“আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন বাবা মারা যায়, অভাব অনটনের সংসারে মা কোনও উপায় না পেয়ে কিছুদিন পর আরেকটা বিয়ে করে নেন। সৎ বাবা আমাকে মেনে নিলো না। তখন আমি একা হয়ে যাই, আমাকে সরকারী শিশু পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই আমি বড় হই। আমার স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য হয়ে দেশের সেবা করবো। আমি শুনতাম চাকরি পেতে টাকা লাগে। তাই খুব চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু আবেদনের ফি বাদে কোনও প্রকার আর্থিক লেনদেন ছাড়াই চাকরি হয় সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না। আমি কল্পনাও করিনি, আমার মতো একজন এতিম ছেলের বিনা পয়সায়, মন্ত্রী-এমপির তদবির ছাড়া চাকরি হবে। আমি বাংলাদেশ পুলিশ ও জয়পুরহাট জেলা পুলিশ সুপার স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।” কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন— জয়পুরহাট জেলায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হওয়া আক্কেলপুর উপজেলার মির্জাপুর বড়গাছা গ্রামের মৃত মহসিন মন্ডলের ছেলে মো. আল আমিন।
মৌখিক পরীক্ষার পর চূড়ান্ত ফলাফলে নাম ঘোষণার পর আনন্দে কেঁদে ফেললেন স্মৃতি রানী সরকার নামের আরেকজন। তিনি বলেন— ‘আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, আমার বাবা একজন সিএনজি চালক। সিএনজি চালিয়ে ভাই বোনসহ আমার লেখাপড়া ও সংসার চালাতে বাবার হিমশিম খেতে হয়। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল পুলিশ হবো। কিন্তু বাস্তবায়নের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্রতা।
বিজ্ঞাপন
স্মৃতি রানী জানান, পরিচিতজনরা বলতেন— ‘পুলিশে চাকরি পাওয়া অত সহজ না। তোমার যতই যোগ্যতা কিংবা মেধা থাকুক, বড় অংকের টাকা ছাড়া চাকরি হবে না। পুলিশে চাকরি করতে হলে বাড়ি ঘর বিক্রি করতে হবে।’ কিন্তু সেসব কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হলো। মাত্র একশ’ টাকায় তার চাকরি হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশে। এমন স্বপ্ন পূরণে আবেগে আপ্লুত সে। এজন্যে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপারকে ধন্যবাদ জানান স্মৃতি রানী সরকার।
জয়পুরহাটে পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পেয়েছেন ২৫ জন। জেলা পুলিশ লাইন্সে মৌখিক পরীক্ষা শেষে শনিবার (৯ এপ্রিল) বিকেলে চূড়ান্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ সময় জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মাছুম আহাম্মদ ভুঞা নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
কনস্টেবল পদে নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত পাঁচবিবি উপজেলার কুলচ্য ছাতিনালি গ্রামের মৃত মনোয়ার সরকার এর ছেলে নাজমুল সরকার বলেন, ‘আমার বাবা আসামি গ্রেফতার করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। স্বপ্ন ছিল বাবার মত পুলিশে চাকরি করবো। এই চাকরি পেয়ে আমার যেন পৃথিবী হাতে মুঠোয় পাওয়ার মত মনে হচ্ছে। এসপি স্যার বলেছিলেন, কেবলমাত্র যোগ্যতার ভিত্তিতেই আমাদের চাকরি হবে। আমরা যেন দালাদের খপ্পরে না পড়ি। আজকে সেটি প্রমাণ হলো। এইভাবে চাকরি পেয়ে আমি আনন্দিত।
নাজমুল হোসেন নামের একজন পাশের চেয়ারে বসে থাকা বাবাকে জড়িয়ে ধরে গর্ব করে বলেন, ‘আমার বাবার জন্যেই আজ আমি পুলিশে নিয়োগ পেলাম। বাবা দিনমজুরের কাজ করে, বসতবাড়ি ছাড়া আমাদের কিছু নেই। অনেক কষ্ট করে বাবা মা আমাদের তিন ভাইবোনকে পড়াশোনা শেখাচ্ছেন। এমন অর্জনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন গরীব দিনমজুর (জয়পুরহাট উপজেলার জয়পার্বপর গ্রামের) নজরুল ইসলাম। কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি স্বপ্নেও ভাবিনি টাকা ছাড়া শুধুমাত্র যোগ্যতার মূল্যায়নে আমার ছেলের পুলিশে চাকরি হবে। আমি জয়পুরহাট পুলিশ সুপার স্যারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
শনিবার (৯ এপ্রিল) বিকেলে জয়পুরহাটে পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পরীক্ষায় চূড়ান্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ অভিনন্দন জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে এভাবেই নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন মাত্র একশ’ টাকায় পুলিশে চাকরি পাওয়া জয়পুরহাটের তরুণ-তরুণীরা।
বিজ্ঞাপন
এসময় নিয়োগ পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণদের দেশপ্রেম, সততা, পেশাদারিত্ব ও সেবার মনোভাব নিয়ে পুলিশ বিভাগে চাকরি করার আহবান জানান এসপি মাছুম আহাম্মদ ভুঞা। বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোতাহার হোসেন, সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (কামারখন্দ সার্কেল) শাহীনুর কবির, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) তরিকুল ইসলামসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন ।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সারাদেশের ন্যায় জয়পুরহাট জেলা পুলিশে কনস্টেবল পদে ২৫টি শুন্য পদের বিপরীতে এবার অনলাইনে জয়পুরহাটে মোট ৮৭৬ প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। নতুন নিয়মে প্রিলিমিনারি স্ক্রিনিং শেষে এদের মধ্যে ২৬১ জন প্রার্থী প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
এদের শারীরিক মাপ ও শারীরিক সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষা শেষে ১৯২ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষার জন্য বিবেচিত হন। তারা লিখিত পরীক্ষা দেন। এরমধ্যে ৬৮ জন উত্তীর্ণ হন। এদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে চূড়ান্তভাবে ২৫ জনকে (২১ জন ছেলে ও ৪ জন মেয়ে) নিয়োগের জন্য নির্বাচন করা হয়।
ফলাফল ঘোষণা শেষে পুলিশ সুপার (এসপি) মাছুম আহাম্মদ ভুঞা বলেন, সম্পূর্ণ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আমরা ২৫ জনকে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দিয়েছি। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দালাল ও প্রতারক চক্রকে দমন করার চেষ্টা করেছি এবং সক্ষম হয়েছি। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সুন্দরভাবে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ায় আমি ও আমার সদস্যরা অত্যন্ত গর্বিত ও আনন্দিত।
পরে চূড়ান্ত নিয়োগপ্রাপ্ত ও তাদের অভিভাবকদের জন্য ইফতারের আয়োজন করে জেলা পুলিশ।
এএ

