মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

উপকূল দিবস

ঝালকাঠিতে অরক্ষিত বেড়িবাঁধ আর ভাঙনের কবলে দুই লাখ মানুষ

আরিফুর রহমান, ঝালকাঠি
প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:২৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ঝালকাঠিতে অরক্ষিত বেড়িবাঁধ আর ভাঙনের কবলে দুই লাখ মানুষ

যুগযুগ ধরে ভাঙছে নদী। নেই পর্যাপ্ত বেড়ি বাঁধ। ঝালকাঠিতে নদী তীরের লাখ মানুষ বন্যা-ঝড়ে ভাসে। প্রতি বছরই নদী গর্ভে বিলিন হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শতশত পরিবার। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভাঙন রোধ আর জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে বেড়িবাধ নির্মাণসহ কার্যকারী পদপেক্ষ নেওয়া হচ্ছে।

একদিকে সমুদ্রের উপকূলে, তার ওপর চারদিকে নদী বেষ্টিত হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ জেলা ঝালকাঠি। সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল আর সিত্রাংসহ গত এক যুগে বন্যা-ঝড়ে প্রাণহানী ও সম্প্রদ হারিয়ে দুর্যোগে তান্ডবের সাক্ষী এ জেলার মানুষ।


বিজ্ঞাপন


কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলায় নদী তীরের মানুষের জন্য টেকসই ব্যবস্থা নেই মোটেও। বিশেষ করে বাঁধ না থাকায় কাঁঠালিয়া উপজেলায় যুগযুগ ধরে বন্যা-ঝড়ে ভাসেছে অসংখ্য মানুষ। আর জেলা সদর, রাজাপুর এবং নলছিটি উপজেলায় নদী তীরের বেড়িবাঁধ ভেঙে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ভেসে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেত। জেলার সুগন্ধা, বিষখালী, আর গাবখান নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ভাঙনে বিলিন হচ্ছে জনপদ।

নদীর ভয়ানক গ্রাসে নিঃস্ব হয়েছে শতশত পরিবার। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ভাঙন আর জলোচ্ছ্বাসে লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো প্রকার কার্যকারী পদক্ষেপ নেই বলে এলাকাবাসীর তীব্র ক্ষোভ। উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতে মোট লোক সংখ্যা সাত লাখ। এরমধ্যে নদী নিকটবর্তী এলাকায় দুই লাখ মানুষের বসবাস। আকাশে মেঘ দেখলেই নদীতীরের মানুষের মধ্যে বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করে। এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন নদী তীরের বাসিন্দারা।

ইতোমধ্যে সুগন্ধা ও বিষখালীর ভাঙনে জেলার কয়েকশ একর ফসলি জমি, গাছপালা, বাড়ি-ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলিন হয়ে গেছে। মাত্র ৫ বছর আগে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত দেউরি সাইক্লোন সেল্টার কাম প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটি এখন বিষখালীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। তীব্র ভাঙনে ঝালকাঠি সদরের চরকাঠি, ভাটারাকান্দা, কৃষ্ণকাঠি, দেউরী, দিয়াকুল, নলছিটি উপজেলার আমিররাবাদ, বহরমপুর, ষাইটপাকিয়া, মল্লিকপুর, কাজিপাড়া, তিমিরকাঠি, হদুয়া ও রাজাপুরের মঠবাড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ল ঘাট, বাদুরতলা, কাচারিবাড়ী বাজার, চল্লিশকাহনিয়া, মানকি সুন্দর সাইক্লোন সেল্টারসহ, এসব এলাকার ফসলি জমি, বসতঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। নদী ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় এসব এলাকায় জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙনের শিকার নদীতীরের বাসিন্দারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যেকোনো সময় এসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হতে পারে বলে হুমকির মুখে থাকা বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙনের কবলে পড়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১১ কিলোমিটার গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ভাঙন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এজন্য মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প করে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার বারইকরণ এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, সুগন্ধা নদীর তীরে আমার একটি বাগান ও ফসলী জমি রয়েছে। কয়েক দফা ভাঙনের শিকার হয়ে বাগান নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এখন ফসলের মাঠেও জোয়ারে পানি ওঠে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিষয়টি জানানোর পরেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

নদী তীরের বাসিন্দা কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, এখন আর আগের মতো জমিতে ফসল ফলাতে পারি না। বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রন্ত হচ্ছি আমরা। আমাদের এলাকায় ভাঙন রোধে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।

রাজাপুরের বিষখালী নদীর তীরের বাসিন্দা জামাল হোসেন বলেন, বিষখালী নদীতে কোনো রকমের বেড়িবাঁধ ছিল। সিডর, আইলা, রোয়ানুসহ বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে সেই বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এর পরে আর মেরামত বা নতুন করে নির্মাণ হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় এলাকা পরিদর্শন করে চলে যান। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। ফলে আমাদের বাড়ি-ঘর দফায় দফায় ভেঙে নদীতে বিলিন হচ্ছে। এখন নদীর পানিতে ফসল তলিয়েও ক্ষতি হচ্ছে।

কাঁঠালিয়ার বিষখালী নদী তীরের জয়খালী এলাকার বাসিন্দা মজিবুর রহমান বলেন, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কাঁঠালিয়ায় বাসিন্দারা। নদী যেমন ভাঙছে, তেমন পানিতে ফসলের ক্ষেত তলিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। আমাদের বাড়ি-ঘর অনেক বার সরিয়ে নিতে হয়েছে নদী ভাঙনের কারণে। লঞ্চ ঘাট এলাকায় নতুন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ এলাকাই অরক্ষিত।

দক্ষিণ আউড়া গ্রামের অটোচালক কবির হাওলাদার বলেন, বেড়িবাঁধ না থাকায় আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। জোয়ারের পানিতে আমাদের বসতঘর তলিয়ে যাচ্ছে। বন্যায় আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হয়।

ঝালকাঠি সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ডক্টর কামরুন্নেছা আজাদ বলেন, নদী তীরের মানুষের নানা কষ্ট। বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে তাদের ঘর-বাড়ি তলিয়ে যায়। বেড়িবাঁধ না থাকায় সামান্য জোয়ারেই পানি ওঠে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচিৎ বেড়িবাঁধগুলো সঠিকভাবে মেরামত করা। যেখানে বেড়িবাঁধ দরকার সেখানে নতুন করে টিকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডর নির্বাহী প্রকৌশলী এ. কে. এম. নিলয় পাশা বলেন, ঝালকাঠিতে ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদী ভাঙন রয়েছে। এর মধ্যে আমরা সাড়ে ১১ কিলোমিটারকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প তৈরি করে পাঠিয়েছি। এই প্রকল্প পাস হলে কাজ করা যাবে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর