মোবাইল ফোনে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ ভেসে আসে ইংরেজি ভাষায় অনর্গল কথা বলা ২২ বছরের যুবক সুজন পাহানের ভিডিও। ভিডিওতে দেখা যায়, সে দৈনন্দিন জীবনের নানান বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে। তবে ভিডিওতে উঠে আসে তার দরিদ্রতার ছাপ। রয়েছে পরিচর্যার অভাব। সঠিক পরিচর্যা পেলে সে আরও হয়তো ভালো করতে পারবে।
ঢাকা মেইলের প্রতিবেদকের সঙ্গে সরাসরি কথা হয় সুজন পাহানের। কথা বলে জানা যায়, তার দুর্দশার কথা।
বিজ্ঞাপন

ঠাকুরগাঁওয়ের আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের এই সুজন পাহান কিশোরকাল থেকেই অদম্য ইচ্ছা ও শক্তিতে টানাপোড়া জীবনে সংগ্রাম করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। মাঠে ঘাটে কাজ করে ও কোনো প্রকার কোচিং প্রাইভেট বা কোর্স ছাড়াই রপ্ত করেছেন ইংরেজি ভাষায় কথা বলা। পড়াশোনা শেষ করে তার ভালো কিছু করার স্বপ্ন থাকলেও বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক সংকট। অর্থের কারণে তার পড়াশোনার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে।

যে বয়সে খেলাধুলা ও দূরন্তপনা করার কথা ছিল তার কিন্তু সেই বয়সে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব কাঁধে চেপে বসেছে। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হাড়িয়ে একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে অভাবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতেন তার মা দুলালি পাহান। তার পরেও ছেলেকে পড়াশোনা করাতেন তিনি। এভাবে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়াতে সংসারের হাল ধরতে হয় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্র সুজন পাহানকে।
বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া থানা এলাকার আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের সুজন পাহান ও তার মা দুলালি পাহান। অন্যের জায়গায় ঘর করে বাস করেন সেনপাড়া বাগানবাড়ি গ্রামে। প্রথম দিকে তাদের নিজের থাকার ঘরও ছিল না। থাকতেন অন্যের বাড়িতে। এমন এক পর্যায়ে স্বামীকে হাড়ান দুলালি পাহান। মাত্র দুই বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে কাজ করে জীবন সংসার ও ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতেন তিনি। হঠাৎ তিনিও অসুস্থ হড়ে পড়েন। এমন অচলাবস্থায় সংসারের হাল ধর হয় সুজনকে। তখন থেকেই নিজের পড়াশোনা ও মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে মাঠে ঘাটে কাজ করতে হয় সুজনকে। এভাবেই অসাধ্যকে সাধ্য করে বর্তমানে রুহিয়া ডিগ্রী কলেজের বিএ তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে সে। একদিকে সংসার খরচ অন্যদিকে মায়ের চিকৎসা ও নিজের পড়াশোনার খরচ একাই জোগাতে চরম হিমশিমে পড়েছে সে। এমন পরিস্থিতিতে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সুজনের পক্ষে আকাশ সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু সহযোগিতা পেলেই মেধাবী সুজন তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে।

বিসিএস ক্যাডারসহ পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক বা ইংলিশ স্পিকার হওয়ার স্বপ্ন সুজনের কিন্তু অর্থের অভাবে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে ঢাকা মেইলকে বলেন সুজন পাহান। তাই সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চায় সুজন।
ছোট বেলা থেকেই কাজ করে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে সুজন। সে ইংরেজি ভাষায় ভালো কথা বলতে পারে। তাকে আর্থিক সহযোগিতা করলে সে আরও ভালোকিছু করতে পারবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

ফারাজ উদ্দিন নামে স্থানীয় এক মাদরাসার শিক্ষক ঢাকা মেইলকে বলেন, সুজন পাহান অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। একদিকে তার বাবা নেই আবার মাও অসুস্থ্য। তাই তাকেই কাজ করে সংসার চালাতে হয়। তাই সে পড়াশোনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। সে ইংরেজিতে ভালো পারদর্শী। সে মাঠে কাজ করার সময়ও ইংরেজিতে কথা বলে। আমি দেখেছি সে ইংরেজিতে অনলাইনেও টিউশনি করায়। তাকে সহযোগিতা করলে তার পড়াশোনার করতে সহজ হতো ও সে আরও ভাল কিছু করতে পারত।

নজরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, সুজন অনেক মেধাবী। সে কোনো প্রাইভেট বা ইংরেজি কোর্স না করেই নিজের দক্ষতায় ইংরেজি ভালো রপ্ত করেছে। তার মা আগে কাজ করে সংসারের খরচ চালাতো। তার মা অসুস্থ্য হওয়াতে এখন যাবতীয় খরচ তাকে চালাতে হয়। এতে তার পড়াশোনা প্রায় থেমে গেছে। তার সহযোগিতা প্রয়োজন। যদি সরকার বা ধনী ব্যক্তিরা তার পাশে দাঁড়ায় তাহলে তার কষ্টটা একটু হলেও লাঘব হবে ও সে পড়াশোনা শেষ করে ভালো কিছু করতে পারবে। তাতে আমি মনে করি আমাদের দেশের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল হবে।
বর্তমানে সংসারের চাল ডাল কেনার সামর্থ্যই নেই আবার চিকিৎসার খরচ তো আছেই। তাই সন্তানের জন্য সরকারের কাছে চাকরি চান অসুস্থ্য মা। চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারতো ও তার মেধাকে সে কাজে লাগাতে পারবে বলে ঢাকা মেইলকে জানান তার মা দুলালি পাহান।

উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বেলায়েত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আপনি যেটি বললেন ও আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এবং স্থানীয়ভাবে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, তার মূলত থাকার একটি জায়গা প্রয়োজন। মাথা গোজার একটি ঘর হলে ভালো হয়। আমরা এবিষয়ে কাজ করছি। ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের আবাসনের জন্য প্রতিবছর একটি বরাদ্দ আসে। সেই বরাদ্দের মাধ্যমে যেন তার মাথা গোজার ঠায় তৈরি করে দেওয়া যায়। সে ব্যপারে আমরা কাজ করছি। আশা করি এবিষয়ে তাকে আমরা খুব শীঘ্রই সাহায্য করতে পারব।

তিনি আরও বলেন, তার পড়াশোনার বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে সদর উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে কিছু আর্থিক সহায়তা তাকে প্রদান করেছি। আমরা চেষ্টা করেছি তার যে ইংরেজি শেখার আগ্রহ সেটিকে যেন সে অব্যাহত রাখতে পারে। তার জন্য আমরা তাকে একটি উন্নতমানের স্মার্ট ফোন ক্রয় করে দিয়েছি। সেটির মাধ্যমে সে যেন বিভিন্ন অনলাইনের মাধ্যমে কোর্স বা ইউটিউব দেখে আরও ভালোভাবে ইংরেজি শিখতে পারে। এছাড়াও আমরা পড়াশোনার বিষয়ে তার ভবিষ্যত জীবনে যাতে বাঁধা না আসে। তার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ বা পরীক্ষার ফী’র আর্থিক বিষয়গুলিতে তাকে সহায়তা করার কথা জানান তিনি।
প্রতিনিধি/ এজে

