রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

গাজীপুরে ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় মানুষের ঢল

জেলা প্রতিনিধি, গাজীপুর
প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

গাজীপুরে ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় মানুষের ঢল

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইলে প্রতি বছর  মাঘের প্রথম দিন বসে মাছের মেলা।  ঐতিহ্যবাহী এ মেলা এলাকায় জামাই মেলা নামে বিখ্যাত।

এদিন মেলা থেকে মাছ কিনে জামাইরা  শ্বশুরবাড়িতে যান। মেলায় জামাই-শ্বশুরদের মাঝে চলে বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতা। এবার মেলাকে ঘিরে এলাকায় উৎসবে মেতে ওঠেছে সাধারণ মানুষ। মাছ ছাড়াও বসেছে হরেক রকম পণ্যের পসরা। 


বিজ্ঞাপন


আয়োজকরা বলছেন, একদিন ব্যাপী এ মেলায় অন্তত দুই কোটি টাকার মাছ কেনা বেচা হয়। আর দেশি-বিদেশি মাছ কিনতে বিভিন্ন জেলার মানুষ ভিড় করেন এখানে।

সরেজমিনে মেলায় ঘুরে দেখা গেছে, নেই মাইকিং, কোন ধরনের প্রচারণা। তারপরও লোকমুখে শুনে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও জামাই মেলায় আসছেন শত শত মানুষ।  প্রায় আড়াইশ বছর ধরে উপজেলার জামালপুর, জাঙ্গালীয়া ও বক্তারপুর ইউনিয়নের বিনিরাইলে বসে  ঐতিহ্যবাহী এ জামাই মেলা। নামে জামাই মেলা হলেও মূলত এখানে বিক্রি হয় ছোট- বড় দেশি-বিদেশি, সামুদ্রিক নানা পদের মাছ। মেলা উপলক্ষে সকাল থেকেই সহস্রাধিক দোকানে মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন মাছ বিক্রেতারা। মেলায় চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। সামুদ্রিক চিতল, বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, কালিবাউশ, পাবদা, গুলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা, রূপচাঁদা, শাপলা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশী মাছ। বড় আকারের মাছকে ঘিরেই জটলা  বেশি ক্রেতাদের।  জামাই-শ্বশুরদের মধ্যেও হয় সে মাছ কেনার নীরব প্রতিযোগিতা ।

বিক্রেতারা বলছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা মেলায় মাছ বিক্রি করতে এসেছেন। এখানে উৎসবের আমেজে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে ক্রেতারা মাছ কিনেন। বেচা বিক্রিও ভালো।

এ মেলায় মাছ ভেদে ৫০০-১৬০০ টাকা কেজি দরে বেশির ভাগ মাছ বিক্রি করতে দেখা গেছে।


বিজ্ঞাপন


তবে দিনব্যাপী এ মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিল লক্ষাধিক টাকা মূল্যের ৭০ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ।এই বাঘাইড় মাছকে ঘিরে ক্রেতাদের জটলা লেগে থাকে। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় এক জামাই মাছটির দাম সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার টাকা বলেন। কিন্তু বিক্রেতা আরও বেশি দাম পাবার আশায় মাছটি ছাড়েননি। পরে চলে দর কষাকষি। যত না ক্রেতা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভিড় জমান মাছটি দেখার জন্য।

মেলায় গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছেন। মাছের সঙ্গে মেলায় খেলনা, মিষ্টি, বস্ত্র, হস্ত ও কুটির শিল্পের নানা পণ্যের হাট বসেছে। ছোট বড় নানা পদের মাছের ঠাঁই হয়েছে মেলায়। মেলায় শুধু জামাইরা মাছ কেনেন নি, বিভিন্ন বয়েসী নারী, পুরুষ ক্রেতা মাছ কিনতে ভিড় করছেন।আর এসব দেশি-বিদেশি মাছ সাশ্রয়ী দামে কিনতে পেরে খুশি এখানে আসা ক্রেতা ও দর্শন্যার্থীরা।

মেলায় নানা ধরণের মাছের পাশাপাশি হরেক রকম মিষ্টি বিক্রি হয়। প্রতি কেজি মিষ্টি ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে ছিল। ১ কেজি ওজনের বালিশ আকৃতির মিষ্টি বিক্রি হয় ৫০০ টাকায়। এ ছাড়া মেলায় কাঠ ও স্টিলের আসবাবপত্র, ফল, খেলনা, নানা ধরনের আচারসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য বেশ কিছু আয়োজন ছিল।

কথা হয় মেলায় আসা কাপাসিয়া থেকে আসা আশরাফ নামে এক দর্শনার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বহু বছরের পুরনো এই মেলা দেখার ইচ্ছা ছিল। শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে, আমিও এসেছি। মেলাই ঘুরছি, কিছু মাছ শ্বশুর বাড়ির জন্য কিনে নিয়ে যাব।’

কথিত আছে, পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে আঠার শতকে মেলার প্রচলন হয়। মাছ মেলা হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়। প্রতি বছর মেলা কেন্দ্র করে বিনিরাইল ও আশপাশের কয়েক গ্রামের শ্বশুররা তাদের মেয়ে- জামাতাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানান। মেয়েরা স্বামীদের নিয়ে বাবা বাড়িতে বেড়াতে আসে। জামাইরা মেলা থেকে মাছ কিনে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যায়। তাই এ মেলা জামাই মেলা নামে পরিচিতি পায়।

fs-ss

বিনিরাইল মেলা প্রাঙ্গণের আশপাশের স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ জানান, উপজেলার জাঙ্গালিয়া, বক্তারপুর, জামালপুর ও মোক্তারপুর ইউনিয়নের মোহনায় বিনিরাইল গ্রামে বসে এই মাছের মেলা। প্রায় ২৫০ বছর ধরে কৃষকের ধান কাটার পর ওই জমিতে স্থানীয়রা এ মেলার আয়োজন করে। মেলার প্রধান আকর্ষণ বিশাল আকৃতির মাছ। প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষে মাঘ মাসের প্রথম দিনে এ মেলা বসে। নদী ও সাগরের বড় বড় মাছ, মিষ্টি, ফার্নিচার, তৈজসপত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি হয় এ মেলায়। প্রশাসনের কঠোরতায় জুয়া বা অশ্লীল আয়োজনের সুযোগ নেই। তবে মেলায় ইচ্ছামতো টোল আদায় ও কিছু অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে।

নেই টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা

মেলায় বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটলেও তাদের জন্য নেই কোন টয়লেট। এতে বিরম্বনায় পড়েন নারী ও বয়োবৃদ্ধরা। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির অভাবে ভোগান্তিতে পড়েন নানা বয়সী মানুষ। সরু, কর্দমাক্ত আইল দিয়ে মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে অনেকেই তীব্র অসন্তোষ  প্রকাশ করেন।

মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি কিশোর আকন্দ বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন কালীগঞ্জের ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত। মেলায় আগত ক্রেতা বিক্রেতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে । কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এলাকার তরুণ, মুরুব্বি ৫ শতাধিক মানুষ এখানে ভলেন্টিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

আয়োজক কমিটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একদিনের এই মেলায় অন্তত দুই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। শুধু মাছ কেনা বেচা নয়, মেলাটি এখন এই এলাকার কৃষ্টি, ঐতিহ্য বহনের পাশাপশি এলাকাবাসির উৎসবে পরিণত হয়েছে।

প্রতিনিধি/একেবি
 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর