বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শতবছরের ঐতিহ্য বগুড়ার 'ঘোল'

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১০:১৯ এএম

শেয়ার করুন:

শতবছরের ঐতিহ্য বগুড়ার 'ঘোল'
ছবি : সংগৃহীত

বগুড়ার প্রসিদ্ধ টক দইয়ের ঘোলের প্রচলন সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে শহরের ফতেহ আলী বাজারের রেললাইনের ওপর ঘোলের হাঁড়ি নিয়ে বসতেন ঘোষেরা। লোকজন সেই ঘোল কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। এক গ্লাস ঘোল ৫-১০ পয়সায় বিক্রি হতো। স্বাধীনতার পর ঐতিহ্যবাহী আকবরিয়া হোটেলে প্রসিদ্ধ ঘোল বিক্রি শুরু হয়। এখন ধনী-গরিব–অভিজাত সব পরিবারেই ইফতারের আয়োজনে টক দইয়ের প্রসিদ্ধ ঘোলের কদর বেড়েছে।’


বিজ্ঞাপন


তাঁর কথা, সারা দিন রোজা রাখার পর টক দইয়ের ঘোল পরিপূর্ণ তৃপ্তি মেটানো ছাড়াও হজমে সাহায্য করে। রোজাদারদের প্রশান্তি মেটাতে ঘোলের জুড়ি নেই।
গরমের দিনে ঐতিহ্যবাহী দইয়ের জেলা হিসেবে খ্যাত বগুড়ায় রোজাদারদের ইফতার আয়োজনে প্রশান্তি দিচ্ছে এখানকার প্রসিদ্ধ টক দইয়ের সুস্বাদু ‘ঘোল’।

এ পানীয়টি বগুড়ার শত বছরের ঐতিহ্য। ঘরোয়া আয়োজনে, হোটেল-রেস্তোরাঁ কিংবা অভিজাত মোটেলের ইফতার আয়োজনে ঘোল থাকছেই।

এবার চৈত্র মাসে রোজা হওয়ায় ইফতারে ঘোলের চাহিদা বেশি।

শহরে টক দই পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাত থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত ও প্রসিদ্ধ দইয়ের দোকানগুলোয়। মাটির হাঁড়ির পসরা সাজিয়ে বসছেন তারা। দোকান থেকে টক দই কিনে বাসায় নিয়ে বানানো হচ্ছে ঘোল। আবার দোকানে দোকানে বোতলজাত ঘোলও বিক্রি হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


bogura

মিষ্টি দই ছাড়াও বগুড়ায় তৈরি হয় টক দই। এর চাহিদা সারাবছর কম থাকলেও গরম ও রমজানে বেড়ে যায়। প্রতি বছর রোজাদারদের জন্য টক দইয়ের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয় ব্যবসায়ীদের। 

সারা বছর বিভিন্ন প্রয়োজন ছাড়াও ইফতারে রোজাদারদের কাছে অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে বগুড়ার টক দই। রোজাদার মানুষেরা নানা উপায়ে ইফতারে খেয়ে থাকেন এই সাদা বা টক দই।

করোনার আঁধার কেটে যাওয়ায় এবার শহরে ইফতার আয়োজনও বেশ জমজমাট। আর প্রতিটি আয়োজনেই অবধারিতভাবে থাকছে ঘোল। দোকানিরা বলছেন, রমজানে প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ মণ দুধের টক দই বেচাকেনা হচ্ছে।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়নের হাতীবান্ধা ঘোষ পাড়া থেকে এক সময় শহরে আসতেন ঘোল এবং টক দই বিক্রি করতে। তারা এখনও দই তৈরির পেশার সাথে জড়িত থাকলেও সময়ের ব্যবধানে এখন আর ফেরি করে বিক্রি করতে হয় না। শহরের বিভিন্ন দইয়ের দোকান মালিক তাদের কাছ থেকে অর্ডার দিয়ে টক দই কিংবা ঘোল তৈরি করে বাজারজাত করছেন। 

টক দই এবং ঘোলের জন্য আরেক প্রসিদ্ধ জায়গা বগুড়ার শেরপুর উপজেলা। সেখানকার হোটেল সাউদিয়ার ম্যানেজার হুমায়ুন কবীর ও জলযোগ হোটেলের স্বত্বাধিকারী পরিমল দাস বলেন, তাদের তৈরি বোতলজাত ঘোলের ব্যাপক চাহিদা থাকে রমজান মাসে। এছাড়া চৈত্র ও বৈশাখ মাসে তাপদাহ বেশি থাকায় ঘোলের চাহিদা বাড়ে। 

এছাড়া শহরের কাঁঠালতলা, বড় মসজিদ লেন, ফতেহ আলী বাজার থেকে শুরু করে শহরের অলিগলিতেও দইওয়ালারা ভারে করে টক দই বিক্রি করছেন। ফুটপাত ছাড়াও শহরের সাতমাথা, কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, ফতেহ আলী বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার অভিজাত দোকানগুলোয় ঘোল তৈরির টক দই বিক্রি জমে উঠেছে। 

শহর ঘুরে দেখা গেছে, শহরের সাতমাথায় শেরপুর দই ঘর, আলহাজ মহরম আলী দই ঘর, আদি মহরম আলী দই ঘর, রফাত দই ঘর, চিনিপাতা দই, কবি নজরুল ইসলাম সড়কে ফুড ভিলেজ, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, শ্যামলী হোটেল, এশিয়া সুইটস, দইঘর, গৌরগোপালের দইঘরে প্রসিদ্ধ টক দই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি হাঁড়ি টক দই (আনুমানিক ৫০০ গ্রাম) ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা এবং ফুটপাতে প্রতি হাঁড়ি টক দই ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

শহরের কাঁঠালতলা এলাকায় রেললাইনের ওপর মাটির হাঁড়িতে করে খোলা ঘোল বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। ২৫০ গ্রামের ছোট হাঁড়ি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। এ ছাড়া শেরপুর দইঘরসহ বিভিন্ন দোকানে ২৫০ গ্রামের ঘোল ২৫, আধা লিটারের ঘোল ৫০ এবং ১ লিটার ঘোল ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রফাত দইঘরের মালিক দুলাল হোসেন বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর দুধের দাম বেড়েছে। উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এ কারণে দাম কিছু বেড়েছে। বেচাবিক্রিও ভালো।

সাতমাথায় প্রসিদ্ধ টক দই কিনতে আসা শহরের মালতীনগর এলাকার সুইন চৌধুরী বলেন, ‘ঘোল’ ছাড়া ইফতার অপূর্ণই থেকে যায়। ইফতারের আয়োজনে যাই থাক, টক দইয়ের ঘোল থাকতেই হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুষ্টিগুণে ভরপুর টক দই সব বয়সী মানুষের শরীরে পূরণ করে নানা ঘাটতি। রোজার দিনে তো বটেই টক দই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণেও রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে, খাবার প্রক্রিয়ায় তাতে চিনি বা মিষ্টি যুক্ত না করার পরামর্শ তাদের।

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডা. কাজী শান্তনুর রহমান  বলেন, 'টক দইয়ে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট আছে। এছাড়াও ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম থাকায় টক দই থেকে দুধের সমপরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়। টক দইয়ের ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত উপকারী, এটা শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়িয়ে হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।‘

এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর