বিশ্ব বাবা দিবসের (১৮ জুন) আগের দিন গোধূলী বেলায় কীর্তনখোলার নদী জলে সূর্যের ডুবন্ত রূপ পরেছে। রূপবতী কীর্তনখোলা নদীর ওপার থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রলার যাত্রী তোলার জন্য ভিড়ছে বরিশাল নদী বন্দর সংলগ্ন নগরীর প্রান্তে। খালি ট্রলারে বসে থাকা ট্রলার শ্রমিক পনির (১৪) উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত কণ্ঠে হাঁকডাক দিচ্ছে নৌপথের জায়গা খালি করতে। তার কণ্ঠে নেই কোনো শিশু সুলভ আওয়াজ। ইঞ্জিনের পাশে বসে যখন ট্রলারের হাল ধরে আছেন তার মামা মোকাম্মেল। তখন দক্ষ নেতৃত্বে সব ট্রলারের মধ্য থেকে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। এরই মধ্যে পনিরের ট্রলারে লাফ দিয়ে উঠে পরলো তার বন্ধু জিদনী (১৫)। দুজনের খুনসুটির মাঝে ট্রলার ভিড়লো তীরে। লাফিয়ে উঠে শক্ত হাতে ট্রলারের মোটা রশি বেঁধে হাফ ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো পনির।
নগরীর বাসিন্দা পনির (১৪) এই নৌবন্দরে গত তিন বছর ধরে ট্রলার শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে বাবা ট্রলার শ্রমিক জামাল শেখ, মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। অর্থাভাবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে বন্ধ করে দিয়ে ট্রলার শ্রমিকের কাজ নিয়েছেন। যে বয়সে তুলতুলে হাতে কলম থাকার কথা সেই বয়সে সংসার খরচের আংশিক যোগান দিচ্ছেন পনির। ভোর থেকে রাত অবধি আয়ের আড়াইশ টাকা প্রতিদিন তিনি তুলে দেন বাবা জামাল শেখের হাতে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব বাবা দিবস বিষয়ে অবগত না হলেও প্রতিদিন বাবাকে সংসার খরচ দিতে পেরে প্রতিদিনই ভালোবাসেন বলে জানান পনির। তবে বিশ্ব বাবা দিবসের (১৮ জুন) কথা জানতে পেরে জানান, ‘বাপেরে কাকলীর মোড় থেইক্কা গোলাপ কিন্না দিমু। এক বোয়াম চকলেটও নিমু।’ ফুল-খাবার তুচ্ছু করে বাবা যখন জানবেন তার সন্তান বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, তখন বাবার কেমন অনুভূতি হয় তা দেখতে চান পনির।
শিশু পনির আরও বলেন, বিশ্ব বাবা দিবস আলাদা কোনো দিন মনে হয় না। তবে প্রতিদিন যখন ঘামে ভেজা বাবাকে দেখি তখন খুব কষ্ট লাগে। তার চেহারা দিন দিন আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি যদি পারতাম তাহলে বাবাকে ঘরে বসিয়ে রাখতাম। এই অল্প বয়সে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব না বলে তা পারছি না। যদি কোনো দিনও অনেক টাকা আয় করতে পারি তখন বাবাকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াব। বাবার কষ্ট কমিয়ে যেদিন থেকে বিশ্রাম দিতে পারবো সেদিন থেকেই আমার আসল বাবা দিবস শুরু হবে। তবে প্রতিদিন যখন আমার আয়ের টাকা বাবাকে দেই তখন আমার খুব ভালো লাগে। নিজেকে মনে হয়, অনেক বড় হয়ে গেছি।
পনির আরও বলেন, প্রতিদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বাবার হাত ধরে নদীতে গোসল করতে যাই। গোসলের সময় বাবা শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখেন। তখন প্রায়ই বাবা বলেন, ‘এই নদী ছাইড়া তোর প্লেন চালাইতে হইবো’। বলেন তো, ‘কেউ কি নদীতে থাইক্কা প্লেন উড়াইতে পারে? প্রশ্ন পনিরের। আমার বাবা স্বপ্ন দেখে প্লেন চালাব। বাবায় বহুবার বলছে স্কুলে যেতে, বাবার কষ্ট কমাতে স্কুলে যাই না, কাম করি। আমার বাবা চায় প্লেন চালাবো, আমি চালাই ট্রলার। আমি চাই বাবা কাজ না করুক। তাহলেই আমি শান্তি পাবো। সে শান্তিতে থাকলেই আমার প্রতিদিন ভালোবাসা দিবস হবে।
হঠাৎ পনিরের ট্রলারে লাফ দিয়ে ওঠা বন্ধু জিদনীর (১৫) গল্পটা ভিন্ন। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বন্ধ করা এই জিদানী ৫ বছর ধরে ট্রলার শ্রমিকের কাজ করে প্রতিদিন তিনশ টাকা আয় করেন। তার বাবা নগরীর ভাটারখাল এলাকার বাসিন্দা স্টিমার ঘাটের শ্রমিক আবদুর রাজ্জাক। তিনি জিদনীর পাশে থেকেও নেই। প্রতিদিন জিদনীর বন্ধুরা যখন নিজের কাজ শেষে বাবার সঙ্গে ঘোরে-আড্ডা দেয় তখন তার বাবাকে কাছে না পেয়ে খারাপ লাগে। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় জিদনী দেখতে পায় তার ঘুম ভাঙার আগেই কাজে চলে গেছেন প্রিয় বাবা। তারপর সারাদিন ট্রলার শ্রমিকের কাজ শেষে রাতে যখন জিদনী বাড়ি ফেরে তখনও বাবা ঘরে ফেরেননি। প্রতিদিন ফেরার অপেক্ষায় বাবার মুখ না দেখেই ঘুমিয়ে যেতে হয় জিদনীর। বাবা দিবসের দিন পনিরের মত জিদনীও তার বাবাকে উপহারসহ ভালোবাসা দিতে চায়। কিন্তু যে বাবার সঙ্গে দেখাই হয় না, তাকে কিভাবে বাবা দিবসের ভালোবাসা দেবে তা ভেবেই জিদনী চোখ ছলছল করে পালিয়ে যায়...।
বিজ্ঞাপন
টিবি

