মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ঢাকা

কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১০ মে ২০২৪, ০৭:১০ এএম

শেয়ার করুন:

কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার
ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ ১১ ঘণ্টার চিরুণী অভিযানের পর চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ইয়াক-১৩০ এর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেছে নৌ বাহিনীর অভিযানকারী দল। বৃহস্পতিবার (৯ মে) দিনগত রাত সাড়ে ১০টায় উদ্ধার কাজ সম্পন্ন হয়।  

বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাত সাড়ে ১২টায় এসব তথ্য জানান বিমানবাহিনী জহুরুল হক ঘাঁটির অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে এম শফিউল আজম। তিনি জানান, বঙ্গোপসাগর আর কর্ণফুলী নদীর মোহনা হওয়ায় নদীর তলদেশ খুব গভীর। এজন্য এটি খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয় নৌবাহিনীকে।
 
তিনি জানান, উদ্ধারকারীরা তিন ভাগে বিমানটি খুঁজেছেন। যে জায়গায় বিমানটি পড়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে, সেখানে লাল রংয়ের একটি বেলুন দিয়ে শনাক্ত করেছেন। সেখানে ডুবুরি দিয়ে খোঁজা হয়েছিল। অন্য একটি দল নদীর পাড়ে খোঁজ চালিয়েছিলেন। 


বিজ্ঞাপন


এছাড়া আরেকটি দল জহুরুল হক ঘাঁটিতে বসে সবকিছু মনিটরিং করছিলেন। অবশেষে নদীতে নৌবাহিনীর ডুবুরি দল নামার এক ঘণ্টার মধ্যে বিমানটি নদীতে শনাক্ত করে উপরে জাহাজে তুলতে সক্ষম হয়। নৌবাহিনীর আধুনিক জাহাজ বলবান উদ্ধার কাজ চালায়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর ম্যানুয়াল দুই পদ্ধতিতেই খোঁজা হয় বিমানটি। এমনকি বিমানটি খুঁজতে বিশেষ সোনার সিস্টেমও ব্যবহার করা হয়। উদ্ধার কাজে সেনা, নৌ, বিমানসহ ফায়ার সার্ভিসের লোকজন অংশ নেন।  

এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সহকারী বিমানবাহিনী প্রধান (পরিকল্পনা) এয়ার ভাইস মার্শাল মু. কামরুল ইসলাম ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং উদ্ধার কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেন। এ সময় বিমানবাহিনী প্রধানের নির্দেশক্রমে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য বাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এর আগে বৃহস্পতিবার (৯ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা এলাকার কর্ণফুলী নদীর মোহনায় চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের ১১ নম্বর ঘাটের নতুন পতেঙ্গা টার্মিনালের অপর পাশে এইচএম স্টিল মিল প্রান্তে বিমানটি আঁছড়ে পড়ে। 

এ সময় পাইলট উইং কমান্ডার মো. সোহান হাসান খাঁন, পিএসসি এবং স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ অসিম জাওয়াদ জরুরি প্যারাসুট দিয়ে বিমান থেকে নদীতে নেমে পড়েন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাদের উদ্ধার করে পতেঙ্গার বানৌজা ঈসা খাঁ হাসপাতালে (নেভি হাসপাতাল) নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাইলট অসিম জাওয়াদ মারা যান।


বিজ্ঞাপন


অপর পাইলট মো. সোহান হাসান খান বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মৃত্যুকালে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ অসিম জাওয়াদের বয়স হয়েছিল ৩২ বছর। স্ত্রী রিফাত অন্তরা, ছয় বছরের এক মেয়েসন্তান এবং ছয় মাস বয়সী এক ছেলেসন্তানসহ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় থাকতেন জাওয়াদ।

আরও পড়ুন
বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানের এক পাইলট নিহত

এদিকে প্রাথমিক অবস্থায় যান্ত্রিক ক্রুটির ফলে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় বিমানটিতে আগুন লেগে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)।

আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর প্রশিক্ষণ শেষে ফেরার সময় কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। 

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিমানটিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে বৈমানিকরা অত্যন্ত সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে সেটিকে বিমানবন্দরের কাছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় (কর্ণফুলী নদীতে) নিয়ে যেতে সক্ষম হন। এতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে।

আইএসপিআর জানিয়েছে, স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ অসিম জাওয়াদ ১৯৯২ সালের ২০ মার্চ মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ডা. আমান উল্লাহ।

অসিম জাওয়াদ ২০০৭ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল থেকে বিএসসি (অ্যারো) পাস করেন।

২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি অসিম জাওয়াদ বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। পরের বছর ক্যাডেটদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান সোর্ড অব অনার প্রাপ্তিসহ জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন। চাকরিকালীন সময়ে তিনি বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি ও ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। 

তার পেশাদারী দক্ষতা ও সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ মফিজ ট্রফি, বিমানবাহিনী প্রধান ট্রফি ও বিমানবাহিনী প্রধানের প্রশংসাপত্র লাভ করেন। এছাড়াও ভারতীয় বিমানবাহিনীতে কোর্সে অংশগ্রহণ করে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ চিফ অব এয়ার স্টাফস ট্রফি ফর বেস্ট ইন ফ্লায়িং অর্জন করেন।

চাকরিকালীন সময়ে আসিম জাওয়াদ দেশে-বিদেশে পেশাগত বিভিন্ন কোর্সে অংশগ্রহণ করে সফলতার সঙ্গে তা সম্পন্ন করেন। তাছাড়া বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে এভিয়েশন ইন্সট্রাক্টর্স পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। 

চীন থেকে ফাইটার পাইলটস ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্স, ভারত থেকে অপারেশনাল ট্রেনিং ইন এভিয়েশন মেডিসিন ফর ফাইটার পাইলটস কোর্স, বেসিক এয়ার স্টাফ কোর্স ও কোয়ালিফাইড ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর্স কোর্স সম্পন্ন করেন।

আইএসপিআর আরও জানায়, অসিম জাওয়াদ কমিশন পাওয়ার পর ১২ বছর পাঁচ মাস নয় দিন চাকরি করেন।

মানিকগঞ্জ শহরের পৌর ভূমি অফিসের সামনের গোল্ডেন টাওয়ারের সাত তলায় বসবাস করে জাওয়াদের পরিবার। বাবা ডাক্তার আমানুল্লাহ ঢাকার সাভারের নবীনগর এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে পাইলট জাওয়াদের মা নিলুফা আক্তার বিলাপ করে বলছেন, আমি আছি অথচ আমার ছেলে নেই, এটা কেমন কথা! আমাকে মাটি দেবে আমার ছেলে, আর এখন তাকে মাটি দিতে হবে আমাকে!

নিহত জাওয়াদের বড় মামা সাংবাদিক সুরুজ খান বলেন, অত্যন্ত মেধাবী ছিল জাওয়াদ। স্কুল ও কলেজ জীবনে সব সময় প্রথম হয়েছে। ছোটবেলা থেকে জাওয়াদের স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। তাকে হারিয়ে তার পরিবারে যেন বাজ পড়েছে। জাওয়াদের মরদেহ শুক্রবার মানিকগঞ্জে আনা হবে বলে জানান তিনি।

প্রতিনিধি/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর