বিভিন্ন রঙের কাপড় আর সুঁইসুতা দিয়ে গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি হচ্ছে কারুকাজ খচিত বাহারী টুপি। ঘরে কিংবা বাড়ির উঠানে সবার হাতে সুঁই-সুতা ও কাপড়। হাসি, ঠাট্টা আর খোশ গল্পের মাঝেই নিপুণ হাতে তারা বুনে চলেছেন টুপির কারুকাজ। নওগাঁর গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি এসব টুপি চলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। পবিত্র মাহে রমজান আর ঈদুল ফিতরকে ঘিরে টুপি তৈরির এসব কারিগররা ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় একযুগ আগে জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় টুপি ব্যবসা শুরু করেন ফেনীর একদল ব্যবসায়ী। এরপর নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে টুপি সেলাইয়ের কাজ শুরু হয়। এসব টুপির কারিগর মূলত নারীরা। সাদা কাপড়ের ওপর সুঁই-সুতা দিয়ে বিভিন্ন রঙের ফুলের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। সুঁইয়ের ফোঁড়ে নান্দনিক নকশা ফুটে উঠে একেকটা কাপড়ে। বিশেষ কায়দায় সেলাই ও ভাঁজ করে এ কাপড় দিয়ে বানানো হচ্ছে টুপি। বোতাম, চেইন, দানা ও মাছ কাটা নামে চার ধরনের টুপিতে সেলাই করা হয়। কয়েক হাত বদল হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ টুপি তৈরি হয়। টুপির মধ্যে বেশি সময় ও পরিশ্রম হয় দানা সেলাইয়ে। টুপি ব্যবসায়ীরা টুপি তৈরির সব ধরনের উপকরণ কারিগরদের সরবরাহ করেন। কারিগররা মজুরি পান এক থেকে দেড় হাজার টাকা। টুপি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় এক মাস।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মহাদেবপুর উপজেলার ভালাইন, মধুবন, কুঞ্জবন, খাজুর, রনাইল, খোসালপুর, সুলতানপুর, উত্তরগ্রাম শিবগঞ্জ, গোয়ালবাড়ি এবং তাতারপুরসহ অন্তত ৫০-৬০টি গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারী বিশেষ ধরনের এ টুপি তৈরির কাজ করেন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান কোথায় তা ঠিকভাবে জানেন না নওগাঁর এসব প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ নারীরা। কিন্তু তাদের নিপুণ হাতে যত্নে করে তৈরি করা টুপি যাচ্ছে দেশটিতে। টুপিতে একটি নির্দিষ্ট নকশার ওপর নানা রঙের সুতায় যে টুপি বুনে তৈরি করা হয় সেটি ওমানের জাতীয় টুপি হিসেবে স্বীকৃত। আর এই টুপি দেশটিতে ‘কুপিয়া’ নামেও পরিচিত অনেকের কাছে। শুধু ওমান নয়, নওগাঁর নারীদের হাতে তৈরি টুপি পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার ও বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচের অন্য অনেক দেশেও যাচ্ছে। মানভেদে এসব টুপি দেড় থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। টুপিগুলো তৈরির পর তা ঢাকার চকবাজার, বাইতুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে পাঠানো হয়। সেখানকার ব্যবসায়ীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টুপি রপ্তানি করে থাকেন।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার রনাইল গ্রামের গৃহবধূ তাসলিমা বেগম বলেন, ‘হামার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাম করে। হামাকে দুডা ছোট ছোল আছে। একটার বয়স ৫ বছর আর আরেকটার বয়স ৩ বছর। হামি তো প্রায় গত ৫ বছর ধরা টুপি তৈরির কাম করিচ্ছি। পাশের বাড়ির এক ভাবি কাছে থাকা টুপি তৈরির কাম শিখিছি। প্রতিডা টুপিত থাকা ২০০-২৫০ টাকা করা পাই। সেডা দিয়া সংসার খরচে ব্যয় করা থাকি।’
কথা হয় উপজেলার কুঞ্জবন গ্রামের স্থানীয় গৃহবধূ জুলেখা বিবির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ১২ বছর স্থানীয় এক ধানের চাতালে কাজ করেছি। চাতালে কাজ-কাম করা খুবই কঠিন ছিল। পরে চাতালের কাজ বাদ দেওয়ার পর ভাবছিলাম কী কাজ করা যায়। সে সময় এলাকায় টুপি সেলাইয়ের কাজ আসে। একটি সেলাই মেশিন কিনে টুপির নকশা তৈরির কাজ শিখি। প্রতিটি টুপি সেলাইয়ে প্রায় আধাঘণ্টা সময় লাগতো। প্রতি টুপিতে মজুরি পেতাম ২০-২৫ টাকার মত। এরপর ওই সেলাইয়ের মাঝ দিয়ে সুঁই দিয়ে মোটা সুতা ঢুকানো হতো। এতে মজুরি ছিল ১৫ টাকা। এভাবে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মত আয় হতো। আর টুপি তৈরির কাজে যোগ দেওয়ার পর আধাপাকা ইটের পাঁচ কক্ষের বাড়ি দিয়েছি। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আল্লাহর রহমতে এখন জীবন ভালোভাবে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি মাসে ভালো আয় হয়।’
বিজ্ঞাপন
উপজেলার তাতারপুর গ্রামের বাসিন্দা রাহিমা বেগম বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাস আর ঈদের সময় টুপির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তাই বর্তমানে কাজের চাপ একটু বেশি। এই টুপি তৈরি করেই সংসারের খরচে স্বামীকে সহযোগিতা করছি। ঘরে বসে না থেকে সংসারের কাজের পাশাপাশি এই টুপি তৈরির কাজ করে অনেক লাভবান হচ্ছি আর্থিক দিক দিয়ে। প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ বছর ধরে এই কাজ করছি। আমার স্বামী অন্যের কৃষি জমিতে শ্রমিকের কাজ করে। সব মিলে এই তো সংসার মোটামুটি ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে।’
প্রায় ১২ বছর ধরে টুপির ব্যবসা করছেন উপজেলার আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিবেশীর দেখাদেখি এ পেশার সাথে যুক্ত হয়েছি। এখন তার আমার অধীনে ১৪ জন এজেন্ট কাজ করে। তারা বিভিন্ন গ্রামের নারী কারিগরদের টুপি দিয়ে কাজ শেষে নিয়ে আসেন। প্রায় ৪০০ জন নারী করিগর টুপি সেলাইয়ের কাজ করেন। কাজ শেষে স্থানীয় মহাজনদের কাছে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০টি টুপি বিক্রি করা হয়। প্রতি টুপিতে গড়ে ১০০ টাকা লাভ হয়।’
আমজাদ আরও বলেন, ‘বর্তমানে কিছুটা মজুরি বেড়েছে। প্রকারভেদে প্রতি টুপি সেলাইয়ের মজুরি ২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা। টুপির কাজ সারাবছরই থাকে। তবে ঈদুল ফিতরের তিনমাস আগ থেকে ঈদুল আজহা পর্যন্ত টুপির চাহিদা বেশি থাকায় কাজও বেশি হয়। এসব টুপি দেশের বাইরে চলে যায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে... আমরা সরাসরি সে দেশে না পাঠিয়ে স্থানীয় মহাজনদের কাছে সামান্য লাভে বিক্রি করি। উপজেলায় আমার মতো আরও বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন। এ ব্যবসা লাভজনক তবে তদারকিটা ভালোভাবে করতে হয়। কারণ টুপিগুলো বিদেশ যায়। যার কারণে টুপির মানগুলো খারাপ হলে পরে আর অর্ডার পাবো না।’
এএ

