মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

মামলা থেকে রেহাই পেলেও যেসব প্রশ্নের উত্তর পায়নি গ্রামবাসী

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৭ মে ২০২৪, ০৭:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

মামলা থেকে রেহাই পেলেও যেসব প্রশ্নের উত্তর পায়নি গ্রামবাসী

বেশ আগ্রহ নিয়ে মোবাইল সিম কিনেছিলেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার গোতামারি গ্রামের নারী ও পুরুষরা। এজন্য তারা দিয়েছিলেন আঙ্গুল ও চোখের আইরিশের ছাপ, যা নিয়েছিল মোবাইল অপারেটর ‘রবি’র পরিচয় দিয়ে সেই গ্রামে যাওয়া কয়েকজন যুবক। পরে দেখা যায়, তাদের আঙ্গুল ও চোখের আইরিশের ছাপ ব্যবহার করে একাধিক সিম সক্রিয় করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেসব সিমের নম্বর ব্যবহার করে খোলা হয়েছে বিকাশ একাউন্ট। এরপর তা দিয়ে চলছিল প্রতারণা করছিল একটি চক্র।

সিমগুলো গ্রামবাসী কিনেছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। পরের বছর ২০২৩ সালের জুলাইয়ে গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষের নামে বিকাশে প্রতারণার অভিযোগ মামলার নোটিশ আসতে শুরু করে। নোটিশের তালিকা থেকে বাদ যায়নি স্কুলশিক্ষিকা থেকে শুরু করে গ্রামের অসহায় নারী ভিক্ষুকও। গত বছরের আগস্টে ঢাকা মেইলের কাছে এ নিয়ে তথ্য এলে দীর্ঘ এক মাস অনুসন্ধান শেষে দুই পর্বের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে টনক নড়ে প্রশাসনের, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এরপর প্রায় ১০ মাস অতিবাহিত হতে চলেছে। সিম কিনে প্রতারণা শিকার এবং মামলার আসামি হওয়া সেই গ্রামের বাসিন্দারা এখন কেমন আছেন?


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

‘সিম কিনে’ যেভাবে ফাঁসলেন পুরো গ্রামের বাসিন্দারা
প্রতারণা না করেও মামলার নোটিশ, আতঙ্কে গ্রামবাসী

অনেকেই জানিয়েছেন, তারা আঙ্গুল ও চোখের আইরিশের ছাপ দেওয়ার পর সেই যুবকরা তাদের কাউকে একটি, কাউকে দুটি করে সিম দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেছে, তাদের কারও নামে তিনটি, কারও নামে সাতটি পর্যন্ত সিম রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। কিন্তু তারা তা জানতে না। ওই সময় সেই যুবকদের কাছ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ সিম কিনে প্রতারিত হয়েছিলেন।

এখানেই শেষ নয়, সেসব মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগে শরীয়তপুর থেকে নোটিশ আসে চিরিরবন্দর থানায়। পরে সেই নোটিশ অর্ধ শতাধিক ব্যক্তির নামে তাদের বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়। এমন মামলার নোটিশ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গ্রামবাসী। অনেকে মামলার খরচ মেটাতে গিয়ে গরুও বিক্রি করেন।

গ্রামবাসী জানায়, সিম কেনার প্রায় ১০ মাস পর ২০২৩ সালের জুলাই মাসে এসব সিম ব্যবহারকারীর মধ্যে ৬ জনের নামে স্থানীয় থানা থেকে নোটিশ আসে। তাদের সিম ব্যবহার করে ‘বিকাশ’, ‘নগদ’ ও ‘রকেট’ একাউন্ট খুলে প্রতারণার মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগে বলা হয়। এ অভিযোগে করা মামলায় শরীয়তপুরের সিআইডি তাদেরকে ডেকে পাঠায়। এমন নোটিশ পেয়ে হতভম্ব হয়ে যান ওই ৬ জন। পরে আরও নোটিশ আসতে শুরু করে।


বিজ্ঞাপন


গত ২৬ এপ্রিল দিনাজপুর চিরিরবন্দরের বড় শ্যামনগর গোতামারী গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌসের বাড়িতে কথা হয় ভুক্তভোগী আকতারা বেগমের সাথে। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি ওই সময় রাতদিন চিন্তা করতাম, কিভাবে মামলা থেকে রেহাই পাওয়া পাব। অপরাধ না করেও এমন নোটিশ আসায় লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম। স্বামীও ভুল বুঝেছিল। আমার স্বামীর নামেও নোটিশ এসেছিল। তিনিও তাদের কাছ থেকে সিম কিনেছিলেন। মাত্র ২০ টাকায় সিম কেনার লোভ অনেকে সামলাতে পারেনি। এই সিম যে পরে গলার কাঁটা হবে তা কেউ আঁচও করতে পারেনি। এখন মামলা থেকে রেহাই পেয়েছি। এটি সম্ভব হয়েছে ঢাকা মেইলে খবর প্রকাশ হওয়ার কারণে।

স্কুলশিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আমার নামে বিকাশ একাউন্ট খোলা হয়েছিল কিন্তু আমি জানতাম না। পরে আমরা গ্রামবাসী সোচ্চার হয়ে থানায় যাই এবং সেই সাথে বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরার জন্য জানাই। প্রথম বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে ঢাকা মেইল। তাদের কারণে মামলাটির নেপথ্যের আসল ঘটনা পুলিশও জানতে পারে। এখন আমরা ভালো আছি। মামলা থেকে সবাই খালাস পেয়েছে। এখন আর কোনো সমস্যা নেই।

জান্নাতুলের ভাসুরের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকাও একই ফাঁদে পড়েছিলেন। আয়েশা জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী দুটি সিম কিনেছিলেন। সেই সিম দুটি ব্যবহার করে ‘বিকাশ’ একাউন্ট খুলে প্রতারণা করেছে প্রতারক চক্র। আর নোটিশ এসেছিল তাদের দুজনের নামে। তারা আর সেই ভুল করতে চান না।

ভুক্তভোগী সালমা বলেন, ওই ঘটনার পর থেকে গ্রামে যত ব্যক্তিই এসেছেন তাদের প্রত্যেককে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করেছে এলাকাবাসী। আর কারও কাছে আমরা কখনো সিম কিনব না। দরকার হলে সিম কোম্পানির আউটলেটে যাব, সময় নিয়ে সিম কিনব। আমাদের মতো আর কেউ যেন এমন ভুল না করে।

বড় শ্যামনগর গোতামারী গ্রামের মোতালেব হোসেন বলেন, সেই সময়টা যে কিভাবে কেটেছে! আমরা ভয়ে ছিলাম কখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। অপরাধ না করেও আসামি হয়েছি, ধরলে তো আরও মানসম্মান শেষ। একটি সিম কেনার জন্য আঙ্গুলের ছাপ দিলেও দিনাজপুরে রবি কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে জানতে পারি আমার নামে চারটি সিম তোলা হয়েছে।

SIM_Dinajpur_Followup-1

ভুক্তভোগী জয়নব বলেন, নোটিশ পাওয়ার পর আমাদের নাওয়া, খাওয়া ও ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে খবর প্রকাশ না করলে আমরা মাসের পর মাস এই মামলার ঘানি টানতাম। সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি।

তিনি ঢাকা মেইলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনারা অনুসন্ধান না চালালে হয়তো বিষয়টি আলোচনাতেই আসতো না। পুলিশও জানতো না।

জান্নাতুলের সচেতনায় বেঁচে যায় গ্রামবাসী

স্কুলশিক্ষিকা জান্নাতুল ভুক্তভোগী হলেও ছিলেন সাহসী। তিনি প্রথম এই ঘটনাটি ঢাকা মেইলকে জানান। পরে তার কথার সূত্র ধরেই আরও ভুক্তভোগী মেলে। তিনি তাদের সবাইকে জড়ো করেন এবং একদিন স্থানীয় থানায় যান। পুলিশের কাছে তারা বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেন। এরপর প্রশাসনের টনক নড়ে। তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। ফলে পুরো গ্রামবাসী রক্ষা পায় এই মিথ্যা মামলার কবল থেকে।

জান্নাতুলের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, অবস্থান এমন হয়েছিল যে অনেকে গরু বিক্রি করে হলেও মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন দৌড়ঝাপ শুরু করেছিল। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে আমরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি।

গ্রামবাসী যেসব প্রশ্নের উত্তর এখনও পাননি

গ্রামবাসী প্রশ্ন রেখেছেন, যারা সেদিন গ্রামটিতে মোবাইল সিম বিক্রি করতে গিয়েছিল তারা যদি সংশ্লিষ্ট সিম কোম্পানির লোক না হবেন তাহলে আঙ্গুল ও চোখের ছাপ নেওয়ার জন্য সেই যন্ত্রপাতি কোথায় পেল তারা? কোনো কোম্পানি কিংবা ওই কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের প্রতিনিধি না হলে কি ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আইরিশের ছবি নেওয়া যায়? এছাড়া ‘সিম’ কিনতে আইরিশের ছবি লাগার কথা না। তাহলে ওই যুবকরা কেন আইরিশের ছবি নিল?

বৃদ্ধা ভিক্ষুকও রক্ষা পায়নি!

এ গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধা ভিক্ষুক সাহেদা বেগমের নামেও নোটিশ এসেছিল। তার নামে নোটিশ দেখে এলাকাবাসী অবাক হয়ে যায়। এরপর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে অবশেষে সেই ভিক্ষুকেরও মুক্তি মিলেছে।

এ বিষয়ে চিরিরবন্দর থানার এসআই সুলতান বাদশা ঢাকা মেইলকে বলেন, বৃদ্ধা সাহেদা এই হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে শরীয়তপুরেও গিয়েছিলেন। আমরাও তদন্ত করে দেখেছি তিনি জড়িত না।

এ ব্যাপারে উপজেলার ৬নং অমরপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন আর কোনো ঝামেলা নেই। এলাকার লোকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।

এ ঘটনায় করা বেশিরভাগ মামলার তদন্তকারী সিআইডির শরীয়তপুর জেলার এসআই মুজিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ওই গ্রামের লোকজনের যাদের নামে মামলা হয়েছিল তাদেরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আমি নিজে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছি। তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি আসলে বিকাশে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রতারণার সাথে তারা কেউ জড়িত নয়। তারা ভুক্তভোগী। তবে সেই সিম বিক্রয়কারী যুবকদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এটি একটি চক্র। চক্রটিকেও খুঁজে বের করতে কাজ করেছি। চক্রটি রাজশাহী অঞ্চলে থেকে এসব প্রতারণা করছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়েছে।

এমআইকে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর