সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বগুড়ার যে গ্রাম ঝুরি গ্রাম নামে পরিচিত

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম

শেয়ার করুন:

বগুড়ার যে গ্রাম ঝুরি গ্রাম নামে পরিচিত

বগুড়া শহর থেকে উত্তরে ১১ কিলোমিটার পথ। গ্রামের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ ঘেঁষে গ্রামটির আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা। এ গ্রামটির নাম চাঁদমুহা। গ্রামের নাম চাঁদমুহা হলেও এটি ঝুরি ভাজা গ্রাম নামেই লোকজনের কাছে পরিচিত। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে বাড়ির উঠানে বাহারি রঙয়ের পাঁপড় ও ঝুরি রোদে শুকাতে দিয়েছেন নারীরা।

গ্রামের বেশিরভাগ নারী জড়িয়ে আছেন পাঁপড় ও ঝুরি তৈরির কাজে। এটাই তাদের পেশা। এই পাঁপড় এবং ঝুরিই তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।


বিজ্ঞাপন


চাঁদমুহা মধ্যপাড়া ও সরলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের শতাধিক পরিবার আলু, গমের আটা ও চাউলের গুড়া দিয়ে পাঁপড় এবং বাহারি রঙের ঝুরি তৈরি করেন। এই গ্রামের আবিদা বেগম নিজে পাঁপড় বানিয়ে বিক্রি করেন। তিনি বললেন, আমরা বছরজুড়েই পাঁপড় ও ঝুরি বানিয়ে বিক্রি করি। তবে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায় বেড়ে যায় এ পণ্যের চাহিদা।

কাঁচা পাঁপড় দেখতে অনেকটা শুকনো রুটির মতো - যা তেলে ভাজলে ফুলে মচমচে হয়। মূলত, পাঁপড় তৈরি হয় চালের আটা ও ময়দা দিয়ে। এরপর মেশানো হয় লবণ, সোডা, বেসন ও রঙসহ মসলা জাতীয় নানান উপকরণ। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই চলে এই পাঁপড় তৈরি।

image-397247-1614473004এক বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, টিনের ছোট্ট একটি ঘর। মাঝখানে বসানো চুলা। সেখানে বসে বাড়ির গৃহিণী রেসমা বেগম পাঁপড় তৈরির উপকরণ মেশাচ্ছেন। এক সময় উপকরণ তৈরি হলো। তারপর হাঁড়ির ওপর পরিমাণমতো পানি নিয়ে তা ফোটানো হলো। ভাপ উঠলে হাঁড়ির ওপর একটি স্টিলের থালা বসিয়ে তাতে গোল চামচে ময়দার মিশ্রণ প্লেটে ঢেলে দিলেন। এরপর থালাটি ঘুরিয়ে মিশ্রণটুকু পাঁপড়ের আকারে গোল করে একটি গামলায় রাখলেন। এগুলো পরে রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পরই তৈরি হয় ভাজার উপযোগী পাঁপড়।

রেসমা বেগম বলেন, শুকনো পাঁপড় তারা শহরে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। প্রতি ১০০ পাঁপড় বিক্রি করেন ১০০ টাকায়। এক বস্তা আটা কেনেন এক হাজার ৫০০ টাকায়। দুই মণ খড়ি কেনেন ৬০০ টাকায়। আরও আনুষঙ্গিক কিছু মসলা দিয়ে দু’হাজার ২০০ টাকা খরচ করে পাঁপড় তৈরি করলে তারা চার হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন।


বিজ্ঞাপন


পাঁপড়ের মতো এ গ্রামের প্রায় একশ' হিন্দু-মুসলিম পরিবার ঝুরি তৈরি ও বেচাকেনা করে সংসার চালান। নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত উভয় পরিবারের লোকজন এ ঝুরি তৈরি করে থাকেন। লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় প্রায় ৪০ বছর থেকে শুরু করে এ পেশায় চলছে তাদের জীবন-জীবিকা। বর্ষাকাল ছাড়া প্রায় সব মাসেই এ ঝুরির ব্যবসা হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে মেলায় এ পণ্যের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জেলা শহর বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, ও ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা থেকে পাইকাররা এসে এই ঝুরি পাইকারি দরে কিনে নিয়ে যান।

বাড়ির পাশে জমিতে ঝুরি শুকাতে দিয়েছেন কারিগর আমজাদ ও মরিয়ম বেগমের পরিবার। ঝুরি শুকানোর জন্য নেড়ে দিচ্ছেন মরিয়ম বেগম। বিভিন্ন রঙের ঝুরি শুকাতে ব্যস্ত তারা। মরিয়ম বলেন, ভোর ৫টা থেকে ঝুরি তৈরির কাজে ব্যস্ত তারা। এটি তৈরি করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়।

Screenshot-2024-02-27-16115প্রথমে আলো চাল ভিজিয়ে তা মেশিনে ভেঙে আটা তৈরি করা হয়। পরে ওই আটা পানিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে তা আরেক মেশিন দ্বারা লম্বা প্যাঁচানো আকৃতির খণ্ড করা হয়। এ খণ্ডাংশগুলোকে তিন দিন রোদে শুকিয়ে তেলে ভাজার পর তা খাবার উপযোগী হয়। অনেকে বালিতেও ভাজে। কিন্তু বালিতে ভাজতে পরিশ্রম বেশি হওয়ায় বর্তমানে তেলে ভাজা হয়।

কথা হয় সরলপুর গ্রামের ঝুরি ব্যবসায়ী হায়দার আলির সঙ্গে। তিনি বলেন, এ গ্রামের জিয়া, লাল, নিলয় চন্দ্রসহ প্রায় একশ' পরিবারের লোকজন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার কোনো জমা-জমি নেই। দীর্ঘ প্রায় ৪২ বছর ধরে তিনি এ ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন এবং সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। ঝুরি তৈরির কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অনেক পরিশ্রম করেন।

তিনি আরও বলেন, ৫০ কেজি আলো চালে ঝুরি তৈরি হয় প্রায় ৪০ কেজি। ৫০ কেজি চাল ২২০০ টাকায় কেনা হয়। পাইকারি প্রতি মণ ঝুরি চার হাজার পাঁচ শ’ টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে। খুচরা প্রতি কেজি ঝুরি ১৫০ টাকা হতে ২০০ টাকা দরে বেচা হয়। পাইকাররা বাড়িতে এসেই এই ঝুরি কিনে নিয়ে যান। তবে বর্তমানে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও পুঁজির অভাবে ঝুরি তৈরির লোকের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ ঝুরি ব্যবসার আরও প্রসার ঘটবে।

গোকুল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রুমি বেগম বলেন, এই ইউনিয়নের প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ পরিবার এই পাঁপড়, ঝুরি তৈরির সঙ্গে জড়িত। গ্রামের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হচ্ছে এ পণ্য প্রস্তুত করে। এখানকার পাঁপড় আর ঝুরির কদর ও চাহিদা থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোক এ গ্রামে আসেন।

প্রতিনিধি/ এমইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর