৪ কোটি টাকার সেতুতে উঠতে লাগে সাঁকো

রোববার (২১ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নড়বড়ে ঝুঁকিপূর্ণ শুকনো বাঁশের সাঁকো বেয়ে নিত্যদিন যাতায়াত করছে মানুষ। মুন্সিগঞ্জের চরকেওয়ার ইউনিয়নের দক্ষিণ চরমসুরা ও চরঝাপটা গ্রামের বাসিন্দারা বেশি ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ দীর্ঘ দিন সেতুটির নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় নিয়মিত যাতায়াতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নানান বয়সী মানুষকে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের অক্টোবরে চার কোটি ২৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৪ ফুট প্রস্থের এ সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় টিএন-এএস আই-এর একটি যৌথ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

গত বছর ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে সংযোগ সড়কসহ নির্মাণকাজ শেষ করে সেতুটি হস্তান্তরের কথা থাকলেও পরে নকশা জটিলতার কারণ দেখিয়ে বিগত বছরের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এরপর নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে দ্বিতীয় দফায় আবারও ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেয় ঠিকাদার। এরপর কয়েক দফা নানান অজুহাতে সময় বৃদ্ধি করা হলেও নির্ধারিত সময়ে হয়নি নির্মাণকাজের সমাপ্তি। এ অধিদফতরের তথ্য বলছে, বরাদ্দকৃত অর্থে সেতুটি ৩৯ মিটার হওয়ার কথা থাকলেও নির্মাণ হয়েছে ৩১ মিটার। দুই পাশের কোথাও প্রস্তুত হয়নি সংযোগ সড়ক। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

বাচ্চু মৃধা নামের স্থানীয় এক ভুক্তভোগী বলেন, প্রতিদিন অনেক কষ্ট করে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে দু’টি গ্রামের বাসিন্দাদের। এ সেতু পার হতে ভয়ে ঘাম ছুটে যায় বয়স্কদের। আর নারী ও শিশুদের ভোগান্তি বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের ভোগান্তি কমানোর জন্য সরকার কোটি টাকা খরচ করে সেতু বানিয়েছে। ঠিকাদাররা সংযোগ সড়ক না করায় সেতুটি আমাদের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেতুর চেয়ে আমাদের আগের বাঁশের সাঁকো ভালো ছিল।

একই অভিযোগ আরও অনেক মানুষের। এ দিন সাঁকো বেয়ে সেতুতে উঠতে না পেরে হামাগুড়ির মতো করে ওই খালে নামেন মুন্নি বেগম নামের এক নারী। সঙ্গে ছিল তার দুই বছরের ছেলে মিনির হোসেন। খালের পূর্বপাশে ছেলেকে মাদরাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। মুন্নি বেগম বলেন, সেতু বানানোর আগে যখন সাঁকো দিয়ে খাল পার হতাম - তখনও এমন ভোগান্তি ছিল না। সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতু বানিয়ে আমাদের মতো নারী ও ছোট শিশুদের আরও বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে। খাড়া সাঁকো বেয়ে সেতুতে উঠতে পারি না। খাল দিয়ে নেমে যেতেও পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। বৃষ্টি হলে সেখানে ঝুঁকি বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ বেশি।

এদিকে সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটি মূল সড়ক থেকে অন্তত ১০ -১১ ফুট উঁচুতে। সেতুর পূর্বপাশের উচ্চতা কাঁচা মাটির সড়ক থেকে অন্তত ১৫- ১৬ ফুট ওপরে। দু’পাশে সংযোগ সড়ক না থাকায় সেতু দিয়ে উঠা-নামা করতে বাঁশ-কাঠ দিয়ে তিনটি খাড়া সাঁকো বানানো হয়েছে। সাঁকো বেয়ে সড়কপথেও যাতায়াত করছে মানুষ।

স্থানীয়রা জানান, ৭-৮ বছর আগেও ঝাপটা এলাকার মানুষদের মেঘনার খালটি নৌকায় করে পারাপার হতে হতো। এরপর এখানে বাঁশের সাঁকো বানানো হয়। ঝাপটা ও দক্ষিণ চরমসুরা গ্রামের চার হাজার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিদিন সাঁকো পার হয়ে মুন্সিগঞ্জ শহরে যাতায়াত করত। 

পরবর্তীতে সেতু নির্মাণ শুরু হওয়ায় খুশি হয় স্থানীয়রা। সেতুটিকে ঘিরে ভাগ্য পরিবর্তন ও জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন অনেকে। তবে দীর্ঘ দিন নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় হতাশ অধিকাংশ মানুষ।

তাদের অভিযোগ, সেতুতে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগ সড়ক না করায় বাঁশের সাঁকো দিয়ে সেতু পারাপার হতে হচ্ছে। বাঁশের সাঁকোতে উঠতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। সাঁকো থেকে পড়ে গিয়ে কয়েকজন হাত ভেঙেছেন। দুধ, ডিম ও কৃষিপণ্য নিয়ে সাঁকো থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন অনেকেই। এ কারণে সংশ্লিষ্টদের শীঘ্রই নির্মাণকাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

অন্যদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রফি উদ্দিন আহম্মেদ ফেরদৌস জানান, শীঘ্রই ফের শুরু হবে নির্মাণকাজ, তবে কেন দীর্ঘ দিন ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

তবে চরকেওয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়েও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ শেষ করেনি। বিগত বছর বর্ষার পরে সংযোগ সড়ক করে দেওয়ার কথা ছিল, তারা কোনো কাজ করছে না। সরকারের কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সেতুটি করা হয়েছে। ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে মানুষ সেতুর সুফল পাচ্ছে না। উল্টো দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। স্থানীয়দের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

তবে শীঘ্রই নির্মাণকাজ শেষ করার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর এলজিইডি'র প্রকৌশলী মো. শফিকুল আহসান। একইসাথে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে সেতুর কাজ বুঝিয়ে দিতে পারছে না। আমরা তাদেরকে কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। তারা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছিল। এরপরেও সেতুটি বুঝিয়ে দিতে পারেনি। ফের যোগাযোগ করা হলে তারা এক সপ্তাহের সময় নিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি অনুসারে চুক্তিপত্র বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিনিধি/ এমইউ