সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সন্তানের মাঝেই নিজের স্বপ্ন দেখেন লাভলী

রেজাউল করিম জীবন, রংপুর
প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৪, ০৭:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

সন্তানের মাঝেই নিজের স্বপ্ন দেখেন লাভলী

উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশের মানুষের সেবা করার স্বপ্ন ছিল আলেয়া খাতুন লাভলীর। কিন্তু বাল্যবিয়ের কারণে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হয়নি। তবে থেমে যায়নি তার স্বপ্ন। আর তা বাস্তবায়নে সন্তানদের নিয়ে স্বপ্নের পথে হাটছেন তিনি।

এক মেয়ে বিসিএস ক্যাডার। আরেকজন পড়ছেন ডাক্তারি। নিজে ব্যবসা করেন, যুক্ত আছেন রাজনীতির সঙ্গেও। সব মিলিয়ে আলেয়া এখন স্থানীয়দের কাছে রত্মগর্ভা মা হিসাবেই পরিচিত।


বিজ্ঞাপন


আলেয়ার জন্ম ১৯৬৭ সালে রংপুর নগরীর ইসলামপুর হনুমানতলায়। ৭ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। নিম্নমধ্যবিত্তের ঘরে জন্ম তার। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু সেই স্বপ্নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বাল্যবিয়ে। ১৯৭৯ সালে ৭ম শ্রেণি পাশ করে সবে মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে তিনি। সেই সময় বিয়ে হয়ে যায় তার। স্বামী কৃষি অফিসের প্রধান অফিস সহকারী। নিজের অদম্য ইচ্ছা আর স্বামীর সহযোগিতায় পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তিতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েন তিনি।

১৯৮১ সালে প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। পরে ২য় কন্যা সন্তান জন্ম নেয় ১৯৮৬ সালে এবং ৩য় কন্যা সন্তানের জন্ম হয় ১৯৯৮ সালে। তবে ১ম সন্তান জন্মের পর আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি তার। তখন নিজের পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে তিনি সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন। নিজের লুকায়িত স্বপ্নকে বাস্তবায়নে নিজের সন্তানদের নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। এই নারী নিজের সুখ ভোগ বিলাস উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দুই সন্তানকে।

স্বামী আব্দুস সামাদ সারাদিন ব্যস্ত থাকেন নিজ কর্মস্থলে, যার কারণে সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, প্রাইভেট কোচিং যাওয়া আশার কাজ করেন তিনি। কন্যা সন্তানেরা বড় হতে থাকেন আর তাদের মাঝেই নিজের স্বপ্ন পুরণের স্বপ্ন দেখেন আলেয়া খাতুন লাভলী। সন্তানেরাও মায়ের ইচ্ছে পূরণে বদ্ধপরিকর। আলেয়া খাতুন লাভলী শুধু সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি মেয়েরা একটু বড় হতেই তিনি পরিবারের অর্থ জোগান দিতে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা।

২০০০ সালে ছোট মেয়ের নামে ‘মোনালিসা সিল্ক সেন্টার’ শুরু করেন তিনি। দিনের বেলা মেয়েদের স্কুলে আনা নেওয়ার কাজ শেষে কাপড়ের দোকানে বসেন এবং কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে যান। এরই মাঝে সম্পৃক্ত হন রাজনীতির সঙ্গে। তিনি রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন একাধিকবার। বর্তমানে আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য।


বিজ্ঞাপন


এছাড়াও তিনি কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। এজন্য তিনি গুণিজন হিসেবে সম্মাননাও পেয়েছেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হলেও মেয়েদের কথা চিন্তা করে ইচ্ছে থাকা সত্বেও বাড়ি করা হয়নি তাদের। বর্তমানে রংপুর নগরীর গনেশপুরে টিনশিটের বাড়িতে বসবাস করেন স্বামীকে নিয়ে।

এদিকে বড় মেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা সাথী পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে ৩১ তম বিসিএস এর মাধ্যমে কৃষি অধিদফতরে কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ২য় মেয়ে আসমাউল হুসনা মোনালিসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস এর শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত। শুধু তাই নয় মোনালিসা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদকসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। মেজ মেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে উম্মে মুক্তা ডিগ্রি পাশ করার পর ২০১২ সালে অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

Mothers_Day--Rangpur--2

আলেয়া খাতুন প্রসঙ্গে স্বামী আব্দুস সামাদ বলেন, বিয়ের পর তার ইচ্ছে অনুযায়ী পড়ালেখা শুরু করেছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে সন্তান মানুষ করতে গিয়ে আর পড়ালেখা করতে পারে নাই। তবে সন্তানের পিছনে সবসময় লেগেছিল সে। যার কারণে মেয়েরা আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর আমাদের স্বপ্ন পুরণ হয়েছে।

আলেয়া খাতুন লাভলী বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে দেশ ও মানুষের সেবা করার। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে দমে যাইনি কখনও। আমার স্বপ্ন আমি সন্তানের মাঝে দেখেছি। সেই স্বপ্ন পুরণে দিনরাত ছুটেছি। ইচ্ছে থাকলেও সন্তানের পড়ালেখার কথা ভেবে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারিনি। আমার স্বামী অফিস ব্যস্ত থাকতো যার কারণে মেয়েদের সময় দিতে পারেনি। তবে আর্থিক সহযোগিতা আর উৎসাহ সবসময় দিতেন তিনি। যার কারণে সেই স্বপ্ন পুরণ হয়েছে। আমাদের ছেলে সন্তান নাই। আমরা মেয়েদের মানুষের মতো গড়ে তুলেছি। ছেলে সন্তানের কোনো অভাব বোধ করি না। বড় মেয়ে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। সে কৃষি অধিদফতরে কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। মেয়ে জামাই ড. সোহেল সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে আছেন। ছোট মেয়ে ডাক্তারি পরছেন। এবারে শেষ বর্ষে। তারা দুজনেই দেশের কল্যাণে আর মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। আমি তাতেই খুশি।

সন্তানদের কাছে চাওয়া পাওয়া জানতে চাইলে আলেয়া খাতুন জানান, আমি চাই সন্তানরা সমাজ ও দেশের কাজে এসে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকুক। নিজের আলোয় সমাজকে ও মানুষকে আলোকিত করুক।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর