সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘হামুন’-এর আঘাত 

কক্সবাজারে ৩০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:১৭ পিএম

শেয়ার করুন:

কক্সবাজারে ৩০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ এর তাণ্ডবে কক্সবাজার জেলায় ৩০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি-দোকানপাট বিধ্বস্ত হয়েছে। কয়েক কিলোমিটার বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। উপড়ে পড়েছে বিদ্যুতের অসংখ্য খুঁটি। হাজার হাজার গাছপালা ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। আঁধারে ডুবে আছে কক্সবাজার।

মঙ্গলবার রাত ৯টায় কক্সবাজার উপকুলে আঘাত হানে ঘুর্ণিঝড় ‘হামুন’। সেই থেকে বুধবার এ পর্যন্ত শহরে বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ। গাছপালা উপড়ে পড়ে শহরের প্রধান সড়ক, সৈকত সড়ক ও কলাতলী সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারে ডুবে আছে কক্সবাজার শহর।


বিজ্ঞাপন


কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, শহরের বাইরে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপে ব্যাপকহারে ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙেছে। গাছপালা উপড়ে পড়ে মহেশখালী থেকে শাপলাপুর পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটারের জনতা সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে উপজেলাগুলোও বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’-এর আঘাতে কক্সবাজার শহর লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এখন পর্যন্ত মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ আছে। এ কারণে জেলা কার্যালয় থেকে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। শহরে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিদ্যুতের লাইন ঠিক করে সরবরাহ নিশ্চিত করতে আরও এক থেকে দুই দিন সময় লেগে যেতে পারে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ মঙ্গলবার মধ্যরাতের দিকে আঘাত হানবে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু রাত ৯টার আগেই প্রবল গতিবেগে ঘূর্ণিঝড়টি শহরে আঘাত হানতে শুরু করে। মাত্র দুই ঘণ্টার তান্ডবে পুরো শহর লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গাছপালা ও বাতাসে উড়ে আসা ঘরের টিনের আঘাতে অন্তত ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


নিহত ব্যক্তিরা হলেন কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার আবদুল খালেক (৪২), মহেশখালীর উপজেলার বড়মহেশখালী ইউনিয়নের গোরস্তানপাড়ার হারাধন দে (৪৫) ও চকরিয়া উপজেলার বদরখালী গ্রামের আশকার আলী (৪৫)। ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে আবদুল খালেক এবং গাছচাপায় অপর দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। বুধবার দুপুর ১টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’-এর আঘাতে জেলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণকক্ষ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘হামুন’-এর আঘাতে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়ক, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালত ভবন, থানা, বাজারঘাটা, আলীর জাহান, বাইপাস সড়ক, কলাতলী, ঝাউতলা, হিলটপ সার্কিট হাউস, উত্তরণ আবাসিক, সার্কিট হাউস সড়ক এলাকা বিধ্বস্ত। সড়কের ওপর পড়ে আছে অসংখ্য গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। শত শত দোকানপাট-ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। অধিকাংশ ঘরের টিনের চাল উড়ে গেছে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে শতবর্ষী একটি বটবৃক্ষ উপড়ে পড়েছে। আদালত ভবন চত্বরে কয়েকটি গাছ উপড়ে পড়েছে, বিদ্যুতের তার ঝুলে আছে সড়কের ওপর। সার্কিট হাউস সড়কের অরুণোদয় স্কুল, জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো ও উত্তরণ আবাসিক এলাকায় শত শত গাছ পড়ে আছে। পৌরসভার লোকজন গাছপালা সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন।

পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে পুরো শহর লন্ডভন্ড হবে এটি কারও মাথায় ছিল না। রাত সাড়ে সাতটা থেকে তীব্রগতির ঘূর্ণিঝড় শহরে আঘাত হানতে থাকে। তখনো প্রচার করা হচ্ছিল ৬ নম্বর বিপৎসংকেত। কিন্তু বাতাসের গতি ছিল তীব্র। রাত ১০টার আগেই পুরো শহরের বিদ্যুৎ, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। সড়কের ওপর গাছপালা পড়ে যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। এখন ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা চলছে। রাত থেকে গাছপালা সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

পৌরসভার তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’-এর তান্ডবে পৌরসভার অন্তত ৩০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছপালা ভেঙেছে এক লাখের বেশি। রাত নয়টার দিকে পাহাড়তলীতে দেয়াল চাপা পড়ে আবদুল খালেক নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।

পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ওয়ার্ডে অন্তত দেড় হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়েছে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। ১ নম্বর ওয়ার্ডের ১২টি গ্রামে বাস করেন অন্তত ৬০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। দেশের শুঁটকি উৎপাদনের প্রায় ৭০০ মহাল এই নাজিরারটেক উপকূলে গড়ে উঠেছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয় এই ওয়ার্ডের ঘরবাড়ি।

জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বলা হয়, রাতে নাজিরারটেক, ফদনার ডেইল, সমিতিপাড়াসহ বিভিন্ন উপকূল থেকে ৪০ হাজার ১০০ জনকে শহরের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছিল। বুধবার সকালে সবাই ঘরে ফিরে গেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি তালিকা করে সবাইকে ঢেউটিন বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। 

তিনি বলেন, আমরা দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। মানবিক সহায়তা হিসেবে কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে ৫০ হাজার টাকা করে সর্বমোট সাড়ে ৪ লাখ টাকা ও ১৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হবে। একই সাথে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। 

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল গণি বলেন, কিছুটা দূরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরে বেশ কিছু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। শহরের বিভিন্ন সড়কে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে রাত থেকে বোর্ডের লোকজন মাঠে নেমেছে। যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতের লাইন ঠিক করার চেষ্টা চলছে।

মহেশখালীতে বিদ্যুৎ চালু করতে লাগবে ১৫দিন

‘হামুন’-এর তান্ডবে লন্ডভন্ড কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীও। এ উপজেলার অন্তত ১০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। এছাড়া শত শত গাছ ভেঙে পড়ে বন্ধ হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। ঝড়ে পল্লী বিদ্যুতের অন্তত ৩৫টি খুঁটি ভেঙে গেছে। এ কারণে উপজেলার পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পল্লী বিদ্যুতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপজেলার বিদ্যুতের লাইন চালু করতে অন্তত ১৫ দিন সময় লাগবে।  

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কাউসার আহমেদ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, সড়কের ওপর গাছপালা ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে কমপক্ষে ১০ হাজার বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আপাতত দুই টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আরও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

bss-22

শঙ্কা এখনো কাটেনি, আছে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত 

ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপক‚লে আঘাত করে কিছুটা এগিয়ে দুর্বল হয়ে চট্টগ্রামের স্থলভাগে গভীর নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করছে। এটি স্থলভাগের অভ্যন্তরে আরো অগ্রসর ও বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে পারে।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৭ (সাত) নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৫ (পাঁচ) নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। সাগর উত্তাল রয়েছে বলে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। 

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর