শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পিলার নেই, দাঁড়িয়ে আছে ‘জ্বিনের মসজিদ’

মো. জাহিদ হাসান মিলু
প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০২২, ১০:২৯ এএম

শেয়ার করুন:

কোনও পিলার নেই। প্রশস্ত দেয়ালের ওপরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আস্ত একটি মসজিদ। দেখলেই মনে হয় কী যেন এক অদ্ভুত কেরামতি। মসজিদের কারুকার্য যেমন নিখুঁত, নির্মাণশৈলীও তেমনি আকর্ষনীয়। একবার কেউ দেখলেই বিস্মিত হন। এরপর ইতিহাস শুনলে চলে যান শতাধিক বছরের পুরোনো দিনে। 

বলছিলাম ‘জ্বিনের মসজিদ’ এর কথা। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ছোট বালিয়া নামক স্থানে এ মসজিদটি অবস্থিত। রাতারাতি জ্বিনরা নির্মাণ করেছিলেন বলে শতাধিক বছরের পুরনো এ মসজিদটি জ্বিনের মসজিদ নামে পরিচিত। 


বিজ্ঞাপন


জানা যায়, মসজিদটি তৈরি হয়েছিল এক রাতেই। জ্বিন-পরীরা সারারাত জেগে এই মসজিদ বানিয়েছে। অনেক রকমের কারুকার্যময় অলঙ্করণ ও পুরু দেয়াল গড়তে গড়তে রাত শেষ হয়ে যায়। দিনের আলোয় জ্বিন-পরীরা থাকে না, তাই গম্বুজের কাজ শুরু না করেই তারা চলে যায়। অসম্পূর্ণ থেকে যায় মসজিদটি—ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে প্রচলিত আছে এমনই লোককাহিনী।

স্থানীয় ও বালিয়া চৌধুরী পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৩২৭ হিজরি ও বাংলা ১৩১৭ সালে বালিয়ার জমিদার হাজী মেহের বক্স সরকার এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মেহের বক্স সরকারের স্ত্রী গুলমতি নেছা নিজের জমিদারি কর দেওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘চৌধুরানী’ উপাধি পান। সেই সূত্রে চৌধুরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন হাজী মেহের বক্স সরকার। এ সময়ে তিনি বালিয়াতে এক মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করেন। সে লক্ষ্যে দিল্লি থেকে কারিগর এনে মসজিদ তৈরির কাজ শুরু করেন। ইট তৈরির এক বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিলো তখন। 

সে সময় খুব একটা ইটের ভাটা ছিলো না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা হতো ইট তৈরির প্রক্রিয়া। 

মসজিদ নির্মাণের কাজ কিছুটা অগ্রসর হওয়ার কয়েকদিন পর প্রধান কারিগরের আকস্মিক মৃত্যুতে নির্মাণ কাজ থেমে যায়। পরবর্তীকালে হাজী মেহের বক্স চৌধুরী স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে কাজ শুরু করলেও তারা ছাদ ও গম্বুজ নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়। এরই মধ্যে হাজী মেহের বক্স চৌধুরীর মৃত্যু হয়। আবারও থেমে যায় মসজিদ নির্মাণের কাজ।


বিজ্ঞাপন


অব্যবহৃত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে সেই স্থানটি জঙ্গলে পরিণত হয়। সেখানে বাস করতে থাকে বাঘ, বানর, সাপসহ বিভিন্ন জীবজন্তু। তখন ভয়ে কেউ যেতো না ওখানে। ওখান দিয়ে গা ঝম ঝম করতো।

অর্ধনির্মিত অবস্থায় এভাবেই শত বছর ধরে পরে থাকে অসমাপ্ত এই মসজিদটি।

পরবর্তীতে এলাকায় মসজিদের প্রয়োজন দেখা দিলে সেই অর্ধনির্মিত মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন বালিয়া চৌধুরী পরিবারের সন্তান শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীন চৌধুরী, শাহীদ জাকিরুল হক চৌধুরী, মরহুম সাইফুল আলম, নুরুজ্জামান চৌধুরী, মরহুম আনসারুল হক চৌধুরী প্রমুখ। 

বালিয়া চৌধুরী পরিবারের সন্তান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক-স্থপতি সৈয়দ আবু সুফিয়ান মূলত মসজিদটির পুনঃনির্মানের পরিকল্পনা করেন। ভগ্ন দশা থেকে মসজিদটিকে বর্তমান এই রূপ দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একদল শিক্ষার্থী সেই মসজিদ পরিদর্শন করে সংস্কার করার ইতিবাচক মনোভাব দেখালে সেই শিক্ষার্থীরা ও কিছু শ্রমিকসহ মসজিদের জঙ্গল-আগাছা পরিস্কার করেন। শুরু করেন মসজিদের ঐতিহ্যকে অবিকৃত রেখে পুননির্মাণের কাজ। মসজিদটির পুননির্মাণ কাজের তদারকি করেন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। 

এই কাজের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মেহের বক্স চৌধুরীর পৌত্র মরহুম বসরত আলী চৌধুরীর কন্যা, শিল্পপতি তসরিফা খাতুন। বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রাচীন মসজিদ একেবারে ব্যক্তিগত চেষ্টায় পরিপূর্ণ করে তোলার ঘটনা একেবারেই বিরল।

মসজিদটিতে কোনও পিলার নেই। প্রশস্ত দেয়ালের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর এই মসজিদ। দেয়ালের চাইতে নিচের দিকের প্রশস্ততা অনেক বেশি। ভিত্তি পর্যন্ত প্রশস্ততা বেড়েছে।

৩ গম্বুজ ও ১৬ মিনার বিশিষ্ট মসজিদটির আয়তন, পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি। আয়তাকার কমপ্লেক্স ‘সিঁড়িসহ প্রবেশপথ’, ‘খোলা চত্বর’ ও ‘মূল ভবন বা নামাজঘর’—এই তিনটি অংশে বিভক্ত। মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্রবেশপথ খোলা চত্বর ও মূল ভবন একই প্লাটফর্মের ওপর অবস্থিত। স্থানভেদে সাড়ে ৩ ফুট থেকে সাড়ে ৪ ফুট গভীর ভিত্তি ও ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের ওপর মসজিদটি স্থাপিত। প্লাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট। ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত। মসজিদটির দরজা ৩টি জানালা ২টি। মসজিদটির তিনটি অংশ হলো—মূল কক্ষ, মূল কক্ষের সঙ্গে ছাদবিহীন বরান্দা, বারান্দাটি অর্ধ প্রাচীরে বেষ্টিত হয়ে পূর্বাংশে মাঝখানে চার থামের ওপর ছাদ বিশিষ্ট মূল গেট বা দরজা।

ঐতিহ্যবাহী পুরাতন মসজিদের কথা শুনে পরিবার নিয়ে দিনাজপুর থেকে দেখতে আসেন মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি। 

তিনি বলেন, ‘মসজিদটি দেখে অনেক ভালো লাগলো। দেখে আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না, মনে এমন একটি অনুভূতি জাগে ও মনে প্রশান্তি আসে এবং জ্ঞানের বিকাশ হয়।’

মসজিদটি দেখার জন্যই রংপুর জেলা থেকে আসেন মো. ইনতাজুল ইসলাম নামে এক দর্শনার্থী। তিনি বলেন, ‘দূর থেকে কষ্ট করে আসাটা সার্থক হয়েছে। গ্রামে যে এতো সুন্দর মসজিদ থাকতে পারে, যা বলার মতো না। আমার কাছে মনে হয় যে আমি লন্ডনের কোনো একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।’

বালিয়া চৌধুরী পরিবারের ষষ্ঠ পুরুষের সদস্য মো. আফগান চৌধুরী ঢাকা মেইলকে জানান, এটি জ্বিনের মসজিদ না। আমাদের প্রথম পুরুষ হাজী মেহের বক্স চৌধুরী বাংলা ১৩১৭ সালে মসজিদটি স্থাপন করেন। এটি ‘ছোট বালিয়া জামে মসজিদ’ নামেই পরিচিত। ১৩১৭ সালে হাজী মেহের বক্স চৌধুরী মারা যাওয়ার ফলে মসজিদটি অর্ধনির্মিত হয়ে পড়েছিল। ফলে এখানে জঙ্গল হয়েছিল। আর এখানে বাঘ বাস করতো, ছোটবেলায় আমরা ভয়ে এখানে ঢুকতাম না। এখানে এক দরবেশও বাস করতেন। তিনি মসজিদের মিম্বারে ঘুমাতেন। পরে আমাদের চৌধুরী পরিবারের প্রচেষ্টায় ও অর্থায়নে ২০০৮-১০ সালে মসজিদটি পুনঃনির্মাণের কাজ করা হয়। পুনঃনির্মাণের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন আমাদের চাচা প্রাক্তণ চেয়ারম্যান মৃত আনছারুল হক চৌধুরী। তাঁর ও আমাদের বংশের সকলের উদ্যোগে আমাদের ফুফু শিল্পপতি তসরিফা খাতুনের অর্থায়ণে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়।

মসজিদের খাদেম মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘মসজিদটি আসলে স্থাপন করেছেন তৎকালীন এ এলাকার জমিদার হাজী মেহের বক্স চৌধুরী। পরবর্তীতে তাদের বংশধরদের সহযোগিতায় পুনরায় এটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এটি হয়তো জ্বিনে নির্মাণ করেছে কথাটা মিথ্যা। সত্যটি না জানার ফলে প্রচার হয়ে গেছে যে এটি জ্বিনের নির্মিত মসজিদ।’

তিনি আরও বলেন, এখনও এই মসজিদের অনেক কাজ বাকি আছে। যদি প্রধানমন্ত্রী মসজিদটিতে সহযোগিতা করেন, তাহলে এটিকে আরও উন্নত করা যাবে। 

সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান জানান, মসজিদটি ইতোমধ্যে জেলার পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হচ্ছে। এখানে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন। এটাকে সংষ্কারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং মসজিদটিকে আরো ভালো করার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এইচই/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর