রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি ছুঁয়ে কাঁদে তারা 

আহমাদ সোহান সিরাজী
প্রকাশিত: ২৪ এপ্রিল ২০২২, ০৮:১৫ এএম

শেয়ার করুন:

রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি ছুঁয়ে কাঁদে তারা 
ছবি : ঢাকা মেইল

আজ ২৪ এপ্রিল। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। ২০১৩ সালের এই দিনে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১১৩৬ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। যা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

প্রতিদিনের মতো কাকডাকা ভোরে উঠে কর্মস্থলের দিকে পা বাড়ায় কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক। গন্তব্য সাভারের রানা প্লাজা ভবন। যদিও শ্রমিকদের মনে এক অজানা সংশয় কাজ করছিলো। কারণ আগের দিন থেকে শোনা যাচ্ছিলো—যেকোনো সময়ই ভেঙে পড়তে পারে ভবনটি। কিন্তু তারপরও শুধুমাত্র চাকরি হারানোর ভয়ে কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা।


বিজ্ঞাপন


সকাল পৌনে ৯ টায় সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি ৯ তলা বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। আর কিছু অংশ পাশের আরেকটি ভবনের ওপর পড়ে। মারা যায় হাজারও নিরীহ শ্রমিক, কংক্রিটের নিচে আটকা পড়েন অনেকেই। পৃথিবীর ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম ওই শিল্প দুর্ঘটনায় এমন নির্মমতার বিপরীতে বিশ্ববাসী দেখেছিলো মানবতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার অভিযানে নেমেছিলেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। যার যার অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো সকলেই।

তবে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির নয় বছর পরেও সেই দিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাড়া করে ফেরে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সেইসব শ্রমিকদের। এখনও তারা পারেননি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। বেশিরভাগই কাটাচ্ছেন দুর্বিষহ বেকারত্ব। অন্যদিকে একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বজন হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে অনেক পরিবার। 

তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইল প্রতিবেদকের।

প্রস্রাব এবং রক্ত কাপড়ে ভিজিয়ে তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা 
এক আহত শ্রমিক হলেন রানা প্লাজা সারভাইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহমুদুল হাসান হৃদয়। রানা প্লাজা ধসে তিনি হারান তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা। মেরুদণ্ডের আঘাত, বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়াসহ ডান পা অবস হয়ে গেছে তার। এখন দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে ঘরে শুয়ে-বসে। ক্রাচে ভর দেয়া ছাড়া উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই তার। 


বিজ্ঞাপন


তিনি বলেন, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দিনটি ছিলো বুধবার। সেদিন ভোরে কারখানায় যাবার পর সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে কারেন্ট চলে যায়। এর মিনিট পাঁচেক পরেই জেনারেটর চালু হয়। এতে কম্পন সৃষ্টি হলে আগে থেকে ফাটল ধরা ৯ তলা বিল্ডিংটি হঠাৎ ধসে পড়ে। আমি তখন ফ্লোরে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলাম, হঠাৎ মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। চারিদিকে হাউমাউ কান্না, চিৎকার, আহাজারি শুরু হলো ভেতরে আটকে পড়াদের। কয়েকটি রক্তাক্ত লাশের মাঝে আমি চাপা পড়লাম, মেরুদণ্ডের ওপরে এসে একটি বিম এসে পড়লো। দুইহাতে এবং পায়ে রড ঢুকে গেলো। বুকে আর কোমড়ে প্রচণ্ড ভারী কিছুর চাপায় পড়লাম। চারিদিক ধুলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার আর প্রচণ্ড গরম। পানির তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে নিজের প্রস্রাব এবং রক্তও কাপড়ে ভিজিয়ে সেটি চুষে তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করেছি। 

তিনি বলেন, আমার সামনেই পড়েছিলো আমার বন্ধু ফয়সালের মাথা থ্যাতলানো লাশ। চারিদিকের এই বীভৎসতা আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। নিজের চোখে কেয়ামতের দৃশ্য দেখার মতো অবস্থা। এভাবেই ওই নরক যন্ত্রণার মাঝে আমি ২২ ঘণ্টা আটকা ছিলাম। এরপর ভেতর থেকে স্থানীয় কয়েকজন উদ্ধারকর্মী আমাকে উদ্ধার করে বাইরে বের করে এনে সেনাবাহিনী সদস্যের হাতে তুলে দেয়। ওই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে বাইরের আলোতে বের হওয়ার পরপরই আমি জ্ঞান হারাই। সেখান থেকে আমাকে প্রথমে সাভার সীমা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘ ১৭ দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে। এরপর ঢাকা মেডিকেল, সিআরপিসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে প্রায় দুই বছর চিকিৎসাধীন ছিলাম। এখনও ওষুধের ওপরেই বেঁচে আছি, জানি না আর কতদিন শরীরে এই অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো লাগবে।

১০ ঘণ্টা আটকে ছিলেন ধ্বংসস্তূপের নিচে
আরেক আহত শ্রমিক নিলুফা বেগম, ঘটনা ৯ বছর আগের, তবু সেই সময়টি যেন থমকে আছে ট্র্যাজেডিটি থেকে বেঁচে ফিরে আসা নিলুফার কাছে। প্রাণে বেঁচে গেলেও সব স্বপ্ন তার কেড়ে নিয়েছে ওই দুর্ঘটনা। 

নিলুফা বেগম জানান, তিনি রানা প্লাজার ৫ তলার ফেনটম অ্যাপেরালে সুইং অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রায় ১০ ঘণ্টা আটকে ছিলেন সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে। সেখান থেকে উদ্ধারের পর দীর্ঘ ৯ মাস হাসপাতালের বিছানায় কেটেছে তার সময়। তবে ভাঙা পায়ে ইনফেকশন নিয়ে এখনও ভুগছেন তিনি। আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন কেবল ১ লাখ টাকা। 

তার দাবি চিকিৎসা সেবাসহ আজীবনের ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক আহত সকল শ্রমিককে। 

তিনি চান, দোষী ৪০ জন সুষ্ঠ বিচারের আওতায় আসুক। এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।

rana plaza

ভেতরে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার 
অস্থায়ী বেদিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা রানা প্লাজা ধসে এক সন্তানের মা। তিনি হলেন, নিহত শ্রমিক রাব্বির মা রাহেলা খাতুন। 

তিনি বলেন, সেদিন খবর পেয়ে রানা প্লাজার সামনে ছুটে এসে দেখি চারিদিকে মেঘের মতো ধুলাবালি কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না ঠিকমতো। আর ভেতরে আটকেপড়াদের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারে চারপাশ ভারী হয়ে আসছিলো। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কে যে আমার ছেলেকে উদ্ধার করেছিলো আমি বলতে পারি না। আমি শুধু দুদিন পর অধরচন্দ্র স্কুল মাঠে তার নিথর দেহটা পেয়েছিলাম। তবুও আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া অন্তত ছেলের লাশটাতো পেয়েছিলাম। আমার ছেলের সঙ্গে সহকর্মী বাকিদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি, তারা এখনও নিখোঁজ। আটকেপড়া আহত এক নারীর বুকে আমার ছেলের লাশটা পড়েছিলো, সে ঠিকই বেঁচে আছে। কিন্তু আমার ছেলেটাই চলে গেলো। আজ ছেলে হারানোর নয় বছর হলো। কিন্তু আমরা বিচার পেলাম না। দোষীদের বিচার এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। 

এসময় দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

rana plaza

নয় বছর ধরে হাতড়ে বেড়ায় মায়ের ঝাপসা স্মৃতি
রানা প্লাজার ফাঁকা জায়গাটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে বারো বছরের কিশোর আলিফ। তার কাছে জানতে চাইলে সে জানায়, তার মা মর্জিনা আক্তার সিনিয়র অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন এই রানা প্লাজা ভবনের একটি গার্মেন্টসে। ২৪ এপ্রিলের সেদিনের ঘটনায় তার মায়েরও মৃত্যু হয় এখানে তাই প্রতি বছরই সে ছুটে আসে এই স্থানটিতে। হাতড়ে বেড়ায় মায়ের ঝাপসা স্মৃতি। মায়ের ছবিটাও এখন তার চোখে মলিন হতে চলেছে। তাই ফ্যাল ফ্যাল করে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে থাকে ধ্বংসস্তুপের সেই ফাঁকা জায়গাটির দিকে আর অভিশাপ দেয় সেই সকল দোষী ব্যক্তিদের যাদের জন্য আজ অনাথ হয়েছে সে।

মরদেহগুলো কাপড়ের রোলের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে
রানা প্লাজা ধসে উদ্ধারকর্মীদের একজন রাজিবুল হাসান। যিনিই ব্যক্তিগতভাবে প্রথম শুরু করেন এই উদ্ধার কাজ। নিজের হাতে অনেকের লাশ এবং জীবিত উদ্ধার করেছিলেন অনেককে। ঘটনার শুরুর দিন থেকে টানা সতেরো দিন দিনরাত ছিলেন সেখানেই। আটকেপড়া শ্রমিকদের করাত দিয়ে হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছেন। পরবর্তীতে আরও টানা কয়েক সপ্তাহ কাটিয়েছেন হাসপাতালে। নিজের উদ্যোগেই সেবা-শুশ্রুষা করেছেন পঙ্গু রোগীদের। এরপর থেকেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো ভয়াবহ সেসব স্মৃতি। রক্ত বা কাঁচা মাংস দেখতে পারতেন না। রানা প্লাজার সেইসব দুঃসহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াতো তাকে। প্রায় আড়াই মাস অস্বাভাবিক আচরণও করতেন।

rana plaza

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আমার স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে জানায়, রানা প্লাজা ধসে পড়েছে। তৎক্ষণাৎ আমি সেখানে পৌঁছে দেখি পুরো নয়তলা ভবনটি এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার স্থানীয় কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়ি। প্রথমেই আমি রানা প্লাজা এবং তার পার্শ্ববর্তী আর এস টাওয়ারের গ্যাপ দিয়ে বেয়ে রানা ধ্বংসস্তূপের ওপরে উঠে পরে। সেখানে ৬টি ট্যাংকি ছিলো। সেখান থেকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করি। এরপর প্রতিটি ফ্লোরের বাইরের দিকে আশেপাশে যে সকল আটকেপড়া ভিকটিম ছিলো, তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হই। পরে রাত ১০টা নাগাদ আমরা স্থানীয় উদ্ধারকারী এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ধসে পরা ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করে উদ্ধার কাজ শুরু করি। সে সময় ভেতরের পরিস্থিতি মনে হলে এখনো আঁতকে উঠে বুক। যখন আমরা ক্রল দিয়ে ভেতরে ঢুকছিলাম তখন দেখতে পাই একেকজন মানুষের মরদেহগুলো কাপড়ের রোলের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা যেহেতু গার্মেন্টস হয়তো কাপড়ের রোলই পড়ে আছে। কিন্তু স্পর্শ করলে বুঝতে পারতাম যে এগুলো মানুষের লাশ। তখন সেই লাশগুলো আমরা টেনে বের করে দেই। এবং সেনাবাহিনীর লোকজন স্ট্রেচারে করে লাশগুলো নিয়ে যায়। 

এর মাঝে যখন চারতলার যখন প্রবেশ করি তখন দেখতে পাই, দুই বিমের মাঝে শুধুমাত্র এক হাতের কবজি আটকা পড়ে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতটি বিচ্ছিন্ন করা ছাড়া উদ্ধারের কোনো উপায় নেই। আমি তখন বাইরে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিমকে বিষয়টি জানালে, তারা বলেন এই মুহূর্তে ভেতরে যাওয়ার মতো কোনো ডাক্তার সেখানে নেই। তখন আমি তাদেরকে বলি আমাকে একটি ধারালো কিছু দেন যাতে আমি তার হাতটা কেটে মানুষটাকে উদ্ধার করতে পারি। কিন্তু তারা আমাকে জানায়, আপনি তো ডাক্তার বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেউ না, তাই আপনাকে এটা করতে দেওয়া যাবে না, আর এই মুহূর্তে তেমন কোনো ইকুপমেন্টও নেই। তখন আমি চিৎকার করে সবাইকে বলতে থাকি এবং উপস্থিত কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির সহায়তা নেই। তখন একজন আমাকে সাভার নামা বাজার থেকে একটি চাপাতি জাতীয় বস্তু এনে দেয় তখন আমি তার কাছে একটি রশি চাই। পরে সেগুলো নিয়ে আমি ভেতরে প্রবেশ করি এবং প্রথমে তার হাতের তিনটি স্থানে শক্ত করে রশি দিয়ে বাঁধি, যাতে রক্ত বেশি বের না হয়। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে এক কোপে তার হাত কবজি থেকে আলাদা করে ফেলে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে বাইরে বের হই। এভাবেই দীর্ঘ সতেরো দিন উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাই।

এদের সকলের আক্ষেপ একটাই দীর্ঘ নয়টি বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও এতো বড় একটি ঘটনার প্রকৃত দোষীরা আজো শাস্তির আওতায় আসেনি। তারা প্রত্যকেই চান সকল দোষীদের বিচার করে নিহত শ্রমিকদের আত্মার শান্তি দেওয়া হোক।

এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর