শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দুর্গাপুরের সৌন্দর্যলীলা

মহসিন মিয়া
প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০২২, ০২:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

দুর্গাপুরের সৌন্দর্যলীলা

ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানান নিদর্শন আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্রময় জীবনধারা ও প্রাচুর্য্যময় মনোমুগ্ধকর জনপদ নেত্রকোনার সুসঙ্গ দুর্গাপুর। ঘন সবুজ গারো পাহাড়, টিলা আর নদী-ছড়াবেষ্টিত এ জনপদের দিকে দূর থেকে তাকালে মনে হয়— এক খণ্ড ঘন কালো মেঘ যেন সেই কবে থেকে মিতালী করে আছে আকাশ-মাটির সঙ্গে। মেঘালয় সীমান্তের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্গাপুরে রচিত হয়েছে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের আদিবাসী ও বাঙালিদের এক অপার মেলবন্ধন। গারো বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, টঙ্ক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, হাতিখেদা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বহু বিপ্লব-বিদ্রোহের নীরব সাক্ষী এই দুর্গাপুরের সৌন্দর্যলীলা বর্ণনা করে শেষ হওয়ার নয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক সুন্দরের ঐশ্বর্যে ভরপুর দুর্গাপুরের কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।

গারো পাহাড়: 
দুর্গাপুরের উত্তর দিকে গারোপাহাড়। এসব পাহাড়ের অধিকাংশ ভারতের সীমানায় অবস্থিত। আর বাংলাদেশের সীমানায় আছে কিছু পাহাড়ী টিলা। ইচ্ছা করলে এসব টিলায় ওঠাও যায়। টিলার চূড়ায় দাঁড়িয়ে চোখ মেললেই দেখা যায়— ঘন সবুজে আবৃত বিশাল বিশাল পাহাড়। কিছু কিছু পাহাড় গড়িয়ে নীচের দিকে নেমে এসেছে ঝরনার মতো স্বচ্ছ জলধারা। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বলা হয় ছড়া। এখানে পাহাড় দেখার সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানগুলো হচ্ছে— রানীখং, ভবানীপুর, বিজয়পুর, আড়াপাড়, গোপালপুর এবং কালিকাপুর।


বিজ্ঞাপন


DURGAPURচিনামাটির খনি:
অপার সৌন্দর্যের জনপদ দুর্গাপুরের বিজয়পুর, বিপিনগঞ্জ, গোপালপুর প্রভৃতি এলাকায় রয়েছে অনেকগুলো চিনামাটির খনি। চীনা মাটি মূলত সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল। চীনা মাটির এসব টিলা বা পাহাড় দেখতে খুবই মনমুগ্ধকর। বাহারি এর মাটির রঙ। লাল, সাদা, নীলাভ— এ যেন আরেক প্রাকৃতিক নিসর্গ। এ দেশে সাদা মাটির অন্যতম বৃহৎ খনিজ সম্পদ অঞ্চল এটি। নেত্রকোনা জেলার উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ বিজয়পুরের সাদা মাটি। ১৯৫৭ সালে ভূতত্ত্ব জরিপে দুর্গাপুরের বাগাউড়া গ্রামে সর্ব প্রথম সাদা মাটির সন্ধান মিলে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সালে সরকারের খনিজ সম্পদ বিভাগ এ সাদা মাটির পরিমান নির্ধারণের জন্য ১৩টি কূপ খনন করে। ১৯৭৫, ১৯৭৮, ১৯৮০ ও ১৯৮৩, সালে সরকার ব্যাপক ভাবে ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালায়। সাদা মাটির এ এলাকাটি দৈর্ঘ্যে ১৪ কিলোমিটার, প্রস্থে ৬শ’ মিটার। অধিকাংশ সাদা মাটির টিলা ১৫ থেকে ৪০ মিটার পর্যন্ত উঁচু। ভূ-পৃষ্ট থেকে ৬০ মিটার গভীর পর্যন্ত সাদা মাটির অস্থিত্ব রয়েছে বলে জানা গেছে। 

চীনে এ মাটির সর্ব প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল বলে অনেকের কাছে এ সাদা মাটি চীনা মাটি হিসেবেও পরিচিত। এ সাদা মাটিকে বিজয়পুর অঞ্চল থেকে উত্তোলন করা হয় বলে এ দেশে এটিকে অনেকে বিজয়পুরের সাদা মাটিও বলেন। এ মাটিকে সাদা মাটি বলা হলেও এর রং একেবারে সাদা নয়। হালকা ধূসর থেকে সাদাটে রঙের এ মাটি কোনও কোনও স্থানে মসৃণ, কোথাও খসখসে। শুকনো অবস্থায় এ মাটি শক্ত ও ভঙ্গুর থাকে। ভিজলে তা আটালো ও নরম হয়ে যায়। 

বিজয়পুরের সাদা মাটি নিয়ে রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ মাটিতে সিলিকন অক্রাইড দশমিক ৪ থেকে ৬৮ শতাংশ। টাইটনিয়াম অক্রাইড দশমিক ৪ থেকে ২ শতাংশ। ক্যালসিয়াম অক্রাইড সামান্য থেকে ১ শতাংশ। ম্যাগানেসিয়াম অক্রাইড সামান্য থেকে দশমিক ৮ শতাংশ। পাষ্টিসিটি ২০ শতাংশ। এ মাটির আপেক্ষিক ঘণত্ব ২.৫৫। ছোটবড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এ খনিজ অঞ্চল। চিনামাটি খননের সময় প্রতিটি পরত থেকে বেরিয়ে আসে নানা রংয়ের স্বচ্ছ পানি। বিশাল এলাকা জুড়ে চিনামাটি আহরণের দৃশ্যও মনোমুগ্ধকর। কাছে গেলে দর্শনার্থীর দৃষ্টি কাড়বেই।

durgapurরাণীখং মিশন:
রাণীখং নামক পাহাড়ী টিলার ওপর অবস্থিত রাণীখং মিশন মূলত স্থানীয় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী গারোদের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত গারোদের জন্য এখানে ক্যাথলিক গীর্জা, মিশন ও ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠিত হয়। পাহাড়ী নদী সোমেশ্বরীর কূল ঘেঁষে নান্দনিক পরিবেশে অবস্থিত এই ধর্মপল্লীর প্রকৃত নাম ‘সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী’। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ‘রাণীখং মিশন’ নামেই পরিচিত। প্রায় আট হাজার বিশ্বাসী ভক্তকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ ধর্মপল্লীর সমতল থেকে ওপরের দিকে উঠতে উঠতে চোখে পড়বে সুদৃশ্য তোরণ, গারোদের ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণের ইতিহাস সম্বলিত ভাস্কর্য, যিশুর মূর্তি, গীর্জা, মিশনারী উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডিসপেনসারি ও বাগানসহ অনেক কিছু।  


বিজ্ঞাপন


রাশিমণি স্মৃতিসৌধ:
রাণীখং মিশনের খুব কাছেই বহেরাতলি গ্রামে অবস্থিত হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ। রাশিমণি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী টঙ্ক আন্দোলনের নেত্রী। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সৈন্যদের হাত থেকে কুমুদিনী হাজং নামক এক সদ্য বিবাহিতা রমণীকে উদ্ধার করতে গিয়ে রাশিমণি ও তার অনুসারীদের সরাসরি যুদ্ধ হয়। এতে কুমদিনী উদ্ধার হলেও রাশিমণি ও তার সহযোগী সুরেন্দ্র হাজং শহীদ হন। টঙ্ক আন্দোলনের এই গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিকে ধারণ করেই ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলি গ্রামে বেসরকারি উদ্যোগে ঐতিহাসিক এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। তীর-ধনুক আকৃতির স্মৃতিসৌধটি এখন দুর্গাপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রসঙ্গত, সেদিনের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া টঙ্ক আন্দোলনের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমদিনী হাজংয়েরও দেখা মিলবে ওই গ্রামেই। স্মৃতিসৌধের কাছেই একটি পাহাড়ী টিলায় বাস করেন তিনি।

সুসঙ্গ রাজবাড়ি:
১২৮০ খ্রিস্টাব্দে (৬৮৬ বঙ্গাব্দ) সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সাধু দুর্গাপুরে সুসঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠান করেন। তিনি ও তার বংশধররা দীর্ঘ সাড়ে ৬শ বছর দুর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে এ রাজ্য শাসন করেন। ’৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাশ হবার পর রাজ্যটি বিলুপ্ত হয়। কিন্তু বেশকিছু স্থাপনা এবং নিদর্শন আজও সেই রাজবংশের স্মৃতি বহন করে চলেছে। এরমধ্যে রয়েছে— দুর্গাপুর পৌরসভার কলেজ রোডে অবস্থিত মধ্যম বাড়ি, আবু বাড়ি ও দু’আনি বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, পুজোমণ্ডপ, দশভূজা মন্দির, রাজপুকুর, ইঁদারা প্রভৃতি। 

durgapurমধ্যম বাড়ির একটি ঘর বর্তমানে ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে, একটি কাছারি ঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে, বাড়ির ভেতরের কয়েকটি ঘর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে এবং আবু বাড়ির (ছোট হিস্যা) কয়েকটি ঘর সরকারী কর্মকর্তাদের বাসাবাড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া দু’আনি বাড়ির কয়েকটি ঘর ও পুজোমণ্ডপ রাজকর্মচারীদের বংশধররা ব্যবহার করছেন বলে জানা যায়। কাঠের তৈরি ঘরগুলোর নির্মাণশৈলী নান্দনিক। 

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমী:
দুর্গাপুর পৌর এলাকায় ঢুকতেই সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে সুদৃশ্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমী। দুই যুগ আগে বিরিশিরি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় গারো, হাজং, কোচ প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে একটু ঢু মারলেই চোখে পড়বে আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের দল বেঁধে নাচ-গানের প্রশিক্ষণ নেয়ার দৃশ্য। একাডেমীর সংগ্রহশালায় গেলে দেখা যাবে গারো-হাজংদের বৈচিত্রময় জীবনের নানা উপকরণ ও নিদর্শনের ছবি। সাজানো-গোছানো একাডেমীর পরিবেশটি অনেকটা পিকনিক স্পটের মতো মনে হবে প্রত্যেকের কাছে। 

Netrakona Birishiri Culturalআদিবাসীদের বৈচিত্রময় জীবনধারা:
দুর্গাপুরের বিরিশিরি, কুল্লাগড়া ও সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী গারো, হাজং, কোচ, বানাই প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের কারও বাড়ি সমতলে, আবার কারও বাড়ি পাহাড়ী টিলার ওপর। গারো পাহাড়ের বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে বসবাস এদের। আদিবাসীদের গ্রামগুলোতে ঢুকলেই দেখা যাবে গারো নারীদের কেউ কেউ জঙ্গল থেকে লাকড়ি কুড়াচ্ছেন। আবার কেউ পিঠের ওপর বাচ্চা ঝুলিয়ে কাজ করছেন কৃষি জমিতে। আদিবাসী সাইকেল বালিকারা দল বেঁধে ছুটে যাচ্ছে স্কুল-কলেজে। এসব দৃশ্য পরিচয় করিয়ে দেবে অন্য রকম এক জীবন বৈচিত্রের সঙ্গে। 

আরও যা কিছু... 
উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ কমরেড মণি সিংহের বাড়ি ও যাদুঘর, টঙ্ক স্মৃতিসৌধ, বিজয়পুরে অবস্থিত ভারত-বাংলাদেশের স্থলশুল্ক বন্দর, কারুকার্য খচিত মন্দির, গীর্জা, কমলা রাণীর দীঘি, জলসিঁড়ি পাঠাগার, চণ্ডিগড় আশ্রমসহ (মানবকল্যাণকামী অনাথালয়) আরও বেশ কিছু স্পট ঘুরে দেখা যেতে পারে এই জনপদে। দুর্গাপুর পৌরসভার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদীটিও দেখার মতো। গারোপাহাড় থেকে চপলা-চঞ্চলা ঝরনার মতো নেমে আসা এ নদী বর্ষায় রাক্ষুসী রূপ নেয়। ভাসিয়ে দেয় বিস্তীর্ণ জনপদ-ফসল। আর শুকনো মৌসুমে নদীর বুক জুড়ে থাকে কয়লা ও বিশাল বালিরাশি। সিলিকা (কাঁচ বালি) নামের এই বালিও নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। সোমেশ্বরীর দিগন্তজোড়া বালিরাশি আর নদীর তলদেশ থেকে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের কয়লা ও বালি আহরণের দৃশ্য খুবই কাছে টেনে নেয় আগন্তুকদের।

Netrakona Rashimoni Smriti Soudhদুর্গাপুর কতদূর? 
ঢাকা থেকে মাত্র পাঁচ ঘন্টার পথ দুর্গাপুর। মহাখালি থেকে বাসে উঠতে হয়। এরপর গাজীপুর চৌরাস্তা, ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ বাজার হয়ে সরাসরি পৌঁছানো যায় দুর্গাপুরে। প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস হলে সবচেয়ে আরামদায়ক হয়। তবে দুর্গাপুর সদর থেকে বিভিন্ন স্পটে যেতে হয় ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল, অটোরিকশা বা রিকশায় চড়ে। সব সময়ই যানবাহন পাওয়া যায়। মোটামুটি মানের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে দুর্গাপুরে। আছে বেশকিছু এনজিও পরিচালিত গেস্ট হাউজ, আবাসিক হোটেল এবং বিরিশিরি একাডেমির গেস্ট হাউজ। তবে আগে থেকে বুকিং দিয়ে গেলে কোনও ঝামেলায় পড়তে হয় না। শীত মৌসুম হচ্ছে দুর্গাপুরে বেড়ানোর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়। বছরের এ সময়টাতেই পর্যটকদের ভীড় একটু বেশী হয়। মাত্র দু’দিনেই ঘুরে দেখা যায় দুর্গাপুরের সব ক’টি স্পট।

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর