শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ছোট যমুনার এ কী হাল!

সুমন আলী
প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০২২, ০২:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ছোট যমুনার এ কী হাল!

নওগাঁ শহরকে দুইভাগ করে বয়ে গেছে ছোট যমুনা নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করে নওগাঁ শহরসহ নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে অনেক জনপদ ও হাট বাজার। নদীটিতে এক সময় ঢেউয়ের তালে চলাচল করতো অসংখ্য পালতোলা নৌকা। কিন্তু এই নদীর অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। বর্ষাকালে পানির প্রবাহ থাকলেও শুকনো মওসুমে প্রতি বছর পানি শুকিয়ে যায়। ফলে বর্ষাকালে কিছুটা নৌকা চলাচল করলেও শুকনা মওসুমে একেবারেই চলাচলের কোন সুযোগ থাকে না। এককালের খরস্রোতা এই নদীটি এখন শুধুই স্মৃতি। বুক ভরা বালি নিয়ে নদীটি এখন তার ফুরানো যৌবনের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলছে। এখানে এখন চাষ হচ্ছে ইরি-বোরো ফসল, তাছাড়া মারাত্মকভাবে দখল আর দূষণের শিকার হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

দিনাজপুর জেলার ইছামতি নদী পাবর্তীপুর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নে ছোট যমুনা নাম ধারণ করে নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের শুটকীগাছা নামক স্থানে আত্রাই নদীতে পতিত হয়েছে। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নে তিলাই, নওগাঁ ধামইরহাট উপজেলার ইছবপুর ইউনিয়নে চিরি, নওগাঁ সদর উপজেলার নিকট তুলশীগঙ্গা এবং চিরি এ নদীতে পতিত হয়েছে। চিরি এ নদীর শাখা নদী। স্থানীয়রা জানান, ফেব্রুয়ারি মাসের আগেই এ নদীর প্রায় অংশই শুকিয়ে যা। এছাড়া চাষাবাদ করায় ধীরে ধীরে নদীটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং পানি প্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


এই নদীর প্রকৃতি সর্পিলাকার, ১৯৫ কি: মিটার দীর্ঘ ও গড় ৮৫ মি. প্রস্থ। প্রবাহিত গতিপথ দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর, পাবর্তীপুর, ফুলবাড়ী, বিরামপুর, হাকিমপুর, জয়পুরহাটের সদর ও পাঁচবিব, নওগাঁর সদর, ধামুইরহাট, বদলগাছী, রানীনগর ও আত্রাই উপজেলা। এই নদীর তীরে গড়ে উঠছে, দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরসভা, ফুলবাড়ী পৌরসভা, হাকিমপুর পৌরসভা, জয়পুরহাটের জয়পুরহাট পৌরসভা ও পাঁচবিবি পৌরসভা।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, ছোট যমুনা নদী এককালে বারমাসই প্রবহমান ছিল। বৃটিশ ও পাক-শাসনামলে এলাকার রাস্তাঘাটগুলি অবহেলিত অবস্থায় থাকায় সে সময়ে এই নদীই ছিল বিভিন্ন শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র পথ। নদীটির বুক চিরে ছোটবড় হরেক রকমের পালতোলা বড় বড় কোষা নৌকা দিয়ে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করত। নৌকায় করে মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসল ধান, গমসহ বিভিন্ন পণ্য বহন করত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে। এই নদীর পানি সেঁচ কাজে ব্যবহার করে এলাকার মানুষ হাজার হাজার একর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপাদন করত। এ ছাড়াও সারা বছর মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবীরা। নদীর উজানে ভারতীয় অংশে বাঁধ নির্মাণের ফলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় কালের আবর্তনে হারিয়ে গেছে নদীর শাসন ব্যবস্থা সেই সঙ্গে নদীও হারিয়ে ফেলেছে তার ঐতিহ্য। বেকার হয়ে পড়েছে নদী নির্ভর শতশত মৎস্যজীবী।

CHOTO JAMUNA

এখন বছরে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মাস পানি থাকে এসব নদীতে। বছরের বাকি মাস নদীটি ধুধু বালুচরে পরিণত হয়। এখন অতি সহজে মানুষ বাস, ট্রাকযোগে স্বল্প সময়ে পৌঁছে যাচ্ছেন তাদের গন্তব্যে। সহজেই তারা তাদের বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করতে পারছেন। এখন নদীপথের প্রয়োজন অনেকটাই ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে এই নদীটি হারিয়ে ফেলেছে তার অতীত ইতিকথা। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির তোড় ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নদীটি তার পূর্ণযৌবন ফিরে পেলেও খরা মৌসুম মাস আসতে না আসতেই নদীটি মরা খালে পরিণত হয়। খরা মৌসুমে হঠাৎ কেউ দেখলে মনেই হবে না এটি একটি নদী।


বিজ্ঞাপন


এ ছাড়াও শহরের ভেতর দিয়ে ছোট যমুনার নদীর দুই পাশে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র চালকল গড়ে ওঠায় এসবের ছাই ও বর্জ্য নদীর সাথে মিশে এর পানি ব্যবহারে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই পানি ব্যবহার করলে খোস পাচরাসহ নানাবিধ চর্ম রোগ দেখা দেয়। নদীর পানি শুকিয়ে গেলেও রেহাই নেই। তখনও বয়লারের ছাই নদীতে ফেলে দিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করা হয় বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। 

নদী পাড়ে বসবাসকারী পার-নওগাঁর বৃদ্ধ রঞ্জন দাস বলেন, ছোট যমুনা নদীতে এক সময় ঢেউয়ের তালে অসংখ্য পাল তোলা নৌকা চলাচল করেছে। নদীর পানিতে ধান, গম, সবজি চাষ, বাড়ীর কাজ, কাপড় ধোয়াসহ সকল কাজ সম্পন্ন করেছি। অথচ গত কয়েক বছর আগে থেকে বছরের অর্ধেক মাস পানি থাকে না। এতে তাদের ব্যাপক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।

নওগাঁ সদর উপজেলার সুলতানপুর মহল্লার জেলপাড়ার মৎস্যজীবী ধীরেন্দ্রনাথ, কাইয়ুম উদ্দিন ও এমদাদুল হক জানান, বছরের অর্ধেক সময় নদীতে পানি না থাকায় তারা মাছ ধরতে পারেন না। এতে অনেক মৎস্যজীবীর পথে বসতে হয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু মৎস্যজীবী তাদের পূর্বপুরুষদের আদি পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

ইকরতারা নদী পাড়ের সাইফুল জানান, এই নদীর পানি দিয়ে সারা বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করা যেত। বোরো ফসলের মাঠে সেঁচ দেয়ার জন্য পানির কোনো চিন্তাই করতে হতো না। কিন্তু এখন আর নদীর বুকে সেঁচ দেয়ার মতো পানি নেই। নদীর বুকে চাষ করা হচ্ছে বোরো ধান। এছাড়া নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীতে স্রোত কমে পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে গেছে। তাই থেমে গেছে নৌকা চলাচলও। তিনি নদী খনন করার দাবি জানান।

নজরুল ইসলাম নামের এক কৃষক বলেন, ছোট যমুনা নদীটি স্থানীয়দের জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। আগে নদী গভীর ছিল, নদীর পানি দিয়ে তীরবর্তী এলাকার জমিতে চাষাবাদ হতো। আবার কেউ কেউ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নদীতে চলাচল করতো নৌকা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে খনন না করায় নদীর গভীরতা কমে যায়। নদীতে এখন পানি থাকে নাই বললেই চলে। বর্ষা মৌসুমে কিছু সময় পানি থাকলেও বাকি সময় শুকনা খটখটে। পানি না থাকায় নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে অনেকেই ধানসহ নানা ধরনের চাষাবাদ করছেন।

নওগাঁ শহরের বাসিন্দা শেফালি বলেন, ছোটবেলায় এই নদীতে অনেক গোসল করেছি। এই নদীর পানি দিয়ে রান্না-বান্নার কাজও করেছি কিন্তু বর্তমানে নদীর পানির গন্ধে নদীর তীরে এসে বসার জো নেই। দূষণ আর দখলের কবলে এক সময়ের যৌবনদীপ্ত নদীটি বর্তমানে মরতে বসেছে। কারো নজর নেই নদীটির দিকে। আমাদের সবার উচিত আগামীর সুন্দর প্রজন্ম ও সুস্থ্য পৃথিবীর জন্য এই নদীগুলোকে বাঁচানোর জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া।

choto jamunaনওগাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাড. ডিএম আব্দুল বারী বলেন, নদ আর নদীর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু শিল্প কারখানা ও জনসংখ্যার বিস্ফোরণের কারণে নদীগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে আবার অনেক নদী মানচিত্র থেকে ইতিমধ্যই বিলীন হয়ে গেছে। তেমনই একটি নদী আমাদের এই ছোট যমুনা নদী। সুন্দর বাংলাদেশের জন্য এই নদীগুলোকে পুনরায় জীবিত করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। কারণ এই নদীগুলো যদি এক সময় হারিয়ে যায় প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশও তখন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বন্যার কবলে পড়বে দেশের অধিকাংশ নিম্নাঞ্চলগুলো। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। কখনও কখনও এই নদীকে সার্বিকভাবে রক্ষার জন্য বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ভূমিকা রেখেছেন। তাদেরও দাবি দেশের অন্যান্য নদীর মতো নওগাঁর ঐতিহ্য ছোট যমুনা নদীটিকে দূষণ আর দখলের হাত থেকে রক্ষা করা হোক।

নওগাঁ সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও পরিবেশবিদ শরীফুল ইসলাম খান বলেন, ‘খুব বেশি আগের কথা নয়। আশির দশক জুড়েই নদীটির ভরা যৌবন ছিল। আসতে আসতে ক্রমেই যৌবন হারাতে বসে নদীটি। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, নদীটির আর হারানোর কিছুই নেই। সরু মরা খালে পরিণত হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীটি। ভরা যৌবনে এই নদীর ঢেউয়ের তালে চলাচল করত পাল তোলা অসংখ্য নৌকা। এ নদীকে অবলম্বন করে অসংখ্য মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবন জীবিকার সহজ পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। বর্তমানে নদীটি ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়েছে। এতে ভরাট হয়ে স্বাভাবিক নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নদীগুলোর দুই তীর দখল হয়ে সেগুলো ধীরে ধীরে সর্পিলাকার ধারণ করছে। নদ-নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। 

এগুলোকে অবিলম্বে পুনঃখনন করার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। এছাড়া নদী দূষণ রোধ করতে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এখনই সঠিক উদ্যোগ নেয়া না গেলে একসময় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি প্রধান এই এলাকা।’

তিনি বলেন, বর্তমানে ছোট যমুনা এই নদীটি ড্রেজিং ব্যবস্থায় সংস্কার করে তার নাব্যতাকে ফিরিয়ে আনলে নদীটি ফিরে পেত তার পূর্ণ যৌবন। সেই সাথে কৃষি কাজে ব্যবহার হতো তার পানি। উপকৃত হতো নদী পাড়ের হাজার হাজার লোকজন।

এ ব্যপারে জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান জানান, ইতিমধ্যে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য নদী খননের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করি প্রস্তাবনা পাস হলেই দ্রুত এর কাজ শুরু করতে পারবো। 

ছাই ও ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলে নদীর তলদেশ ভরাট ও জায়গা দখল করা হচ্ছে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে অত্যন্ত সচেতন। এছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যমেও আমরা কাজ করছি যাতে করে পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে। তবে বয়লারের ছাই ও ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলে নদীর তলদেশ ভরাট করা হচ্ছে এমন অভিযোগ পেলে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর