স্বর্ণ নয়, কিন্তু তার মতই চকচকে। একসময় স্বর্ণের পরেই ছিলো অবস্থান। ছিলো আভিজাত্যের মর্যাদা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই কাসা-পিতলের ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী এখন আড়াল হয়ে গেছে। মাত্র দু-তিন দশক আগেও এসব প্রাচীণ ধাতব পণ্যের যে সমাদর ছিলো, তা যেন কালের অতলে হারিয়ে গেছে। খুঁজে পেতে রীতিমতো অনুসন্ধান করতে হয়।
যুগের পর যুগ এ পেশা আঁকড়ে ধরে টিকে থাকা কারিগরদের আক্ষেপ—চকচকে স্টিল, প্লাস্টিক আর মেলা-মাইনের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কাঁসা ও পিতলের শিল্প।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা জানিয়েছেন,পদ্মার করাল গ্রাসে অনেকটাই নিঃস্ব আজ এই পেশার মানুষ। সাধ থাকলেও সাধ্য যেন অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে তাদের। অর্থের অভাব ও চাহিদা কম থাকায় অস্তিত্ব বিলীন হতে চলা এই শিল্পের কর্মচঞ্চলতা ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিবে সরকার এমন দাবি প্রবীণ তামা-কাঁসা শিল্পের কারখানা মালিকদের।
রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) সরজমিন লৌহজংয়ের বিভিন্ন এলাকার ঘুরে দেখা যায়,এক সময়ের আভিজাত্যের প্রতীক এই শিল্পের সাথে জড়িত অন্তত অর্ধশতাধিক কারখানা থাকলেও,এখন টিকে আছে মাত্র ৩-৪টি।
উপজেলার কনকসার এলাকায় দুটি আর নাগেরহাট এলাকায় অনেকটাই ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে একটি।
স্থানীয়রা জানায়, মাত্র এক যুগ আগেও এখানে ঘুম ভাঙ্গতো কাঁসা শিল্পের কারিগরদের টুং টাং শব্দে।
বিজ্ঞাপন
লৌহজংয়ের দিঘলীর পালের বাজার ও নাগের হাটের অর্ধশতাধিক তামা কাঁসাসহ পিতলের দোকান ও কারখানা এখন আর নেই, তবে যে কয়েকটি টিকে আছে,অর্থের অভাবে শেষ স্মৃতিটুকু বিলীন হতে বসেছে তাদেরও।
কারখানার মালিকদের দাবি, এ শিল্প বাচাঁতে এবং তাদের আর্থিক সহযোগিতা দিতে সরকারি ব্যাংক গুলো এগিয়ে এলে এবং সল্প সুদে সহজ উপায়ে ব্যাংক লোনের ব্যাবস্থা করলে এই শিল্প বাচিঁয়ে রাখা সম্ভব।
প্রায় ৩০ বছর ধরে এ শিল্পের সাথে জড়িত নাগের হাটের শুভঙ্কর পাল বলেন, আমার পরিবার ব্রিটিশ আমল থেকে এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় দেড়শ বছর ধরে জড়িত। আমি হচ্ছি পঞ্চম প্রজন্ম, এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার। তবে যুগের পরিবর্তনে চাহিদা কমে যাওয়ায়,কদর কমেছে এই শিল্পের তৈরি তৈজসপত্রের। অর্থের অভাবে পুঁজি হারিয়ে পেশা বদল করেছেন অনেকেই,সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে অস্তিত্ব বিলীন হবে এই শিল্পের।
কারণ বিগত কয়েক বছরে পদ্মার ভাঙ্গনে পালের বাজার বিলীন হওয়ার পর থেকেই এ ব্যাবসায় অনেকটা ধস নেমেছে।
তবে, মেলামাইন আর ঝকঝকে স্টিলের ব্যবহারে, তামা কাসা আর পিতলের ব্যাবহার এখন অনেকটাই মুখ থুবরে পড়েছে বলে জানান কারখানা শ্রমিকরা ।
নির্মল রায় নামের এক শ্রমিক বলেন,এক সময় হাড়ি পাতিল, পুজার বাটা,মালসা,পুজার কলস,গ্লাস, থালা, পানের বাটা, মগ, কুপি বাতি, কলস, চারি ইত্যাদি তৈরী করা হতো এবং এসব জিনিসের খুব কদর ও ছিলো আজ কালের গর্বে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব পুরোনো সব ঐতিহ্য। এখন কনকসারের দুটি কারখানায় মাত্র ৪/৫ জন শ্রমিক দিয়ে বর্তমানে চলছে এই ব্যবসা।
আলম মিয়া নামের আরেক কারখানা শ্রমিক বলেন, কারখানা মালিকরা চুক্তি হিসেবে এখন মজুরি দিচ্ছে তাদের,কেজি প্রতি ৬৫ টাকা হিসেবে, এক জন শ্রমিক দিনে ১০ থেকে ১২ কেজি তামা কাসা ও পিতলের কাজ করতে পারেন, এখান থেকে এক জন শ্রমিক প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা রোজগার করতে পারেন অনায়েসে। পাশাপাশি কিছু নারী শ্রমিকরা ঘরে বসে সংসারের কাজের পাশাপাশি হাড়ি পাতিল ও থালা মগ বানানো কাজটি করছে। সংসারের অন্যসব কাজ সেরে অবসর সময়ে একাজ করে ভাল আয় ও করছে তারা। মার্কেটে এই জাতীয় জিনিসের চাহিদা হলে তখন চাহিদা অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে ৮/১০ মণ মাল তৈরি করতে পারে একজন কারখানা মালিক। বর্তমানে বাজারে তামার দর রয়েছে ১৬শ ৮০ টাকা, কাসা ১৯শ ৫০ টাকা, পিতল ১১শ ৪০ টাকা। এসব জিনিসের চাহিদা বাজারে খুব একটা না থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকেই। আবার অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে সব কিছু গুটিয়ে।
উপজেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়,এক সময় বিশ্ব জুড়েই কাঁসা-পিতলের ব্যাপক ব্যবহার ছিলো। ভারত উপমহাদেশে ও সেই চর্চার বিস্তৃতি ঘটে স্বাভাবিক ভাবেই। খুঁজলে নানান দেশে কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসের ঐতিহাসিক ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যাবে, কাঁসা-পিতলের ব্যবহার যুদ্ধ সামগ্রী এবং বিভিন্ন শিল্পকর্ম। ভারত উপমহাদেশে ১৮ ও ১৯ শতকে ব্রিটিশ শাসনামলে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী রীতিমত আভিজাত্যের প্রতীক ছিলো। ব্যয়বহুল এসব ধাতব সামগ্রী সাধারণের জন্য ছিলো স্বপ্নের মতো। মূলত সমাজের বিত্তশালী ও প্রতাপশালী আর সনাতন ধর্মের মানুষেরাই এসব পণ্য ব্যবহার করতো বেশি।
তবে মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের ইতিহাসের সাথে জড়িত,প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে ধরে রাখতে,ব্যবসায়িদের,সকল প্রকার আর্থিক সহযোগীতার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার কথা জানালেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর রিপন।
তিনি বলেন,গত কয়েকশ বছরে দেশের বিভিন্ন জনপদে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী তৈরির কারখানা বিস্তৃত হয়েছিলো ঢাকার ধামরাই ও শিমুলিয়া, টাঙ্গাইলের কাগমারি, জামালপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার শিববাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং সহ নানান এলাকায়। এসব এলাকার অনেকগুলোতে গত কয়েক দশকে সে-আয়োজন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার কোথাও টিকে থাকলেও তা টিম টিম করা জ্বলা প্রদীপের মতো জ্বলছে। ইতিহাস থেকে জানা গেছে এই শিল্পের প্রচলন প্রথমে শুরু হয়েছিল বিক্রমপুর থেকেই তাই লৌহজংয়ে মাত্র যে ৪টি কারখানা টিকে আছে,এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে তাদের সরকারি ভাবে সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়া হবে।
প্রতিনিধি/একেবি