সোমবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচ দিনে ছয় সংঘর্ষ: নিহত ১, আহত দেড় শতাধিক 

আশিকুর রহমান মিঠু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
প্রকাশিত: ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচ দিনে ছয় সংঘর্ষ: নিহত ১, আহত দেড় শতাধিক 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫ দিনে পৃথক ৬টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে একজন নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সাত দাঙ্গাবাজকে গ্রেফতার করেছে।

শিশুদের গোসল করা নিয়ে, সরকারি জায়গা থেকে ধান কাটা, জমিতে সেচের পানি দেওয়া, হত্যা মামলার আসামিদের বাড়িতে বাদি পক্ষের ঘেরাও করা, জায়গা নিয়ে বিরোধের জের ও ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জের ধরে জেলার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর, একই উপজেলার শাহাজাদাপুর ও বিশুতারা, নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউক, একই উপজেলার উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের গুজিয়াখাই ও বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের কামালমুড়া গ্রামে পৃথক এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।


বিজ্ঞাপন


স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, পুকুরে গোসল করা নিয়ে  দুই শিশুর মধ্যে ঝগড়ার জের ধরে রোববার (১৪ এপ্রিল) দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের টিঘর গ্রামে দফায় দফায় সংঘর্ষে  উভয়পক্ষের ২০ জন আহত হন। সংঘর্ষে আহতরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতাল, সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা নেয়। 

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রোববার দুপুরে টিঘর গ্রামের পুকুরে স্থানীয় মোল্লা বাড়ি ও বাবুর বাড়ির দুই দুই শিশু গোসল করতে যায়। পরে পুকুরের ঘাটলায় দুই শিশুর মধ্যে ঝগড়া হয়। বিষয়টি জানতে পেরে দুই শিশুর পরিবারের সদস্যরা এসে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন। এর জের ধরে ওই দুই গোষ্ঠীর লোকজন দেশিয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। 

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ চলে যাবার কিছুক্ষণ পর বিকেলে আবারো তারা সংঘর্ষে জড়ায়। খবর পেয়ে পুনরায় পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি দুইজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে সরাইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আ স ম আতিকুর রহমান জানান, এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এই ঘটনায় দুইজনকে আটক করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাবেক-বর্তমান মেম্বার গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫


এদিকে একটি সরকারি জায়গায় ধান চাষ করা নিয়ে শনিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে  সরাইল উপজেলার শাহাজাদুপর গ্রামের রিপন মিয়ার দলের সাথে একই এলাকার কাউছার, মাসুক ও আফজাল মিয়ার দলের বিরোধ চলে আসছিল।

সম্প্রতি বিরোধ নিস্পত্তির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ উভয় পক্ষ শালিস সভায় বসে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়েও সভা হয়। উভয় সভায় সিদ্ধান্ত হয় সরকারি ওই জমির ধান দুই পক্ষের কেউ কাটতে পারবেন না এবং এই ধান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে কাটা হবে। উভয় পক্ষ প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে সম্মত হয়ে স্বাক্ষর করে যান। 

ঈদের পরদিন ভোরে সালিশের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ইউপি সদস্য জুয়েল, নাজমা বেগম, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুন্না, আজিজ ও ময়েজের নেতৃত্বে দুই শতাধিক লোক দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওই জমির ধান কেটে নেয়।  খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লুকিয়ে রাখা ধান উদ্ধার করে জব্দ করে। 

এরই জেরে শনিবার সকাল থেকে দফায় দফায় উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসময় কামাল উদ্দিন নামে একজন মাথায় আঘাত পেয়ে গুরুতর আহত হলে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এই ঘটনায় উভয়পক্ষের ৫৫ জন আহত হয়েছেন। তাদেরকে সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে সরাইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আ স ম আতিকুর রহমান বলেন, পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রনে আছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। 

অপর দিকে একই দিনে নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের গুজিয়াখাই গ্রামে জমিতে সেচের পানি দেওয়াকে কেন্দ্র করে চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান মেম্বার খায়রুল পাঠানের গোষ্ঠীর লোকদের সাথে সাবেক ইউপি সদস্য মারফত আলীর গোষ্ঠীর লোকদের দফায় দফায় সংঘর্ষে ১৫জন আহত হয়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৪ দাঙ্গাবাজকে গ্রেফতারকরে। 

স্থানীয়রা জানান, গুজিয়াখাই গ্রামের বাসিন্দা ও   ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান মেম্বার খায়রুল পাঠানের গোষ্ঠীর মাসুদ পাঠান কৃষি জমিতে সেচের পানি পাম্প পরিচালনা করেন। সম্প্রতি  সাবেক ইউপি সদস্য মারফত আলীর গোষ্ঠীর এক ব্যক্তির জমিতে পানি দিলেও সে মাসুদকে টাকা দেয়নি। পাওনা টাকা নিয়ে শনিবার দুপুরে দুইপক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ১৫জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ৭জনকে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বাকিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে ও স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা নেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহাগ রানা জানান, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে। ঘটনাস্থল থেকে ৪ দাঙ্গাবাজকে গ্রেফতারকরা হয়েছে। 

এদিকে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার (১২ এপ্রিল) দুপুরে নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউক ইউনিয়নের  ফান্দাউক গ্রামে দু’দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৩০জন আহত হয়। 

স্থানীয়রা জানায়, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বৃহস্পতিবার  (ঈদের দিন) ফান্দাউক গ্রামে প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। খেলা চলাকালীন দুই তরুণের মধ্যে প্রথমে বাকবিতন্ডা ও পরে হাতাহাতি হয়।

এ নিয়ে পরে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এর মধ্যে একটি পক্ষকে সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল আওয়াল ও অপর পক্ষটিকে রিপন মিয়া সমর্থন দেয়। পরে বিষয়টি স্থানীয়দের মাধ্যমে বিচার-সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির আলোচনাও হয়। 

আরও পড়ুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গোসল করাকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপের সংঘর্ষ

পরদিন শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে সাধুপাড়া নূরে মদিনা মসজিদে যায় আওয়াল মিয়ার পক্ষের লোকজন। নামাজ থেকে বের হওয়ার পর আওয়াল মিয়ার পক্ষের লোকদের উপর অতর্কিত হামলা করে রিপন মিয়ার লোকজন। 

পরে উভয়পক্ষের লোকজন দেশিয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। সংঘর্ষে  মো. নূরে আলম, মো. সজল, নাছির মিয়া, সাগর মিয়া, শিমুল মিয়া, তফু মিয়া, দিদার মিয়া, কাজল মিয়া, ফয়সাল মিয়া, হৃদয় মিয়া ও নূরেন বেগম, গোলাম নূর, রুবেল মিয়া, আলাউদ্দিন, শাহনাজ বেগম, জিনিয়া বেগম, ফাতেমা বেগম ও রুজিনা বেগমসহ উভয়পক্ষের ৩০ জন আহত হয়। আহতদেরকে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ও চিকিৎসা দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোহাগ রানা বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এলাকায় অতিরিক্তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

অপরদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের বিশুতারা গ্রামে একটি হত্যা মামলার আসামিদের বাড়িতে বাদী পক্ষের ঘেরাওকে  কেন্দ্র করে দুইপক্ষের সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৫জন আহত হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ও ১জনকে গ্রেফতার করে। সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ এমরানুল ইসলাম বলেন, গত৭ মার্চ বিশুতারা গ্রামের নিজ বাড়ির পাশ থেকে রোকেয়া বেগম-(৬৫) নামের এক বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার করা হয়। রোকেয়া বেগম ওই গ্রামের বড় বাড়ির আবুল কালামের স্ত্রী। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে মন্নাফ মিয়া বাদী হয়ে ছয়জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। ইতোমধ্যেই পুলিশ একাধিক আসামিকে গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার বাদী পক্ষের লোকজন আসামি ধরতে প্রতিপক্ষের বাড়ি ঘেরাও করে। এনিয়ে দুইপক্ষ দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

অপরদিকে বুধবার (১০ এপ্রিল) সকালে জায়গা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে বিজয়নগর উপজেলার কামালমুড়া গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় বৃদ্ধাসহ ৬জন আহত হন। 

আহতরা হলেন, রাকিব হোসেন (৩৫), শারমিন আক্তার-(২৫), রেহেনা বেগম (৪৫), ময়না বেগম (৮৫) আবদুল বাছির (৯০) ও হীরামণি (১৭)। আহতরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ও চিকিৎসা নেন।

আরও পড়ুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে নারীসহ আহত ৩০

স্থানীয়রা জানান, কামালমুড়া গ্রামের রাকিব হোসেনের সাথে প্রতিবেশি মারুফা বেগমের একটি জায়গা নিয়ে গত ১৫ বছর ধরে  বিরোধ চলে আসছিলো। এলাকার সর্দাররা সরকারি সার্ভেয়ার নিয়ে জায়গা মাপার কথা বললেও মারুফা বেগম জায়গা মাপাতে রাজি হয়নি। 

বুধবার সকালে মারুফা বেগমের লোকজন জায়গাটি দখল করতে গিয়ে সেখানে মাটি ফেলা শুরু করে। এতে রাকিব হোসেন প্রতিবাদ করলে মারুফা বেগমের লোকজন প্রতিপক্ষের উপর হামলা করে। খবর পেয়ে আউলিয়া বাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র থেকে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।

এ ব্যাপারে তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই ইউসুফ গাজী বলেন, জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে ফোন পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। আহতরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

প্রতিনিধি/একেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর