মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

২০০ বছরের পুরোনো চড়ক পূজায় হাজারও মানুষের ঢল

জেলা প্রতিনিধি, ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৮ এএম

শেয়ার করুন:

২০০ বছর পুরোনো চড়ক পূজায় হাজারও মানুষের ঢল

বড়শিতে গাথা জ্যান্ত তাজা মানুষ। চড়ক গাছে ঝুলিয়ে প্রায় ২৫/৩০ ফুট শূন্যে ঘুরাতে ঘুরাতে সন্ন্যাসী মনা কর্মকার ছুড়ে দিচ্ছেন বাতাসা। শুধু মনা নয় একে একে ৬ সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শি বিধে শূন্যে ঘুরে পালন করলেন শিব পুজারই অংশ চড়ক উৎসব। গাঁ শিউরে ওঠা এই দৃশ্য দেখলেন প্রায় ২০ হাজার নারী-পুরুষ।

ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর বাজারের বকুলতলায় প্রতি বছরের ন্যায় সোমবার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে চড়ক উৎসবটি।


বিজ্ঞাপন


মহেশপুর শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের একটি গ্রাম ফতেপুরের বকুলতলা বাজার। এ গ্রামের বকুলতলা বাজারে ভারতীয় পঞ্জিকা মতে ২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পূজা। হিন্দু ধর্মাবলীরা উৎসব আয়োজনে এ পূজা করে থাকেন। প্রতি বছর এই পূজার মূল আকর্ষণ থাকে ৬/৭ জন সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শিবিদ্ধ হয়ে শূন্যে ঘোরা। এবার একজন সন্ন্যাসী অসুস্থ থাকায় ৬ জন সন্ন্যাসী বড়শি (বান) ফোড়ালেন।

স্থানীয়রা জানায়, প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে আসছে এ চড়ক পূজা। আর এ পূজাকে ঘিরে বকুলতলা বাজারে ২ দিন ধরে চলে বর্ণাঢ্য লোকজ মেলা।

আরও পড়ুন

নড়াইলে সুলতান মেলার উদ্বোধন

ফতেপুরের এ চড়ক মেলার মূল আকর্ষণ বড়শিবিদ্ধ হয়ে শূন্যে ঘোরানো (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় বান ফোড়ানো)। এ দৃশ্য অবলোকনের সঙ্গে সঙ্গে মেলায় কেনাকাটা করতে সোমবার (১৫ এপ্রিল) সকাল থেকে হাজির হয় প্রায় ২০ হাজার নারী-পুরুষ। দুপুরের পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে মেলা প্রাঙ্গনে। বিকেলের মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পুরো এলাকা। চারিদিকে সাজ সাজ রব। পুরো এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ। ঠিক বিকেল সাড়ে ৪টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ৬ সন্ন্যাসী ফতেপুর গ্রামের মনা কর্মকতার, বিল্পক কর্মকার, কৃশচন্দ্রপুর গ্রামের বাসুদেব কুমার ও বৌচিতলা গ্রামের মহাদেব কুমার, অধির কুমার, মহাদেব হালদার ফতেপুর বাওড়ে স্নান করেন। এরপর ৬ সন্ন্যাসী মাটির কলসে জল (পানি) ভরে মাথায় নিয়ে আসেন মেলা প্রাঙ্গনে চড়ক গাছের গোড়ায়।  ঠিক ৪টা ৩০ মিনিটে প্রথমে মনা কর্মকার পিঠে দু’টি বড়শি বিদ্ধ করা হয়। এ সময় স্মরণ করা হয় মহাদেব শিব ঠাকুরকে। এরপর ভীমকে ১০/১৫ জন পুরুষ ধরাধরী করে ঝুলিয়ে দেন চড়ক গাছে। অপর গাছের অপর প্রান্তে থাকা কপিকলের বাঁশ জোরে জোরে ঘোরাতে থাকেন ২০/৩০ জন যুবক। চড়ক গাছে লটকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মহিলা তাদের এক দেড় বছরের শিশু সন্তানকে তুলে দেন সন্ন্যাসীদের কোলে। তাকে নিয়েই শূন্যে ঘুরতে থাকে সন্ন্যাসীরা। এ  অবস্থায় ছিটিয়ে দেওয়া হয় বাতাসা।


বিজ্ঞাপন


এভাবেই বড়শিতে বিধে ৪/৫ পাক শূন্যে ঘুরে নেমে আসেন মনা কর্মকার। এ নিয়ে ২২ বার চড়ক গাছে চড়লেন তিনি। মনা কর্মকার জানান, এখানে হিন্দুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু সবাই চড়ক গাছে উঠতে পারে না। এতে উঠতে গেলে মনের অনেক সাহস লাগে। মনার পর একে একে বান ফোড়ালেন বিল্পব কুমার, বাসুদেব কুমার, মহাদেব কুমার ও অধির কুমার।

স্থানীয়রা আরও জানান, আগে শুধুমাত্র পিঠে বান ফুড়িয়েই ঝুলিয়ে দেওয়া হতো চড়ক গাছে। আর সে অবস্থাতেই ঘোরানো হতো। প্রায় ১১৫ বছর পূর্বে এক সন্ন্যাসীর পিঠের চামড়া ছিড়ে পড়ে আহত হওয়ার কারণে বড়শির ওপর এখন গামছা পেঁচিয়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

সোনারগাঁওয়ে শুরু হয়েছে ৫শ বছরের ঐতিহ্য বউমেলা

সন্ন্যাসী বিল্পব কর্মকার জানান, শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টির জন্যই তারা প্রতি বছর চড়ক গাছে চড়ে থাকেন। তিনি আরও জানান, শরীরে বড়শি বিধার ফলে বড় ধরণের ক্ষতের সৃষ্টি হলেও সামান্যই রক্ত বের হয়। কিন্তু এর জন্য কোনো ওষুধ লাগে না তাদের। চড়ক গাছ থেকে নামিয়ে গাছের গোড়ায় থাকা সিঁদুর টিপে দিলেই হয়।

সন্ন্যাসীরা জানান, পূর্ব পুরুষদের কাছে শুনেছেন ২০০ বছর আগে এখানে চড়ক পূজা শুরু হয়। আগে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে এ পূজার আয়োজন করা হতো। সেই স্থানে সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলার কারণে এখন ফতেপুর বকুল তলার বাজারে চড়ক পূজা হয়। এ পূজাকে ঘিরে বসে জমজমাট মেলা। লোকজ ঐতিহ্যের হরেক রকম পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বেচাকেনা করেন ২ দিন ধরে।

মিষ্টির দোকানি মোসলেম আলী (৫৩) ১০/১২ রকমের মিষ্টি সাজিয়ে বিকিনিকি করছেন। তিনি এবার ১৫ বারের মতো মেলায় আসলেও বেচাকেনা বেশ ভালোই হচ্ছে বলে জানান। কুষ্টিয়ার একতারপুরের সাখা সিঁদুর বিক্রেতা বিমল সরকারও বিকিনিকি করছেন তার পণ্য সম্ভার।

পূজা ও মেলা কমিটির সভাপতি সাধন কুমার ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক সুবোল কর্মকার জানান, চড়ক পূজা মূলত শিব পূজারই অংশ বিশেষ। নানা আনুষ্ঠানিকতায় তা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর