শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

আজ ২৯ এপ্রিল:  উপকূলে শোক ও বেদনার দিন

তাহজীবুল আনাম
প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল ২০২২, ০৭:৫২ এএম

শেয়ার করুন:

আজ ২৯ এপ্রিল:  উপকূলে শোক ও বেদনার দিন
ছবি : সংগৃহীত

ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ। স্বজনহারাদের আঁতকে ওঠার দিন। এখনও স্বজনরা ডুকরে ডুকরে কাঁদে প্রিয়জনের স্মরণে। গণহারে কবর হয়েছিল, লাখে লাখে মরেছে মানুষ। মানুষের লাশ আর লাশ ভেসে এসেছে সেদিন। 

১৯৯১ সালের এদিনে দিনগত মধ্যরাতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে ১২ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় জ্বলোচ্ছাসে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় 'হারিকেন'। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। নদী-নালা, ডোবায়, খাল-বিল, সমুদ্রে ভেসেছিল মানুষের লাশ আর লাশ। গরু, মহিষ, ভেড়ার মরদেহের স্তুপ যেন ভয়াল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই আঘাতের নিদারুণ দৃশ্য। প্রাকৃতিক দূর্যোগের এতোবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো সম্মুখীন হয়নি।
 
পরদিন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলীলা দেখে। কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিল জাতি। স্বজনহারানোর অস্থিরতায় বোবা কান্নায় ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলো সমগ্র দেশ।

বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম। ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে আনুমানিক ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি। মারা যায় ২০ লাখ গবাদিপশু। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ।

উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি। প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ৩১ বছর পার হতে চলেছে। এখনও স্বজনহারাদের আর্তনাদ থামেনি। গৃহহারা অনেক মানুষ এখনও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি। কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপকূলবাসী এখনও অরক্ষিত, তার সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এখনও বিভিন্ন স্থানে খোলা রয়েছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। ফলে বিভিন্ন উপকূলীয় লোকালয়ে সাগরের লোনাজল এখনো প্রবেশ করছে।

কক্সবাজারের উপকূলে অনেক গ্রাম ২৯ এপ্রিলের স্মৃতি বহন করছে এখনও। অনেক ঘরবাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি, গাছ-পালা, পথ-ঘাট যেন সেদিনের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিলীন হয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধ উঁচু করে নির্মাণের পাশাপাশি উপকূল সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। 


বিজ্ঞাপন


coxsbazar

প্রতিবছর এ দিনটি  উপলক্ষে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সামাজিক -সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকেন। স্বজনহারা মানুষগুলোর ঘরে ঘরে  দোয়া ও মোনাজাত হয়। 

কক্সবাজারের মহেশখালীর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফ বাদশা জানান, গত ৩১  বছর ধরে তার এলাকায় ৮ কিলোমিটার বেড়িঁবাধ খোলা রয়েছে।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার গোস্মামী জানান, কক্সবাজারের ৫৯৬ কিলোমিটার বেড়ি বাধেঁর মধ্যে ৮ শ মিটার এখনও খোলা। ঝুঁকিপুর্ণ অবস্থায় রয়েছে ১৭৩০ মিটার। তবে ১১টি পয়েন্ট দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে ও জানান তিনি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলের জেলে, লবণ চাষী ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলো চরম বিপাকে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার উপকূলীয় সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হোবাইব সজীব। 

১৯৯১ সালের ওই দিনে সবচেয়ে বেশী প্রাণহানি ঘটে কক্সবাজারের মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নে। এ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান কামরুল হাসান জানান, এখানে এমন কোনো বাড়ি বা ঘর নেই যে বাড়ি থেকে ৫-৬ জন লোক মারা যায়নি। তাই ২৯ এপ্রিল আসলে এখনও প্রতিটি বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়।

ধলঘাটা সরওয়ার কামাল জানান, ১৯৯১ সালের পর থেকে ধলঘাটা এলাকার বেড়িবাঁধ এখনও খোলা রয়েছে।

কুতুবদিয়া দ্বীপের বাসিন্দা ছৈয়দ আলম ওই রাতের স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, সে ভয়াল রাতের কথা মনে পড়লে চোখে পানি চলে আসে। সেই রাতের কথা কোনোভাবেই ভুলে যাওয়ার নয়। সেই  উপকূল এখনো অরক্ষিত।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বেশি ক্ষতি হয় মহেশখালীর ধলঘাটা ও মাতারবাড়ী এই দুই ইউনিয়নে।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের পর বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে ৮৪টি সাইক্লোন শেল্টার (আশ্রয়কেন্দ্র) স্থাপন করা হয়েছে। এ সব আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের পর থেকে রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের অভাবে প্রায় ৩৩টি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েকটি নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। মহেশখালী উপজেলার বর্তমান প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের বসবাস হলেও জনসংখ্যা অনুপাতে আশ্রয়কেন্দ্রর সংখ্যা কম।

কক্সবাজার (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মহেশখালী-কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় জনগণের জানমাল রক্ষার্থে বেড়িবাঁধের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। তবে ধলঘাটা, মাতারবাড়ি ও কুতুবদিয়ায় যেসব বেড়িবাঁধ অরক্ষিত রয়েছে, আগামীতে সেগুলো পুনঃর্নিমাণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ সরকারের আমলে বেড়িবাঁধের উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বলেই আজ দলঘাটাও মাতারবাড়ি দ্বীপে কয়লা বিদ্যুতের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

মহেশখালী দ্বীপে বাস্তবায়নাধীন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, এক্সক্লুসিভ টুরিস্ট জোন ও প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং উপকূলে বসবাসকারীদের জানমাল রক্ষার্থে আগামীতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান সংসদ সদস্য।

এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর