সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আশুলিয়ায় ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় থমথমে পরিবেশ, থানায় মামলা

উপজেলা প্রতিনিধি, সাভার ও ধামরাই (ঢাকা)
প্রকাশিত: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

আশুলিয়ায় ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় থমথমে পরিবেশ, থানায় মামলা

সাভারের আশুলিয়ায় নিজ ফ্ল্যাট থেকে পোশাক শ্রমিক দম্পতি ও তাদের একমাত্র সন্তানসহ একই পরিবারের তিনজনকে গলাকেটে হত্যার ঘটনায় অনেকটাই থমথমে এলাকার পরিস্থিতি। আশপাশের প্রতিবেশি সবার মাঝেই একধরনের চাপা আতংক বিরাজমান। অনেকে পাশের এলাকা থেকে কৌতুহলবশত ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন কিভাবে, কারা ঘটালো এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

এ ঘটনায় রোববার (১ অক্টোবর) দুপুরে নিহত মোক্তারুল হোসেন বাবুলের ভাই আয়নাল হক বাদি হয়ে আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এর আগে শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টার দিকে প্রতিবেশীদের খবরে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সন্ধান পায় পুলিশ। লাশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়ানোয় তাদের ধারণা আরো দুই এক দিন আগেই এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


নিহতরা হলেন ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ থানার লোহাগড়া গ্রামের মৃত জহির উদ্দিনের ছেলে মুক্তারুল হোসেন বাবুল (৫০), তার স্ত্রী শাহিদা বেগম (৪০) ও তাদের ছেলে মেহেদী হাসান জয় (১২)।

রোববার বিকেলে ঘটনাস্থল আশুলিয়ার উত্তর গাজীরচটের ফকিরবাড়ী মোড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায় স্থানীয় শেখ মেহেদী হাসান নামে এক ব্যাক্তির মালিকানাধীন একটি ছয়তলা ভবনের ৪ তলায় ঘটেছে এই নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডটি। বাড়িটির প্রতি তলায় ৩ টি করে ফ্লাট। প্রতিটিতেই ভাড়াটিয়াদের বসবাস বাড়ির মালিক থাকেন অপর আরেক ভবনে। ভবনের ভাড়াটিয়াদের সকলেই কর্মজীবী। কেও কাজ করেন পোশাক কারখানায়। কেওবা রিক্সা চালক বা গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত। প্রতিবেশীদের দাবী এই পরিবারটি দীর্ঘদিন যাবত এই ভবনে বসবাস করলেও কারো সাথেই তাদের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই তাদের ফ্লাটের দরজা থাকতো তালাবদ্ধ। অফিস শেষে বাড়ি ফিরেও সোজা ফ্ল্যাটে ঢুকে ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখত তারা। আর এজন্যই হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও টের পাইনি বিষয়টি। পরে গতকাল দুর্গন্ধ ছড়ালে এর উৎসের খবর নিতেই বেরিয়ে আসে লোমহর্ষক এই ঘটনা। 

নিহতদের পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশী তাহমিনা বেগম ঢাকা মেইলকে জানান , আমরা প্রায় এক বছর যাবত বসবাস করছি তবে কখনোই তাদের সাথে আমাদের কথা হয়নি। উনারা একটু একা থাকতেই পছন্দ করতেন সবসময়ই দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা থাকতো। স্বামী স্ত্রী দুজনই গার্মেন্টসে চাকরি করতেন বলে জানতাম। আর তাদের ছেলেটি পাশে একটি স্কুলে পড়াশোনা করত। সবসময়ই দরজা বন্ধ থাকার কারণেই আমরা কখন তারা বাসায় থাকে আর কখন বাইরে। আর সেজন্যই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আমরা টের পাইনি। গতকাল হঠাৎ পাশের ফ্লাটের ভাবি বললেন যে এখানে এত দুর্গন্ধ কিসের। পড়ে সেটি খুঁজতে গিয়ে তিনি ওই ফ্লাটের দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখে দরজা খোলা। পরে বিষয়টি ভবন মালিক কে জানানো হলে তিনি এসে পুলিশে খবর দেন।

আরেক প্রতিবেশী শিল্পী বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যার পর আমি দুর্গন্ধের বিষয়টি টের পাই। পরে গন্ধের সন্ধান করতে গিয়ে ওই ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা দিই। তখন বুঝতে পারি দরজাটি খোলা। এর আগে আমরা কেওই কোন কিছু টের পাইনি। আমাদের ফ্ল্যাট আর নিহতদের ফ্ল্যাটের মাঝে কেবল একটা দেয়ালের ফারাক এরপরেও আমরা কিছু টের পাইনি। বাসায় আমি ছেলে এবং ছেলের বউ বসবাস করি কিন্তু তিনজনের কেওই কিছু শুনতে বা বুঝতে পারিনি। আমরা এখনো একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি।


বিজ্ঞাপন


ভবনটি ঠিক সামনেই মুদি দোকান চালান মো. রাসেল তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, আমি প্রায় ছয় বছর যাবত এখানে দোকান করি। আশেপাশের প্রায় সকলেই আমার দোকান থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে থাকে। নিহত ওই দম্পতিও থেকে মাঝেমধ্যেই সদাইপাতি কিনতেন। তবে উনারা অন্য সবার চেয়ে একেবারেই আলাদা ছিলেন। দীর্ঘদিন যাবত এই এলাকায় বসবাস করলেও আমিসহ আশপাশের কোন দোকানেই উনারা বাকিতে কোন জিনিস কিনতেন না। সবসময়ই নগদ টাকায় পন্য ক্রয় করতেন। এছাড়া উনারা কখনোই একা বাসা থেকে বের হতো না। যখনই বাসার বাইরে যেতেন তিনজন একসাথেই বের হতেন। এমনকি আমার দোকানে চা খেতে আসলেও তিনজন একসাথেই আসতেন। উনাদের আচার ব্যবহারও ছিল একেবারেই নম্র।

আক্তারা বেগম নামে আরেক বৃদ্ধা জানালেন, তিনি প্রায় ১৫/১৬ বছর যাবত এই এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ একই এলাকায় বসবাস করার দরুন তিনি নিহত দম্পতিকে তিনি ভালোভাবেই চিনতেন। তবে কখনো সেভাবে মেশা হয়নি কারন তারা একটু অন্যদের এড়িয়ে একাই চলাচল করতো। তবে মানুষ হিসেবে খুবই ছিল তারা। ব্যবহারও ছিল একেবারেই অমায়িক। বিশেষ করে মহিলাটির। এমন মানুষদের সাথে তো কারো বিরোধ থাকার কথা না। তাহলে এমন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষকে কেন বা কারা এভাবে হত্যা করলো বিষয়টি তাদের বোধগম্য নয়।

ভবনটির মালিক শেখ মেহেদী হাসান (৫৬) ঢাকা মেইলকে জানান, নিহত ওই দম্পতি তাদের একমাত্র পুত্র  সন্তানসহ প্রায় ১০ বছর ধরে আমার বাড়িতে ৬০০০ টাকা ভাড়ায় বসবাস করে আসছিল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই স্থানীয় পৃথক দুটি পোশাক কারখানায় স্টাফ পদে কর্মরত ছিলেন। তারা উভয়েই মানুষ হিসেবে নম্র এবং ভদ্র ছিলেন। ভাড়া নিয়ে কখনোই দু' কথা হতো না তাদের সাথে। তবে তারা একটু ইন্ট্রোভারড টাইপের মানুষ। সবসময় একাই চলাফেরা করতো।আমি মূলত এই ভবনে বসবাস করি না আমার আরেকটি বিল্ডিং রয়েছে সেখানেই আমি থাকি। গতকাল রাতে এই বাড়ির ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে খবর পেয়ে জরুরি সেবা নাম্বার-৯৯৯ এ ফোন করলে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আমি কাউকে সন্দেহ করছি না। বাকিটা পুলিশের তদন্ত বেড়িয়ে আসবে।

নিহত বাবুলের বড় বোন মনোয়ারা বেগম বলেন, সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিন নম্বর ছিলেন বাবুল। দরিদ্র পরিবারের ছেলে হওয়ায় আগে গ্রামে কৃষিকাজ করতেন। পরে প্রায় এক যুগ আগে আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। তার স্ত্রীও পোশাক কারখানায় চাকরি করতো। সেই সুবাদে স্ত্রী সন্তান নিয়ে এখানেই বসবাস করতেন। 

তিনি আরো বলেন আমার ভাইটা জীবনে অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। দুর্বল থেকে সবল হলো। তার পরই তাদের এভাবে মেরে ফেলল। আমার ভাইয়ের কোনো শত্রু ছিল না। থাকলে তো কখনো আমাদের একটু হলেও বলত। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোমেনুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের মোট সম্পর্কে এখনো নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা সকল বিষয়ে সামনে নিয়েই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। শীঘ্রই হত্যাকান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে এবং এর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে  ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের চেতনানাশক কোনো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। অচেতন করার পর তাদের হত্যা করা হয়। মরদেহ দেখে মনে হচ্ছে, প্রায় ৩৬ থেকে ৪০ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ শুক্রবার এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তাদের কোনো কিছু খোয়া যায়নি। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তবে এখনই সুনির্দিষ্ট কারণ বলা যাচ্ছে না। সবগুলো বিষয় মাথায় নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।

প্রতিনিধি/একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর