শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ছেলেটারে বেচে দিলি কাজকাম করে খাতি পারব সত্যি, কিন্তু মন তো পুড়বি

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল ২০২২, ০৮:৪৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ছেলেটারে বেচে দিলি কাজকাম করে খাতি পারব সত্যি, কিন্তু মন তো পুড়বি


ঈদের বাকি মাত্র দুই থেকে তিনদিন। এসময় পরিবার পরিজন এবং সন্তানদের জন্য সামর্থ্যের মধ্যে নতুন নতুন জামা-কাপড় কিনতে ব্যাস্ত বাবা-মায়েরা। আর সেই সময় অভাবের তাড়নায় কোলের ছোট্ট শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছেন মা আয়েশা খাতুন।

আয়েশা খাতুন(২২) কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভার নওদাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। প্রতিবেশীর কাছ থেকে বিষয়টি জেনে আজ শুক্রবার দুপুরে আয়েশার বাড়িতে যান এ প্রতিবেদক। দুই সন্তানের জননী আয়েশা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।


বিজ্ঞাপন


আয়েশার মা এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আয়েশা খাতুনের বাবা নেই। ভাই মনিরুল দিনমজুর। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে। এ অবস্থায় ২ বছরের মেয়ে রাবেয়া ও ১৩ মাসের ছেলে ইব্রাহিমসহ আয়েশাকে তার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন স্বামী বিপ্লব। মায়ের বাড়িতে এসে উঠেছেন। মায়ের অভাবের সংসারে যুক্ত হয়েছে আরও তিনটি ক্ষুধার্ত মুখ। 

জানা গেছে, ২০১৭ সালে ভেড়ামারা পৌরসভার নওদাপাড়া এলাকায় মৃত সিরাজ ইসলামের মেয়ে আয়েশা খাতুন এর সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মিরপুর উপজেলার বহলবাড়িয়া ইউনিয়নের বহলবাড়িয়া সেন্টার এলাকার মো. রিপনের ছেলে বিপ্লবের। 

আয়েশার মা মনোয়ারা খাতুন জানান, আয়েশার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। অভাবের কারণে ছোট থাকতেই আয়েশাকে বিয়ে দেওয়া হয়। যৌতুকের দাবিতে আয়েশাকে তার স্বামী এবং শ্বশুর ঘর থেকে বের করে দেন। মনোয়ারা তখন বিভিন্ন জনের কাছে ধার কর্জ করে আয়েশা ও তার স্বামীর জন্য এক কক্ষের একটি টিনের ঘর করে দেন। ঘরের পর স্বর্ণের চেইনের জন্য আয়েশার ওপর শুরু হয় নির্যাতন। স্থানীয়ভাবে অনেকবার বিচার-শালিস হয়েছে। সমাধান হয়নি। 

মনোয়ারা বলেন, ‘ছয় মাস আগে আয়েশাকে স্বামী তাড়িয়ে দেয়। দুই সন্তানসহ আয়েশা আমার বাড়িতে উঠেছে। আমার ছেলে দিনমজুরি করে খায়। আমি পরের বাড়িতে কাজ করি। আয়েশা ও তার দুই সন্তান নিয়ে কোনোরকম জীবন ধারণ করছি। অভাবের জন্য পাড়ার অনেকে ছোট ছেলে ইব্রাহিমকে বেচে দিতে বলছে। তাহলে আয়েশা কাজ করতে পারবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আয়েশা রাজি হয়েছে। ছেলে বিক্রি করতে হবে বলে কান্নাকাটি করছে। ছেলের বয়স দুই তিন বছর হলে মেয়ের কাছে রেখে (কাজে) যেতে পারত।’ 


বিজ্ঞাপন


প্রতিবেশী এক গৃহবধূ বলেন, ‘আয়েশার মা ও ভাই ঋণের বোঝা নিয়ে চলছে। এর ওপর আয়েশাসহ তার দুই সন্তান এসেছে। স্বামী আর নিবে না। তাই কাজ করে তো খেতে হবে। কোলের সন্তানের জন্য সে কাজে যেতে পারছে না। পাড়ার অনেকে বলছে সন্তান বিক্রি করে দিতে। শুনেছি আয়েশা সন্তান বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ 

সন্তান বিক্রি করতে চান কি না জানতে চাইলে আয়েশা খাতুন বলেন, ‘দুই বছরের মেয়েকে বাড়িতে রেখে না হয় কাজে যাব, কিন্তু কোলের ১৩ মাস বয়সের ছেলেকে কার কাছে রাখব। কোলের সন্তানটার কারণে কাজে যেতে পারছি না। সে জন্য পাড়ার অনেকেই বলছে ইব্রাহিমকে বিক্রি করে দিতে। তাই বিক্রির কথা চিন্তা ভাবনা করছি।’ 

আয়েশা আরও বলেন, ‘দুইটা ছোট সন্তান নিয়ে কীভাবে চলব? মা ও ভাইয়ের ঘাড়ে বসে আর কত দিন খাব! ভাই দিনমজুর ও মা পরের বাড়িতে কাজ করে নিজের পেটের ভাত জোগাড় করে। এদেরই চলে না। আমার ও দুইটা বাচ্চার ভরণ পোষণ কীভাবে চালাবে বলেন।’ 

কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে আয়েশার। কান্নায় কণ্ঠ বুজে আসে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আয়েশা বলেন, ‘বেচে দিলি কাজকাম করে খাতি পারব সত্যি, কিন্তু বাড়ি এসে ইব্রাহিমের জন্যি মন পুড়বি। যে খাবার নিয়ে আসব তা আমার মুখে উঠবে না, আবার আমি শান্তিও পাব না। এ অবস্থায় কী করব এখন!’ 

আয়েশার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীনেশ সরকার বলেন, ‘ঘটনাটি আমার নজরে আসেনি। বিষয়টি মাত্রই জানলাম। এটা একেবারেই অমানবিক।’ এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে উপজেলা প্রশাসন পরিবারটির পাশে থাকবে বলে আশ্বাস দেন ইউএনও।

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর