বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বান্দরবানের পথে পথে তৃঞ্চার্তদের জন্য চেহ্ রাইঃ ঘর

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৭ এপ্রিল ২০২২, ০৫:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

বান্দরবানের পথে পথে তৃঞ্চার্তদের জন্য চেহ্ রাইঃ ঘর

এক জায়গা থেকে দূরে অন্য জায়গায় যেতে রাস্তার ধারে, কোনও ছায়াসুশীতল বড় গাছের ছায়ায় দৃষ্টি পড়ে ছোট্ট একটি ঘর যেখানে রাখা আছে তিন-চারটি ভরা কলসি বা হাঁড়ি যেখানে কাছাকাছি কোনও পাড়া বা বসতি নেই, ক্লান্ত পথিক একটু জিরিয়ে নেয় বা বিশ্রাম করে পানির তৃঞ্চা মিটায় মার্মা সম্প্রদায় লোকেরা বলে চেহ্ রাইঃ আর চাকমারা বলে ধর্মঘর। কবে থেকে এই সংস্কৃতি চালু হয়েছে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না। তবে যে বা যারা এই চেহ্ রাইঃ ঘরটি তৈরী করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন তারা শুধু মনের তাগিদে বা পূণ্যের আশায় করে থাকেন।

ক্যামলং পাড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কের পাশে দুটি বড় অশ্বত্থগাছের মাঝখানে রয়েছে এমনই একটি চেহ্ রাইঃ ঘর। এটি শুধু শত শত মানুষের তৃঞ্চা-ই মেটায় না, চলাচলরত মানুষদের ঝড়বৃষ্টি থেকেও নিরাপদ রাখে ক্ষণিকের জন্য। 


বিজ্ঞাপন


এ নিয়ে ক্যামলং পাড়াবাসী খেই সাং উ মার্মা (৫৫) বলেন, ‘২-৩দিন পর পর কলসিতে পানি ভরে দিতে হয়।’ কেন করেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘পানি ছাড়া কোনও প্রাণী বাঁচতে পারে না,  মানুষ মৃত্যুর পথযাত্রীকেও পানি দেয়, তৃঞ্চার্ত মানুষকে পানি খাওয়ালে অনেক পূণ্য হয়।

তিনি আরো বলেন, পাড়ার লোকজন আসা-যাওয়ার পথে খেয়াল করেন কলসিতে পানি আছে কিনা! পানি না থাকলে কলসিতে যে কেউ পানি ভর্তি করে রাখেন। যেহেতু কাছাকাছি কোনও জনবসতি নেই, তাই পাড়া থেকে কাজ করতে আসা জুম চাষীসহ পথচারীদের তৃঞ্চা মেটানোর এবং ক্ষণিকের আশ্রয় স্থল হচ্ছে এই চেহ্ রাইঃ ঘরটি। বিশেষ করে ফাল্গুনচৈত্রমাসে, কিংবা বর্ষাকালে এটি পথচারীদের অনেক উপকারে আসে। 

chehrai ghor

ক্যমলং পাড়ার মংছো মার্মা (৬৫) নামের আরেকজন বলেন, ‘আদিকালে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা মাটির কলসিকে ফ্রিজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতো। মাটির কলসির মধ্যে পানি রাখলে সাধারণত চৈত্র মাসে পানি ঠান্ডা থাকে। সেজন্য নিজের মানবিক তাড়নায় মাটির কলসি ভর্তি পানি রাখা হয়। এই চেহ্ রাইঃ ঘর তৈরী করে ক্লান্ত পথিকের ঠান্ডা পানি দিয়ে পিপাসা মিটানো রোদ, ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের মার্মা সমাজে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায়ই দেখা মেলে এরকম পানি ভর্তি কলসিসহ ছোট্ট ঘর। মার্মাদের বিশ্বাস— কোনও ক্লান্ত-শ্রান্ত, তৃঞ্চার্ত পথিক এই ঘর থেকে পানি পান করলে যেই ব্যক্তি এই মহৎ কাজটি করেছেন তার উদ্দেশ্যে করে তৃঞ্চার্ত ব্যক্তি পিপাসা মিটিয়ে প্রাণ ভরে আর্শীবাদ করেন। 


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও বলেন, এই কাজটি করার মাধ্যমে আদিকাল থেকেই আদিবাসী জাতিসত্ত্বার লোকজনের সহজ সরল মানবদরদী হিসেবে তাদের পরিচয় ফুটে ওঠে। 

জামছড়ি মূখ পাড়া ও জামছড়ি পাড়ার মাঝামাঝি গাছের ছায়ায় আরেকটি চেহ্ রাইঃ ঘর, সেখানে এই ঘর সম্পর্কে মিথুই চিং মার্মা (৪৫) বলেন, যখন গাড়ী রাস্তা ছিল না, মানুষ প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে দূরবর্তী আরেক জায়গায় পায়ে হেঁটে যেতো, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে গেলে এই চেহ্ রাইঃ ঘরে রাখা ভরা কলসি থেকে তৃঞ্চা মিটিয়ে শারীরিক মানসিক প্রাণ শক্তি সঞ্চয় করে পুরোদমে আবার গন্তব্যস্থলের দিকে হাঁটা শুরু করতেন।

এই প্রতিবেদক সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন বান্দরবান সদর ইউনিয়ন এর জয় মোহন পাড়া, জামছড়ি ইউনিয়ন এর জামছড়ি মূখ পাড়া, কুহালং ইউনিয়নের থোয়াইঙ্গ্যা পাড়া, ক্যামলং পাড়াসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ক্ষণিকের আশ্রয়কেন্দ্র এই মানবতার ঘর দৃশ্যমান। যেখানে রাখা কলসি ও পানির গ্লাস কোনদিন কেউ চুরি করে না বা এর ক্ষতি সাধন করে না। 

এই চেহ্ রাইঃ ঘর সম্পর্কে বান্দরবান সদর উপজেলা ২নং কুহালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি সানু প্রু মার্মা (৭৫) বলেন, চেহ্ রাইঃ ঘর তৈরী করে পথচারীদের সাময়িক বিশ্রাম ও তৃঞ্চা মেটানোর কাজটি কবে থেকে শুরু হয়েছে সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও অনুমান করা যায় এই সংস্কৃতির প্রচলন শত শত বছর আগে থেকে— এতে কোনও সন্দেহ নেই। 

তিনি আরও বলেন, আগে নদীর ঘাটে যে পথ দিয়ে দৈনিক শত শত মানুষ নদী পারাপার হতো, রাস্তার দ্বিমূখী জায়গায় কিংবা বড় কোনও অশ্বত্থ গাছের নীচে এই চেহ্ রাইঃ ঘরটি দেখা যেতো, পথচারিও সেখান থেকে তৃঞ্চা মিটিয়ে যিনি ঘরও পানির ব্যবস্থা করেছেন সেই অজানা মানব দরদীর উদ্দেশ্যে করে আর্শীবাদ করেন। মানুষজন মূলত ধর্ম করা হবে, পূণ্য হবে, আর্শীবাদ পাবেন এই আশায় মানবতার কাজটি করেন। কারণ কলসির ভিতর শুধু ঠান্ডা পানি নয় গভীর মমতায় মানবতাও থাকে বলে এই প্রবীণ ব্যক্তি মন্তব্য করেন।

হ্নারা মৌজার হেডম্যান ও বান্দরবান সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রাজু মং মার্মা বলেন লামা, আলিকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা, রোয়াংছড়ি, থানছিসহ বান্দরবান জেলার ৭ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো পূণ্যের আশায় পাহাড়ের মানুষজন এই চেহ্ রাইঃ ঘর তৈরী করে পানীয় জল ও ক্ষণিকের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে থাকেন।

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর