সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

এক রোল নম্বরে পরীক্ষা দিয়ে আরেক নম্বরে ফল প্রকাশ!

জেলা প্রতিনিধি, শেরপুর
প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৪০ পিএম

শেয়ার করুন:

এক রোল নম্বরে পরীক্ষা দিয়ে আরেক নম্বরে ফল প্রকাশ!

ময়মনসিংহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি প্রবেশপত্রে যে রোল নম্বর নিয়ে পরীক্ষার হলে বসেছিল শিক্ষার্থীরা ফলাফলের আগে পাল্টে গেছে সেই রোল। এতে ফলাফলও পরিবর্তন হয়ে গেছে দাবি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের।

এমন হতাশাজনক ফলাফলের কারণে মেধাবী কোনো শিক্ষার্থী যদি অনাকাঙ্খিত বড় কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে! কে নেবে এর দায়? এমন প্রশ্ন অভিভাবকসহ সর্বসাধারণের। এজন্য ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরেরা বিচার দাবি করেন সংশ্লিষ্ট দফতর প্রধানদের। কিন্তু বোর্ডের দাবি এটা অনিচ্ছাকৃত ভুল।


বিজ্ঞাপন


২০২৩ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু অনলাইনে আমার রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে সার্চ দিলে প্রথমে মো. সাজু মিয়া নামে একজনের তথ্য আসে। তখন ভেবেছিলাম রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ভুল দিয়ে সার্চ করেছি। পরে আমার রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র সঠিকভাবে দেখে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও বার বার মো. সাজু মিয়ার তথ্যই দেখানো হয়। এমতাবস্থায় আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়! মাথা ঘুরতে থাকে। তখন মাথায় কোনো কাজ করছিল না, চোখে যেন সর্ষেফুল দেখছিলাম। চেষ্টার একপর্যায়ে সকল নির্দেশনা মোতাবেক আমার রোল, রেজিস্ট্রেশনসহ প্রয়োজনীয় সকল তথ্য দিলেও ফলাফল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রিজেক্ট দেখানো শুরু হয়! এতে আমি যেন পাগল প্রায় অবস্থায় চলে যাই। হতাশ হয়ে পড়েন বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই।

আমিতো রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র দেখেই আমার সবতথ্য দিচ্ছি। এরপরেও কেন আমাকে ফলাফল রিজেক্ট দেখানো হচ্ছে? পরিক্ষা ঠিকঠাক ভাবেই দিয়েছি। শতবার চেষ্টা করেও যখন আমি আমার ফলাফল দেখতে ব্যর্থ হই। তখন বাবা-মায়ের কথা মোতাবেক বাধ্য হয়ে আমাদের কলেজের (সরকারি আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ) স্যারদের কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারি ফলাফলের আগের দিন (২৫ নভেম্বর) আমার রোল নম্বর নাকি পরিবর্তন করা হয়েছে! স্যারেরা আমাকে বলেন, তোমার রোল নম্বর ৪০২১৩৫ এর পরিবর্তে ৭০২১৩৫ দিয়ে চেষ্টাকরে দেখ। অবশেষে স্যারদের কথা অনুযায়ী আমার পরীক্ষার রোল নম্বরের শুরুর সংখ্যা ৪ এর স্থলে ৭ বসিয়ে চেষ্টা করলে আমার ফলাফল (জিপিএ ৩.৫০) দেখায়। তাতে আমার যে ফলাফল দেখানো হয়, এটা অকল্পনীয়। এমন ফলাফল আমাদের কোনো বন্ধু-বান্ধবের হতে পারে না; আমাদের কারও এমন ফলাফল হওয়ার কথা নয়।

বলছিলাম ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী সরকারি আনন্দমোহন কলেজ থেকে ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া শেরপুরের নকলা উপজেলার পৌরশহরের গ্রীণ রোডের শিক্ষার্থী গোলাম আহমেদ লিমনের কথা।

লিমন বলেন, তার বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজের উপজেলা শহরের সরকারি ও জেলার বেশ কয়েকটি সনামধন্য সরকারি-বেসরকারি কলেজ রেখে ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হই। দীর্ঘ দু’টি বছর সব ঠিকঠাক চলছিল। সুন্দরভাবে সবকয়টি বিষয়ের পরীক্ষা আশানুরূপভাবে শেষ করেছিলাম। আশায় বুক বেধে ছিলাম এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ-৫ পাব। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য কোচিং করাসহ অন্যান্য সকল প্রকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু ফলাফলের দিন থেকে আমার স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। হতাশ হয়ে পড়েন বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই।


বিজ্ঞাপন


লিমনের মতো অনেক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানায়, তাদের কলেজের শিক্ষকদের কাছে এমন ঘটনার প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করলে শিক্ষকরা বিষয়টি না বুঝিয়ে উল্টা তাদের সঙ্গে রাগারাগি করেন, এমনকি অনেকের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন বলেও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানায়।

কেন এমন হলো? বাংলাদেশের শিক্ষা জগতের ইতিহাসে এটাই হয়তোবা প্রথম ঘটনা যে, এক রোল নম্বর দিয়ে সকল পরীক্ষার খাতার ওয়েমার সিট পূরণ করে পরীক্ষা শেষ করার পরেও ফলাফলের আগের দিন রোল নম্বর পরিবর্তন করা হয়! আর এমন অবাককরা কাণ্ডের তথা ফলাফলের আগের দিন রোল নম্বর পরিবর্তনের বিষয়টি ফলাফল প্রত্যাশীরা কেউই জানতো না।

কারও বুঝে আসছে না- কোনো পরীক্ষার্থী তার প্রবেশপত্র মোতাবকে রোল নম্বর দিয়ে সকল পরীক্ষার খাতার ওয়েএমআর সিট পূরণ করে পরীক্ষা শেষ করার পরে, ফলাফলের আগের দিন ওই রোল নম্বর পরিবর্তন করাকি আদৌ সম্ভব? নাকি এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে? নাকি নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সরকারের সুমাননষ্ট করার লক্ষ্যে কোনো অসাধু চক্র এতে কাজ করেছে? এমন প্রশ্ন ফলাফল প্রত্যাশী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ অনেকের।

একই ঘটনা ঘটেছে, ভালুকা উপজেলার মর্নিং সান স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ফলাফলের আগের দিন পরীক্ষার রোল নম্বর পরিবর্তনের চক্করে পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর ফলাফলে অকৃতকার্য দেখানো হচ্ছে। এমন ঘটনায় হতাশ হয়ে কোনো উপায় অন্ত নাপেয়ে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা। ফেইসবুকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখায়ায় মর্নিং সান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আন্দোলন করছেন। আর উপজেলা চেয়ারম্যান আন্দোলনকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নির্বাক বসে আছেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ জুয়েল (শর্টনাম) সহ অন্যান্য শিক্ষকরা।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা বিচার দাবি করেন সংশ্লিষ্ট দফতর প্রধানদের কাছে। শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে কেন এমন খোলায় মেতে উঠা হলো! এর সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবীও জানান তারা।

এ বিষয়ে গোলাম আহমেদ লিমন বলে, সরকারি আনন্দমোহন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট কলেজ শাখার অধ্যক্ষ কৃষ্ণ কান্ত স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি নিজের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্যারকে জানাতে বলেন। পরে অধ্যক্ষ স্যারের কথামত লিমন তার মা ও বড় ভাইকে নিয়ে নকলা ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিনেরর সঙ্গে দেখা করে সকল তথ্য উপস্থাপন করলে তা দেখা তিনি রীতিমত অবাক হয়ে যান। দ্রুত সময়ের মধ্যে আনন্দমোহন কলেজে গিয়ে ভুল সংশোধনের আবেদন করতে বলেন এবং এতে প্রয়োজনে তিনি অধ্যক্ষকে ফোন দিয়ে বলে দেওয়ার আশ্বাস দেন।

ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বোর্ডের অধীনে চার জেলায় ২৮৬টি কলেজের ৭৫ হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। বোর্ডে পাসের হার ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মোট পাস করে ৫৩ হাজার ৪২৬ জন। মানবিক বিভাগে পাস করেছে ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ।

শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মো. সামছুল ইসলাম বলেন, আট হাজারের মতো শিক্ষার্থীর রোলনম্বর ডুপ্লিকেশন হয় প্রযুক্তিগত ক্রটির কারণে। এটা আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভুল। পরে বিষয়টি তদারকি করে নতুন রোলনম্বর দিয়ে প্রবেশপত্র দেওয়া হয়। রোল নম্বর পরিবর্তনের সঙ্গে ফলাফলের কোনো সম্পর্ক নেই।

ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. গাজী হাসান কামাল বলেন, নিজস্ব জনবল না থাকায় প্রযুক্তিগত ক্রটির কারণে এমনটি হয়েছে। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। প্রবেশপত্র পরিবর্তনের কারণে অকৃতকার্য হয়েছে এমন অভিযোগ অমূলক।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর