রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

কৃষিবান্ধব উদ্যোগই কৃষকের গলার কাঁটা!

শুভ ঘোষ, মুন্সিগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

কৃষিবান্ধব উদ্যোগই কৃষকের গলার কাঁটা!

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থেকে কৃষকের ফসলহানি রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঝড়-বৃষ্টি আদ্রতা আর খরার আগাম খবর কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে মুন্সিগঞ্জের ৬৮টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয় কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্য বোর্ড। তবে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও খামখেয়ালিতে কোনো কাজেই আসছে না সরকারের কৃষিবান্ধব মহৎ উদ্যোগের এ প্রকল্প। এছাড়াও খোদ ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্টরাই জানেন না কেন স্থাপন করা হয়েছিল এমন তথ্য বোর্ড।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে, কৃষি আবহাওয়ার তথ্য পদ্ধতির উন্নতীকরণ প্রকল্পের আওতায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে মুন্সিগঞ্জের ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার আগাম তথ্য কৃষকের কাছে তুলে ধরতে স্থাপন করা হয়-কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্য বোর্ড।


বিজ্ঞাপন


তবে স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ বিগত কয়েক বছরে একবারের জন্যও এসবের দেখভাল করেনি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এতে ভেঙে চৌচির হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে কৃষি খাতের গুরুত্বপূর্ণ এসব যন্ত্রাংশ।

Shuvho-2

সোমবার সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ছাদে, সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল থাকলেও উধাও মূল্যবান সকল রেংগেস মিটার। এমন চিত্র দেখা গেছে মুন্সিগঞ্জের, রামপাল, পঞ্চসার, বজ্রযোগিনী, মহাখালী, শিলই, মোল্লাকান্দিসহ প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে। অথচ সরকারের কৃষি বান্ধব মহৎ উদ্যোগের কারণে, কৃষকদের ঝড়-বৃষ্টি খরার তিনদিনের আগাম তথ্য দিতে স্থাপন করা হয়েছিল এসব মূল্যবান যন্ত্রাংশ। তবে এখন আর কোথাও কাজ করছে না এসব উদ্যোগ।

অন্যদিকে কথা বলে জানা গেছে, খোদ ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্টরাই জানেন না? কোন উদ্দেশে স্থাপন করা হয়েছে আবহাওয়ার পূর্বাভাস তথ্য বোর্ড।


বিজ্ঞাপন


যেখানে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্য-বোর্ডে চোখ রাখলেই তিন দিন আগের ও পরের পূর্বাভাস পাওয়ার কথা কৃষকদের। তবে এটি স্থাপনের পর একবারের জন্যেও পরিবর্তন করা হয়নি কোনো তথ্য অভিযোগ ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্টদের। এর কার্যক্রম কি তাও জানেন না অনেকে। ফলে ইউপি সচিব ও কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ বিষয়টি নিয়ে।

Shuvho-3

পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সচিব রুহুল আমিন সবুজ বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন জানতে পারিনি কেন বা কি কারণে স্থাপন করা হয়েছে এমন আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্য বোর্ড। আমরা প্রায়ই দেখি বিভিন্ন জায়গা থেকে আবহাওয়ার পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হলে কৃষকরা খোঁজখবর নিতে আসেন ইউনিয়ন পরিষদে। আমরাও কৃষকদের বিভিন্ন সভা সেমিনারে জানাই ইউনিয়ন পরিষদে এসে খোঁজখবর নিয়ে বীজ বপন করতে।

কিন্তু সরকার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে আবহাওয়া পূর্বাভাসের আগাম তথ্য কৃষকদের জানাতে যে প্রকল্প নিয়েছে, আমরা মনে করি জেলা কৃষি বিভাগের উদাসীনতাই এমন মহৎ উদ্দেশ্য বিনষ্ট করেছে যার প্রতিফলন হিসেবে এর কোনো সুফলই পায়নি প্রান্তিক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা।

বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য কর্মকর্তা মো. রবিন বলেন, আবহাওয়া পূর্বাভাসের তথ্য বোর্ডটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হলেও বিগত টানা কয়েক বছরেও এসবের কোনো তদারকি করেনি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। অথচ ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে কৃষি বিভাগের দায়িত্বে একজন করে।

Shuvho-4

উপ-সহকারী থাকা সত্ত্বেও এসবের দেখভাল কেউ করেনি। শুরু থেকে টানা কয়েক বছরে কোনো ধরনের পরিবর্তন করা হয়নি কোনো ধরনের তথ্যে। প্রতিবছরই অসময়ের বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বহু অসহায় কৃষক। অথচ সরকারের কৃষিবান্ধব এমন ভালো উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও এসবের কোনো সুফলই পেল না কৃষকেরা। এটি দুঃখজনক। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ ব্যাপারে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ আমাদের ইউনিয়ন পরিষদে এটি স্থাপন করা হয়েছে অথচ আমরা নিজেরাই জানি না এটার কি কাজ। আমাদের মতো প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে যারা আছেন তারা নিজেরাও জানে না এটা কি কাজে ব্যবহৃত হয় কৃষিখাতের। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ কর্মকর্তারা মনে করি প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থ লুটপাট করেছে কৃষি বিভাগ।

এদিকে কিছু সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে আরও জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতির উন্নতীকরণ প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে আবহাওয়া পূর্বাভাসের জন্য তথ্য বোর্ড ও রেইন গজ মিটার বসানো হয়। প্রতিটি যন্ত্র বসানো বাবদ ব্যয় হয় পৌনে দুই লাখ টাকা।

প্রতিটি উনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ডে রয়েছে রেইন গেজ মিটার এতে ডিসপ্লে বোর্ডে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতার হার, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়ের পূর্বাভাসসহ ১০টি তথ্যের ছক আছে। এই বোর্ড থেকে তিন দিন আগের ও তিন দিন পরের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা সম্ভব কৃষকের।

shuvho-7

এই অধিদফতরের তথ্য বলছে, বোর্ড পরিচালনার জন্য ওই সময় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের দুদিন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে আবহাওয়া বিষয়ক সফটওয়্যারসহ প্রত্যেককে একটি করে ডিজিটাল স্মার্ট ট্যাব দেওয়া হয়। সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সরকারিভাবে প্রতি মাসে ফ্রি মোবাইল ডাটাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্থাপনের পর থেকেই এসব বোর্ডে নেই কোনো কার্যক্রম।

এদিকে সম্প্রতি সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়ন ঘুরে আরও দেখা যায়, কৃষি আবহাওয়া বোর্ডগুলো ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে নামমাত্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব বোর্ড থেকে কোনো সেবা পাচ্ছেন না কৃষকরা। বেশির ভাগ ইউনিয়নে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ডিসপ্লে বোর্ড, সোলার প্যানেল ও রেইন গেজ মেশিন। কোথাও কোথাও সেগুলো খুলেই রাখা হয়েছে।  ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের বারান্দার দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড। বোর্ডে বাসা বেঁধেছে মাকড়সা। কোনো তথ্য হালনাগাদ করা নেই। জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য নিচে ডান পাশে কৃষি কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর থাকার কথা, তবে সেখানে কোনো মোবাইল নম্বর নেই।

উপজেলা কৃষি বিভাগগুলো বলছে, এই বোর্ডের মাধ্যমে নদ-নদীর সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য কৃষকদের কাছে পৌঁছাতে। এসব তথ্য সংগ্রহের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহারে ‘ডিএই’ সক্ষমতা বাড়াতে এই প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এ ছাড়া তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, ঝড়ের পূর্বাভাসসহ নানা রকম আবহাওয়া তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এতে।

তবে চলতি বছরের জুনে পাঁচ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে।

তবুও প্রকল্পের কোনো সুফল মিলেনি অভিযোগ কৃষকের। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলছেন আগে থেকেই আবহাওয়া পূর্বাভাসের তথ্য জানা থাকলে সুবিধা হয়, বীজ রোপণ, সার ও কীটনাশক ব্যবহারে, তবে এমন কোনো তথ্য না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অনেকে।

সম্প্রতি কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুন্সিগঞ্জের ভট্টাচার্যেরভাগ এলাকার শীতকালীন আগাম শাকসবজির বীজতলা। এতে ক্ষুব্ধ কৃষকেরা তাদের অভিযোগ সরকারের নানামুখী উদ্যোগের সুফলমেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক চাষিরা।

ভট্টাচার্যের বাগ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত এক কৃষক আমিন ঢালী বলেন, ঝড়-বৃষ্টিতে প্রতিবছরই আমাদের ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। কিন্তু পরিষদ থেকে আগাম কোনো তথ্য পাই না। আগাম তথ্য পেলে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া যেত।

রফিক সিকদার নামের আরেক কৃষক বলেন, কৃষকদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সরকারের এমন উদ্যোগ রয়েছে সে কথা কোনো কৃষকই হয়তো জানে না। কারণ এ ব্যাপারে কৃষি কর্মকর্তারা কখনই কৃষকদেরকে অবহিত করেনি। কৃষি বিভাগের খামখেয়ালিতে এত সুন্দর প্রকল্পের কোনো সুফল পাইনি কৃষক। কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।

shuvho-5

আবুল কালাম মোল্লা নামের আরেক কৃষক বলেন, প্রতিবছরই প্রচুর শাক সবজি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ বৃষ্টির কারণে। যদি এসবের আগাম তথ্য পাওয়া যেত তবে সতর্ক হয়ে জমিতে পর্যাপ্ত হালট কেটে দ্রুত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করা যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এসব কোনো তথ্যই কৃষকদের দেওয়া হয় না।

সম্প্রতি বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া আব্দুল কাদির নামের এক কৃষক বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকার কৃষকের জন্য উদ্বেগ নিলেও মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের অবহেলা আর উদাসীনতায় কৃষক এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের সব উদ্যোগে সুফল যদি কৃষক পেত তবে প্রতিবছর এত ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হতো না। আমরা দ্রুত আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্য বোর্ড পুনরায় সঠিকভাবে চালু করার দাবি জানাচ্ছি। কারণ সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার অবহেলার কারণে ভেস্তে গেছে সরকারের এমন উদ্যোগ। তবুও দ্রুত স্থায়ী সমাধানের মাধ্যমে প্রকল্পের সুফল পাওয়ার অপেক্ষা কৃষকের।

এদিকে কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্য বোর্ডগুলোর এমন বেহাল দশা স্বীকার করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ অফিসার এবং ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এবিএম ওয়াহিদুর রহমান বলেন, উপ-সহকারীসহ এসব আবহাওয়া তথ্য বোর্ড পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটি পরিচালনার জন্য উপ-সহকারীদের ডিজিটাল স্মার্ট ট্যাব, ফ্রি ডাটা ব্যবস্থাপনায় দেওয়া হলেও এখন সেইসব ট্যাবের কোনো হদিস মিলছে না। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে শিগগিইর। কারণ এটি নিয়ে আমরাও বিব্রত, যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটির কার্যক্রম সচল রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর