বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ধানের জমি পানির তলায়: মহাসংকটে গোপালগঞ্জের চাষিরা

সুকান্ত কুমার সরকার
প্রকাশিত: ১০ মে ২০২২, ০৫:২৫ পিএম

শেয়ার করুন:

ধানের জমি পানির তলায়: মহাসংকটে গোপালগঞ্জের চাষিরা

‘বৃষ্টি আর জোয়ারের পানি ঢোকার কারণে আমার ২০ বিঘা জমির ধান শেষ হয়ে গেছে। জমি এখনো জলের তলেই রইছে। কোনো কিষেণ (ধান কাটা শ্রমিক) আমার জমির ধান কাটতিছে না। একটা কিষেণরে পাঁচ ভাগের এক ভাগ ধান দিতে হচ্ছে আর খাবার দিতে হচ্ছে তাতেও কিষেণ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আমরা দিশেহারা। হাঁটতিছি কিন্তু হাঁটার বল নাই গায় (শরীরে)। জোয়ারের চাপে ধান পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এহন সর্বশান্ত হয়ে গেছি আমি।’

বৃষ্টিপাত আর জোয়ারের পানি ঢুকে ধানের জমি তলিয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমনটাই বলছিলেন— গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার উজানী ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের কৃষক শুক্রাচার্য বিশ্বাস।  


বিজ্ঞাপন


গোপালগঞ্জ জেলায় উৎপাদিত ধানের একটি বড় অংশ আসে চান্দার বিল নামক একটি বিল থেকে। এই চান্দার বিলটি জেলার মুকসুদপুর উপজেলার উজানী, ননীক্ষীর, জলিরপাড়, কাশালিয়া, সদর উপজেলার সাতপাড় ও কাশিয়ানী উপজেলার হাতিয়াড়া ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে চান্দার বিলের বেশিরভাগ অংশ পড়েছে উজানী ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নে বড় বিল নামে আরও একটি বিল রয়েছে। এক সময় এই বিলটিও চান্দার বিলের অংশ ছিল। বিল বেষ্টিত এসব এলাকার ৯৫ ভাগ মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ধান উৎপাদন। প্রায় ১৫ হাজার পরিবার এসব বিলে এক ফসলি বোরো ধান উৎপাদন করে সারা বছর তাদের সংসার চালায়।

‘আমাদের এলাকায় একটাই ফসল, সেটা হলো এই বোরো ধান। আর এই ধানের ওপর চান্দারবিল ঘোষিত এলাকার সবাই নির্ভরশীল। এখন সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। আমার ২৫ বিঘে জমির ধান পানির নিচে পড়েছে। সরকার যেন আমাদের দিকে একটু খেয়াল করে।’

এ চান্দার বিল ও বড় বিলের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে এমবিআর ক্যানেলের। বিগত কয়েক বছর এমবিআর ক্যানেল থেকে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় এই এলাকার বিলের কৃষি জমিগুলো। প্রতিবছর জোয়ারের পানি প্রবেশের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তবে এবার ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানি মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপদের সম্মুখীন হয়েছে এলাকার মানুষ। 

চলতি বছর এমবিআর ক্যানেল এর জোয়ারের পানি মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রবেশের ফলে তলিয়ে গেছে ওই সব এলাকার প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির ধান। পানি বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ খেতের কাঁচা ও আধা পাকা ধান কাটতে শুরু করেছিলেন অসহায় কৃষকেরা। তবে ধান কাটতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। 


বিজ্ঞাপন


একদিকে বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে জমির ধান নষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে সংকট দেখা দিয়েছে ধান কাটার শ্রমিকেরও। প্রতি বছর ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বাগেরহাটসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা ধান কাটতে আসলেও এ বছর তাদের দেখা মিলছে না। যেসব শ্রমিক এসেছেন তাদের দ্বিগুণেরও বেশি মজুরি দিতে এমন অবস্থায় দিশেহারা কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
gopagonj paddyউজানি ইউনিয়নের অপর এক কৃষক আরিফ উকিল বলেন, ‘চান্দার বিল ও বড়বিলে আমার ১০ বিঘে জমি। প্রতিবছর জোয়ারের পানি এসে এইরকম তলায় যায়। ধান কেটে বাড়ি নিতে পারি না। আধাআধি থাইকে যায়। কিষেণ পাচ্ছি না, কিষেণের দাম অতিরিক্ত। পানির ভেতর দিয়ে বোঝাও মাথায় উঠোনো যায় না। ধান বিক্রি করতি গেলি মন সাড়ে ৬০০-৭০০ টাকার ওপর দেয় না। এতে খুবই দূরাবস্থার মধ্যে আছি।

উজানী ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের কৃষক মিল্টন বিশ্বাস বলেন, পানির নিচে পড়ে ধানে গ্যাজ (শিকড়) হয়ে গেছে। কাইটে বোঝা বইয়ে বাড়িতে নেওয়ার কায়দা (উপায়) নাই নৌকায় ও আসে না। এখন পলিথিনে কইরে পানির ভেতর দিয়ে টাইনে ৩ কিলোমিটার দূরে আনতে হচ্ছে। কিষেণ দিয়ে কাটাইতি যে খরচ আর ধান কাইটে যা নেই তাতে সে খরচের টাকা হচ্ছে না। আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় একটাই ফসল, সেটা হলো এই বোরো ধান। আর এই ধানের ওপর চান্দারবিল ঘোষিত এলাকার সবাই নির্ভরশীল। এখন সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে। আমার ২৫ বিঘে জমির ধান পানির নিচে পড়েছে। সরকার যেন আমাদের দিকে একটু খেয়াল করে।’

উজানী ইউনিয়নের কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমি ৪ বিঘা ধান চাষ করেছি। আমাদের এই চান্দার বিলে একমাত্র বোরো ধানই ফসল আর কোনো ফসল হয় না। বৃষ্টিতে আর জোয়ারের পানি ঢোকার কারণে ধানের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ধানের ওপর দিয়ে গ্যাজ হয়ে গেছে। জোয়ারের পানি না ঢুকলে আমাদের এ রকম ক্ষতি হতো না। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ যাতে বেড়িবাঁধ ও স্লুইসগেট  করে দিয়ে জোয়ারের পানি আসাযাওয়া নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করে দেয়। এ বছর এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

‘গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাল খনন ও তার মুখে স্লুইসগেট গেট করতে পারলে জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এছাড়া বোশের খাল নামে যে খালটি রয়েছে তার পশ্চিম পাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ রয়েছে। এখন খালটির পূর্ব পাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ করতে পারলে বিলের পশ্চিম প্রান্তের জমি জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা পাবে।’

ফরিদপুরের সালতা থেকে ধান কাটতে আসা শ্রমিক মো. আজিজুল শেখ বলেন, ‘এই অঞ্চলের ধান পানিতে তলায় গেছে। ধান কাটতে আমাদের সমস্যা হয়। শুকনা জমি হলে এক বিঘা জমির ধান ৫ জনে কাটতে পারি। কিন্তু পানির নিচে থাকায় ৫ জনে ১০ কাঠার বেশি ধান কাটা সম্ভব হয় না। এতে জমির মালিক ও বাঁচে না আর আমরাও বাঁচি না।’ 

উজানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ শ্যামল কান্তি বোস জানান, এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু  বৃষ্টি আর জোয়ারের পানি কৃষকদের সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, বিলের মধ্য দিয়ে ১৫টি খাল রয়েছে। এ খাল দিয়েই মূলত জোয়ারের পানি বিলে প্রবেশ করে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাল খনন ও তার মুখে স্লুইসগেট গেট করতে পারলে জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এছাড়া বোশের খাল নামে যে খালটি রয়েছে তার পশ্চিম পাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ রয়েছে। এখন খালটির পূর্ব পাড় দিয়ে বেড়িবাঁধ করতে পারলে বিলের পশ্চিম প্রান্তের জমি জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা পাবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. অরবিন্দু কুমার রায় জানান, চান্দার বিলের ওই সব এলাকার জমি নিচু, একবার পানি উঠে গেলে সহজে নামে না। হারভেস্টার মেশিনও সেখানে চলে না। জোয়ারের পানি নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া শ্রমিক সংকট সমাধানের জন্যও চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর