলী। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান লুকলা বিমানবন্দরে। এরপর পথচলা শুরু করেন এভারেস্ট বেজক্যাম্পের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছান ১০ এপ্রিল। উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেজক্যাম্প থেকে একাধিকবার উচ্চতায় ওঠানামা করেছেন বাবর। ২৬ এপ্রিল এভারেস্টের ক্যাম্প-২ পর্যন্ত ঘুরে এসে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব সমাপ্ত করেন। এরপর অনুকূল আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
১৪ মে মাঝরাতে বেজক্যাম্প থেকে শীর্ষ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন বাবর আলী। ১৫ মে সকালে পৌঁছে যান ক্যাম্প ২-এ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর উঠে যান ক্যাম্প ৩-এ। সেখান থেকে ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প ৪-এ। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের ওপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন।
১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা। ১৯ মে ভোরের প্রথম কিরণে ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা। এরপর তারা নেমে আসেন ক্যাম্প-৪ এ। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে ২০ মে মধ্যরাতে লোৎসে চূড়ার উদ্দেশ্যে পথ ধরেন। মঙ্গলবার সকালে সফলভাবে সেখানে পৌঁছান।
নেপালের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগের দিন ৩১ মার্চ চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের ইচ্ছার কথা জানান বাবর আলী। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, বেশির ভাগ পর্বতারোহীই বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিন্দুতে দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন দেখেন। আমিও দেখছি। আমি চ্যালেঞ্জিং আর নতুন কিছু করতে পছন্দ করি। তাই এবার এভারস্টের সঙ্গে লোৎস জয় করার স্বপ্ন দেখছি। পুরো অভিযানে সময় লাগবে দুই মাস। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মে মাসের ৩য় সপ্তাহ কিংবা শেষ সপ্তাহে চূড়ায় আরোহণ করতে পারি।
![]()
নেপাল-তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত ২৯ হাজার ২৮ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টে অভিযান নিঃসন্দেহে দুরূহ একটা কাজ। একই অভিযানে ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট উচ্চতার মাউন্ট লোৎসে আরোহণের প্রচেষ্টাকে করেছে আরও চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ থেকে আগে এভারেস্ট জয় করা হলেও একই অভিযানে এভারেস্ট এবং লোৎসে আরোহণের চেষ্টা হয়নি। সেই চ্যালেঞ্জই নিতে বেশ কয়েক বছর ধরে নিজেকে হিমালয়ের নানান চূড়ায় অভিযানের জন্য প্রস্তুত করেন বাবর।
২০১৪ সাল থেকে তার পর্বতারোহণে পথচলা শুরু। চট্টগ্রামের পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। এ ক্লাবের হয়েই গত দশ বছরে হিমালয়ের নানান শিখরে অভিযান করেছেন তিনি। ২০১৭ সালে ভারতের উত্তরকাশীর নেহেরু ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম ও টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম (২২,৩৪৯ ফুট) আরোহণ করেন বাবর।
এর আগেও বেশ কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন বাবর। তার মধ্যে রয়েছে সারগো রি (৪ হাজার ৯৮৪ মিটার), সুরিয়া পিক (৫ হাজার ১৪৫ মি.), মাউন্ট ইয়ানাম (৬ হাজার ১১৬ মি.), মাউন্ট ফাবরাং (৬ হাজার ১৭২ মি.), মাউন্ট চাউ চাউ কাং নিলডা (৬ হাজার ৩০৩ মি.), মাউন্ট শিবা (৬ হাজার ১৪২ মি.), মাউন্ট রামজাক (৬ হাজার ৩১৮ মি.) ও চুলু ইস্ট (৬ হাজার ০৫৯ মি.) অন্যতম।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৪ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। এরপর ২০১১ ও ২০১২ সালে দুবার এভারস্টজয় করেন এম এ মুহিত। ২০১২ সালের ১৯ মে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্টজয় করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে এভারেস্টজয় করেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। ২০১৩ সালের ২০ মে পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে খালেদ হোসাইন। তিনি এভারেস্ট চূড়া থেকে নেমে আসার সময় মারা যান। ১১ বছর পর এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশি পতাকা ওড়ালেন বাবর আলী।
প্রতিনিধি/টিবি

