শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

পরিচ্ছন্ন রাজশাহীতেও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০২৩, ০৯:৫৫ এএম

শেয়ার করুন:

পরিচ্ছন্ন রাজশাহীতেও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু
ছবি : ঢাকা মেইল

পরিচ্ছন্ন নগরী রাজশাহীতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। চলতি মাসের শুরুতেই আলাদা ডেঙ্গু রোগীদের সেবায় আলাদা ওয়ার্ড চালু করেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবুও ক্রমেই ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে জেলার ডেঙ্গু পরিস্থিতি। 

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হিসেবে খ্যাত নগরীর ৩৮ শতাংশ বাড়িতেই মিলেছে এডিস মশার লার্ভা। সম্প্রতি নগরীর ১৫টি এলাকার ৭৫টি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষায় ২৮টি বাড়িতেই লার্ভার উপস্থিতি পায় স্বাস্থ্য বিভাগ। কোনো এলাকার ব্রুটো ইনডেক্স (এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের একক) ২০ শতাংশের উপরে হলেই সেই এলাকাকে ‘ডেঙ্গু ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। 


বিজ্ঞাপন


dengue rajshahi

তবে রাজশাহী নগরীতে ব্রুটো ইনডেক্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশে। অর্থাৎ রাজশাহী অধিকতর ডেঙ্গু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগকে পৃথক চিঠি দিয়েছেন রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও রামেক হাসপাতাল পরিচালক। তাই জরুরিভাবে ডেঙ্গু মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

রামেক হাসপাতালের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) রাত ৮টা পর্যন্ত হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৬৪ জন। এদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চার জন রোগী। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৪৬ জন রোগী। হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ১৭ জন রোগী। এদের মধ্যে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন একজন। 

dengue rajshahi


বিজ্ঞাপন


হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের সবার শরীরেই ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত রামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত একজনের (৪০) মৃত্যু হয়েছে। গত শনিবার (৮ জুলাই) সকাল পৌনে ১০টার দিকে হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। 

তিনি মুন্সিগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি সার্ভিসের কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে জ্বর নিয়ে ঈদের পরদিন বাড়ি আসেন। পরে গত ২ জুলাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ৪ জুলাই তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
 
জানতে চাইলে রামেকের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ইনচার্জ ডা. তানজিলুল বারি ঢাকা মেইলকে বলেন, হাসপাতালে ক্রমশই রোগী বাড়তেছে। সারাদিনে ৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে ১৭ জন রোগী ভর্তি আছেন, সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে। প্রথম দিকে ঢাকা থেকে আগত সব রোগীই পাচ্ছিলাম। এখন দু-তিন জন করে রাজশাহীর লোকাল রোগীও পাওয়া যাচ্ছে, যারা রিসেন্ট ঢাকায় যাননি।

এই মুহূর্তে এমন দুই জন রোগী আছেন যারা স্থানীয়ভাবেই আক্রান্ত হয়েছেন। ধীরে ধীরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মদ ঢাকা মেইলকে বলেন, রামেক পরিচালক বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়র, সিভিল সার্জন, ডিসিসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠির মাধ্যমে ডেঙ্গুর সবশেষ পরিস্থিতি জানানো হয়েছে। আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত ৬৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। 

প্রতিরোধের ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রতিরোধের উদ্যোগ তো আমাদের নেওয়ার নাই। প্রতিরোধের পুরো কাজটাই সিটি করপোরেশনের। জনগণকে সচেতন করা, লার্ভা নির্মূল করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান করা সব সিটি করপোরেশনের কাজ। হাসপাতালের কাজ হচ্ছে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া, পুরো পরিস্থিতি সংশ্লিষ্টদের জানানো। তারপরও সবাইকে সচেতন করার জন্য স্বপ্রনোদিতভাবে সমন্বিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ক্যাম্পেইন করেছি। 

অন্তত আমি আমার হাসপাতালকে এডিস মুক্ত রাখতে চাই, বাইরে গিয়ে তো করতে পারবো না। ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্যই রাজশাহী সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন হাসপাতাল পরিচালক। 

এদিকে রামেক হাসপাতালের পরিচালকের সিটি করপোরেশনে পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়, রামেক হাসপাতালে গত ১৫ জুন থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত ৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। ভর্তিকৃত ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ৪৯ জন ডেঙ্গু রোগীই ঢাকা ভ্রমণকারী। অবশিষ্ট ৪ জন ঢাকা ভ্রমণ করেন নি। ওই হাসপাতালে বিশেষায়িত ওয়ার্ড প্রস্তুত করে ডেঙ্গু রোগীদের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। জটিল ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আইসিইউসহ অন্যান্য চিকিৎসা সেবাও প্রস্তুত রয়েছে। 

রাজশাহীতে ডেঙ্গু রোগ শুরু হয়েছে যা পরবর্তীতে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত রোগ যা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অনিয়ন্ত্রিতভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান কষ্টকর হয়ে পড়বে বলেও সতর্ক করা হয়। 

এছাড়াও জরুরি ভিত্তিতে মশক নিয়ন্ত্রণ ও জন সচেতনতা সৃষ্টিসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে। 

এ ব্যাপারে রাসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফ এ এম আঞ্জুমান আরা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, লার্ভা থাকতে পারে। পরিবেশে তো মশা আছে, লার্ভাও থাকবে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছি, সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন মহানগরী। আমরা তো মশার ঔষধ দিচ্ছি, মশা কন্ট্রোলে রেখেছি। 

তাদের (স্বাস্থ্য বিভাগের) রিপোর্ট দেওয়ার আগেই আমরা প্রতিরোধের উদ্যোগ নিয়েছি। প্রতিটি ওয়ার্ডেই মনিটরিং কমিটি করে দিয়েছি, তারা দেখবে ড্রেনে লার্ভা আছে কি না। ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা এবং মশার বংশবিস্তার রোধ জরুরি। আগামী সপ্তাহে এসব কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে। ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো বাড়ি, ভবন ও প্রতিষ্ঠানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। 

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা সভাপতি আহমেদ শফি উদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, এই মুহূর্তে তো রাজশাহী সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধিহীন একটা অবস্থা চলছে। প্রশাসনিক সংকট বিরাজমান। অতীতে দেখেছি মেয়রের অনুপস্থিতিতে কাউকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দেওয়া হয়, সিনিয়র কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে যাকে প্যানেল মেয়র বলা হয়। এবার কেন তাকে দায়িত্ব না দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো- এর আইনগত দিকটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটাই প্রথম সংকট। 

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করছি, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলো জনগণের সেবামূলক কাজগুলোই করতো। বিগত প্রায় ২০ বছর ধরে দেখছি, সেবামূলক কাজের গুরুত্ব কমতে কমতে প্রকল্প ভিত্তিক কাজ বেশি হচ্ছে। এইটা একটা আমাদের সংকট। মশা নিধনের যে কর্মকান্ড সেটা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। আমাদের যে নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো ছিল, সেগুলোও স্থবির হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের অল্প টাকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। জায়গা আছে, ভবন আছে, কোটি কোটি টাকার সম্পদ আছে, কিন্তু ডাক্তার নাই, চিকিৎসাও নাই। এগুলো নিয়ে যেন কারো মাথা ব্যথাও নাই। 

বাজারের ভেতরকার যে পরিবেশ, দুর্গন্ধ, কাঁদা, একেবারে নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ও চরম অস্বাস্থ্যকর। এসব খুটিনাটি সামগ্রিক অবস্থা অবহেলিত হয়ে আছে। এখন ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি সেটা নিয়ে অবিলম্বে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। জরুরিভাবে মোকাবেলার ব্যবস্থা করা উচিত। জবাবদিহিতা কার দায়িত্ব কি সেটা অবিলম্বে নিরূপণ করে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসা উচিত। প্রশাসন হোক আর জনপ্রতিনিধিই হোক, কেউই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না বলেও জানান তিনি।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর