সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

খেজুর রস সংগ্রহে গাছিদের ব্যস্ততা, চাঙা অর্থনীতি

আমানুল্লাহ আমান, রাজশাহী
প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৪ এএম

শেয়ার করুন:

খেজুর রস সংগ্রহে গাছিদের ব্যস্ততা, চাঙা অর্থনীতি

কমছে তাপমাত্রা, উঁকি দিচ্ছে শীত। এরইমধ্যে উত্তরের জেলা রাজশাহীতে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে গাছিদের। প্রতিদিন ভোরে বেরিয়ে পড়ছেন রস সংগ্রহে। রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন রাজশাহীর ৪ উপজেলার অন্তত ৫০ গ্রামের মানুষ। এতে চাঙা গ্রামীণ অর্থনীতি। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, অসাবধানতায় এ রসেই ঘটতে পারে জীবনের ইতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শীতকালে খেজুর রস ও গুড়ের জন্য জেলার পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাঘা ও চারঘাট উপজেলা ইতোমধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছে। রাজশাহীর প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের সংসার চলছে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে। প্রায় ৫৪৩ হেক্টর জায়গাজুড়ে রয়েছে খেজুর গাছ। জেলায় বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা ১১ লাখ ১১ হাজার ৩৪৩টি। রস ও গুড় থেকে গত মৌমুমে ১৪১ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা আয় করেন এখানকার গাছিরা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি বিভাগ জেলায় গুড় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৮ হাজার ৮৯১ মেট্রিক টন। এবছর ১৪৬ কোটি ৬৯ লাখ ৫২ হাজার ১০০ টাকা আয় হতে পারে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।


বিজ্ঞাপন


গাছিরা বলছেন, রস ও গুড়ের উপার্জন দিয়ে বছরের ৬ মাস তাদের সংসারের যাবতীয় খরচ মেটে। বাড়তি টাকা থেকে অন্য মৌমুমি ফসলও উৎপাদন করছেন তারা। রসে অতিরিক্ত জাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়।

গাছ২

৪০ বছর ধরে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করে বিক্রি করছেন আফসার মোল্লা। জেলার পুঠিয়া উপজেলায় তার বসবাস।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আফসার মোল্লার স্ত্রী টিনের বস্তুতে রস জাল দিচ্ছেন। পাশে নির্দেশনা দিচ্ছেন স্বামী। প্রতিদিন ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এটা তাদের রুটিন ডিউটি।


বিজ্ঞাপন


আফসার মোল্লা বলেন, আমি ১২০-১৩০টা গাছ কাটি। পয়সাডা পাওয়া যায় ভাল, নতুন নতুন পয়সা প্রতি হাটে আসে। অন্য মৌসুমে কিছু ফসল পানি করি, এতে চলে যায় আমার।

সাইফুল ইসলাম নামে আরেক গাছি বলেন, আমি রস দিয়ে গুড় করি। সংসার ভালমতো চলে। এটা দিয়ে কিস্তি-মিস্তি দিতে পারি।

গছি_ঁ_হাড়ি

হাবিবুর রহমান নামে আরেকজন কৃষক বলেন, মৌসুমি আবাদ করার ট্যকা-পয়সা হয়। ওই ট্যাকা দিয়্যা আবাদ করা হয়। ওই ট্যাকা দিয়্যা, সঞ্চয় কইর‌্যা, জড়ো কইর‌্যা ধান, পেঁয়াজ-টেয়াজ এসব করি।

আব্দুল মান্নান নামে আরেকজন বলেন, ৫০-৫৫ হাজার এরকম ট্যাকা আয় আসে, খরচ-বরজ বাদ দিয়ে। সংসার চলে ভালই, এ শীতের ৬ মাস।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিবছর শীতকালে গ্রামীণ জনপদে তৈরি হয় রস উৎসব। পরিবার-পরিজন নিয়ে রস পান করে থাকেন তারা। রসে তৈরি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করেন স্বজনদের। এছাড়া খেজুর গুড়ের বাহারি রকমের পিঠা-পায়েশ খাওয়ার ধুম পড়ে এ অঞ্চলে।

মোছা. জুনকি বেগম নামে এক নারী বলেন, এ রস দিয়ে আমরা অনেক পিঠা-পুলি তৈরি করি। এ শীতের সময় আমরা একটা উৎসব পালন করি। এ উৎসবে আমরা পিঠা-পুলি তৈরি করে জামাইকে খাওয়াই। এ খেজুরের গুড় দিয়ে অনেক ধরনের পিঠা-পুলি আমরা তৈরি করি। যেমন- দুসচিতই, ক্ষিরপুলি, জামাইমুখী ও কন্যামুখী এরকম পিঠা আমরা অনেকটাই তৈরি করে আমাদের জামাইকে খাওয়াই এবং এতে আমরা খুব আনন্দ পাই।

গাছি

শাহাদ আলী নামে আরেকজন বলেন, আমরা সেভাবে বুইল্যা (বলে) রাখলে, রসওয়ালা বাড়িতে পৌঁছে দেয়। আমরা সেভাবে রসটা খাই।

তথ্য বলছে, এ বছরের জানুয়ারিতে রাজশাহীর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) এক অবহিতকরণ সভার আয়োজন করে। এতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষক ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। ওই সভায় জানানো হয়, শীতকালে খেজুর রস থেকে ঘটতে পারে মারাত্মক বিপদ। বাদুড়ের মুখের লালা থেকে খেজুরের রসে একটি ভাইরাস আসে। এটির নাম নিপা ভাইরাস। বাদুড়ে মুখ দেওয়া রস পান করলে মানুষ নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা প্রবল। এতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে দু’ধরনের রোগ হয়ে থাকে। কমিউনিকেবল ডিজিজ বা সংক্রামক রোগ ও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি) বা অসংক্রামক রোগ। খেজুর রস থেকে হতে পারে মরণঘাতি নিপা ভাইরাস। যেটি সংক্রামক ব্যাধি। অর্থাৎ একজনের থেকে আরও অনেকের কাছে ছড়াতে পারে।

গাছি৩

তথ্যমতে, দেশে প্রথম মহামারি করোনা শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ই মার্চ। আর ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়। তবে দেশে প্রথম নিপা ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০০১ সালে, মেহেরপুর জেলায়। করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও এখনো পর্যন্ত নিপা ভাইরাসের কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি।

রাজশাহীতে এক সভায় আইইডিসিআরের গবেষকরা জানান, নিপা ভাইরাসে মৃত্যুহার শতকরা ৭০ শতাংশ। ২০০১ সাল থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ৩২৬ জনের নিপা ভাইরাস শনাক্ত হয়। এদের মধ্যে মারা গেছেন ২৩১ জন রোগী। দেশের ৩২ জেলায় শনাক্ত হয়েছে এ ভাইরাস। এরমধ্যে রাজশাহী ও নওগাঁর অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বাদুড় থেকে এ ভাইরাস ছড়ায়। শীতকালে দেশে উৎসব করে খেজুর রস পান করা হয়। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। খেজুর রসের প্রকৃত স্বাদ না পেলেও মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার ওপরে রস ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ আইইডিসিআরের।

গুড়_তৈরি

শীতে খেজুর রস পানে সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে রাজশাহীর ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মতিন বলেন, সাধারণত খেজুরের কাঁচা রস বা আংশিক খাওয়া ফল, গাছের যেটা বাদুড় খেয়ে ফেলে। এ ধরনের খাদ্য থেকে ভাইরাসটা ছড়ায়। প্রতিরোধমূলক আমরা আগে থেকেই বলি, শীত মৌসুমে আপনারা কাঁচা খেজুরের রস খাবেন না।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. মনির-উল-ইসলাম বলেন, খেজুরের কাঁচা রস খেলে নিপা ভাইরাসটা ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে আমাদেরকে সাবধান হতে হবে খেজুরের রস সেবনের মধ্যে। যারা এ রস সংগ্রহ করছে, তাদেরকে সাবধান হতে হবে, সংগ্রহের সময় তাদেরকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। হাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও গাছটা নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে, যাতে বাদুড়ের সংস্পর্শে না আসে।

টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর