ছোট ভাই পিয়াসের ছবির সামনে বুকফাঁটা আহাজারি করছিলেন বড় বোন আজিজা সুলতানা। পাশে বসা পিয়াসের একমাত্র ভাগনে। আদরের মামাকে হারিয়ে তার চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়ছে পানি। কয়েকজন স্বজন তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তবে কোনো সান্ত্বনাই তাদের কষ্টকে থামিয়ে দেওয়ায় যথেষ্ট ছিল না।
একমাত্র ভাই হারিয়ে আহাজারি করতে করতে অনেকটা মূর্ছা যান আজিজা। কেঁদে কেঁদে বলছেন, 'আমার ভাইয়ের নিথর মুখটা চোখে ভাসছে। আমি এখন কাকে জড়িয়ে ধরে আদর করব? বাপ-মা মরা ভাইটা আমার কাছে নিজের সন্তানের মতো ছিল, সেই ভাইটাও আমাকে ছেড়ে চলে গেল।'
বিজ্ঞাপন
‘বাবা-মা হারা পিয়াস ছোট থেকেই মানুষ হয়েছে বোন-দুলাভাইয়ের কাছে। কখনো বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দেইনি। তার কোনো আবদারই আমরা অপূর্ণ রাখতাম না। আমাদের সেই আদরের ভাইটাকে সড়কে পড়ে জীবন দিতে হলো। বাসচালকরা যদি একটু সাবধান হতো, তাহলে হয়ত আমাদের ভাইটা মরত না।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নিহত পিয়াসের দুলাভাই মো. নজরুল ইসলাম।
গত সোমবার (৩ জুলাই) সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের রাজ্জাক প্লাজার সামনে আইল্যান্ড টপকিয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে গাড়ি চলাচলের লেনে যাওয়ার পর একটি বাসের ধাক্কায় সড়কে ছিটকে পড়লে পেছন থেকে আসা আরেকটি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান পিয়াস খান (২৮)।
পরে গতকাল মঙ্গলবার (৪ জুলাই) সাভারের মন্ডলবাড়ি করবস্থানে দাফন করা হয়েছে তাকে।
বিজ্ঞাপন
তিনভাই দুই বোনের মধ্য সবার ছোট ছিলেন পিয়াস খান। ছোটবেলায় পিয়াসের বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে বড় বোন আজিজা সুলতানার কাছেই বেড়ে উঠেন পিয়াস। দুলাভাই নজরুল ইসলাম সন্তানের মতো করেই যত্ন নিতেন তার। সাভারের রাজ্জাক প্লাজা নামে একটি মার্কেটে পিয়াসের কর্মসংস্থানের জন্য একটি থ্রি-পিসের দোকানও করে দেন তারা।
বুধবার (৫ জুলাই) সকালে সাভার পৌরসভার পশ্চিম রাজাশন এলাকায় নিহত পিয়াস খানের বোনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়। বাসার ড্রইংরুমে বসে এভাবেই ভাই হারিয়ে আহাজারি করছেন বোন আজিজা সুলতানা তাদের পাশের মলিনমুখে বসে আছেন নিহতের স্বজনদের অনেকেই। পিয়াস খানের সঙ্গে নানান স্মৃতিচারণ করতে থাকেন তারা।
ঘটনায় বাসের চালকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই তাদের। তবে তারা চান এভাবে যেন আর কারো সন্তান, ভাই, বোন, স্বজনকে হারাতে না হয়। সড়ক বিভাজক দেওয়া, সড়কের লেন বাড়ানো ও ফুটওভার ব্রিজের মধ্য দিয়ে সড়কের উন্নয়ন হলেও যথাযথ তদারকির অভাবে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি তাদের। তারা বলেন, এধরনের ঘটনা রোধে সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ তদারকি ও আইন না মানলে জরিমানাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
পিয়াসের দুলাভাই মো. নজরুল ইসলাম জানান, তিনি সিঙ্গাপুরে ছিলেন। ঈদের একদিন আগে দেশে এসেছেন। পিয়াসের জন্য বিদেশ থেকে নানা উপহারও নিয়ে এসেছিলেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোবাইলের স্ক্রিনে ছবি দেখাতে দেখাতে বলেন তিনি বলেন, ঈদের দিন ছেলে ও পিয়াসকে নিয়ে একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করে কুরবানি দিয়েছি। সদা হাস্যোজ্জ্বল পিয়াস সবসময়ই সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। ও এভাবে আমাদের ফেলে চলে যাবে এটা মানতেই পারছি না। সে যদি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না। আর বাসের চালকরাও যদি একটু সচেতন হতো তাও হয়তো আমার ভাইকে মরতে হতো না।
তিনি আরও বলেন, সবাই যদি এভাবে (আইল্যান্ড টপকিয়ে) সড়ক পার হয় তবে পিয়াসের মতো অনেকেই দেখে দেখে এভাবেই সড়ক পার হতে শিখবে। আইল্যান্ড টপকিয়ে পার হওয়া যায় এটা তো সে অন্যদের দেখেই শিখেছে। সবাই সহজে এভাবে সড়ক পার হয় তাই সেও পার হতে চেয়েছিলো। আমরা চাই আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে তাই যারা এভাবে সড়ক পার হবে তাদের জরিমানার আওতায় আনতে হবে।
এ ব্যাপারে সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, সড়কের নিরবিচ্ছিন্ন চলাচলের লেনে যাত্রী ওঠানামা করানো হলে আমরা ওই পরিবহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা ও জরিমানাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তবে এ ব্যাপারে যাত্রী ও পরিবহন চালক উভয়কেই আরও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি আইল্যান্ড টপকে সড়ক পার হওয়ার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা নিলে ভালো হয়।
প্রতিনিধি/ এইচই

