শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ইতিহাসের ভয়ংকরতম বিমান যুদ্ধ

এভিয়েশন ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ অক্টোবর ২০২২, ১১:৪২ এএম

শেয়ার করুন:

ইতিহাসের ভয়ংকরতম বিমান যুদ্ধ

সময়টা ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি। ইউরোপে তখন গ্রীষ্মকাল, কিন্তু নাৎসি জার্মানির জন্য সময়টা ছিল বসন্তের চেয়েও চমৎকার। কিছুদিন আগে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মিত্রশক্তিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে তারা। মাত্র ৪৬ দিনের যুদ্ধে গোটা ফ্রান্স নাৎসিরা দখল করে নিয়েছিল। একের পর এক রণাঙ্গনে সাফল্য দেখতে দেখতে তাদের আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে। সোভিয়েত রাশিয়া তখনও হিটলারের সঙ্গে বিবাদে জড়ায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সতর্কভাবে ইউরোপের এই গন্ডগোল থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিল। ফলে নাৎসিদের দৃষ্টি তখন ক্ষয়িষ্ণু  ব্রিটেনের প্রতি। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই আকাশপথে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা ছাড়া ব্রিটেন দখল করা একরকম অসম্ভব। সেই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকে সফল করতে ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে লুফৎওয়াফো ব্রিটেন হামলা শুরু করল। ইতিহাসের ভয়ংকরতম এই বিমান যুদ্ধ ‘ব্যাটেল অব ব্রিটেন’ নামে পরিচিত।

ব্যাটেল অব ব্রিটেনের পটভূমি


বিজ্ঞাপন


১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯, নাৎসি বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইউরোপে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। অবশ্য হঠাৎ করেই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এমনটা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তারও দুই দশক আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় জোট মিত্র শক্তির কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধের পর দুইপক্ষের মধ্যে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মান সাম্রাজ্যকে বিপুল পরিমাণ গোল্ড রিজার্ভ মিত্রশক্তির হাতে তুলে দিতে বাধ্য করা হয়। ছিনিয়ে নেওয়া হয় জার্মান সাম্রাজ্যের কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ভূখন্ড। উপরন্তু যুদ্ধ চলাকালীন সময় আফ্রিকায় সবগুলো কলোনি হারিয়েছিল জার্মান সাম্রাজ্য। ফলে রিক্ত, নিঃস্ব জার্মান সাম্রাজ্য থেকে অধুনাসৃষ্ট জার্মান রিপাবলিকে শুরু হল চরম অচলাবস্থা। এদিকে ১৯২০ এর দশকের শেষ দিকে সারা পৃথিবীতে শুরু হওয়া ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ অর্থাৎ ‘বৈশ্বিক মহামন্দা’ জার্মানবাসীর দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলল। ধূমকেতুর মতো হিটলারের উত্থানের মধ্য দিয়ে আবার সুদিন ফিরে আসতে শুরু করল জার্মানির। শক্ত হাতে হাল ধরে হিটলার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বদলে ফেললেন জার্মানির চেহারা। ফলস্বরূপ ১৯৩৮ সালে টাইমস ম্যাগাজিন এডলফ হিটলারকে ‘দ্য পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করে।

warতবে জাত্যভিমানি হিটলার জার্মানির অবস্থা একটু স্থিতিশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারানো জার্মান সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার এবং বিশ্বব্যাপী জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরাজিত এই যোদ্ধা বাকি জীবন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে জায়নিস্ট ইহুদি এবং কমিউনিস্টদের দায়ী করতেন। সে যা-ই হোক, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হুমকি উপেক্ষা করে হিটলার ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসলেন। উদ্দেশ্য জার্মান সাম্রাজ্যের হারানো অংশ ফিরে পাওয়া। মাত্র দুদিন পরেই অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তবে দুই সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিম পোল্যান্ড নাৎসি জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর ১৯৪০ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে একে একে ডেনমার্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড ও বেলজিয়াম নাৎসি জার্মানির কাছে আত্নসমর্পণ করল। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪০ সালের মে মাস পর্যন্ত চলা ঘটনাপ্রবাহে মারাত্মক তিক্ত হতে থাকে জার্মান ও ফরাসি-ব্রিটিশ মিত্রশক্তির সম্পর্ক এবং অবশেষে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। হিটলারকে শায়েস্তা করতে ধুকতে থাকা ফ্রান্সের সাহায্যে এগিয়ে আসল ব্রিটেন। ৩ লক্ষ ব্রিটিশ সৈন্য এবং ২,৫০০ ট্যাংক পৌঁছাল ফ্রান্সে। কিন্তু এত কিছুর পরও মাত্র ৪৬ দিনের মাথায় পতন ঘটল ফ্রান্সের। তবে সেখানে অবস্থানরত মিত্রবাহিনী ইউরোপের মূলভূমি ছেড়ে নিরাপদে ব্রিটেনে চলে আসতে পেরেছিল। এই প্রেক্ষাপট নিয়েই নির্মিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ‘ডানকার্ক’ মুভিটি।

ফ্রান্সের পতনের পর হিটলারের প্রত্যাশা ছিল এবার হয়ত ব্রিটেন খুব সহজেই একটা সমঝোতায় চলে আসতে চাইবে। ব্রিটেনের অনেক রাজনীতিবিদও সে রকমটাই চাচ্ছিলেন। কিন্তু একরোখা উইস্টন চার্চিল এত সহজে হার মানার মানুষ ছিলেন না। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, নাৎসিদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করবেন না। ১৭ জুন ফরাসিদের অস্ত্রসমর্পণের পর ১৮ জুলাই হাউস অফ কমন্সে এক ভাষণে তিনি ঘোষণা দিলেন,

ব্যাটেল অফ ব্রিটেন নামটার উৎপত্তি তখন থেকেই, যদিও ব্যাটেল অফ ব্রিটেন আরম্ভ হয়েছিল এই ভাষণের প্রায় ৩ সপ্তাহ পরে।


বিজ্ঞাপন


warশুরু হলো ব্যাটেল অব ব্রিটেন

চার্চিলের অবিচলতায় খানিকটা বিব্রত হিটলার প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করলেন স্থল, নৌ এবং আকাশপথে একযোগ ব্রিটেনে সর্বাত্মক হামলা চালানোর। অভিযানের নাম দেওয়া হল ‘অপারেশন সি লায়ন’। কিন্তু নাৎসি নৌবাহিনী হিটলারকে সাফ জানিয়ে দিল এ রকম উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার মত যথেষ্ট নৌ শক্তি নেই তাদের। নাৎসি বিমানবাহিনীকে লুফৎওয়াফো নামে ডাকা হত এবং ব্রিটিশ বিমান বাহিনীকে ডাকা হত রয়্যাল এয়ারফোর্স নামে। রয়্যাল নেভি ও এয়ারফোর্সের শক্তিমত্তা সম্পর্কে আগেই থেকে ওয়াকিবহাল ছিল জার্মানরা। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকা হিটলারকে আকস্মিক বিমান হামলার মাধ্যমে ব্রিটিশদের বাগে আনার বুদ্ধি দিলেন হিটলারের বিমানমন্ত্রী হারম্যান গোরিং। লুফৎওয়াফোর দাপট তখন চতুর্দিকে। গোরিং এর পরিকল্পনা ছিল বিমান যুদ্ধের মাধ্যমে রয়্যাল এয়ার ফোর্স ও নেভিকে একদম পর্যুদস্ত করে ফেলা এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এর ফলে নাৎসি বাহিনী নিরাপদে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ করে স্থল অভিযান চালাতে পারবে। গোরিং এর পরামর্শ মনে ধরল হিটলারের। হিটলারের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল বেসামরিক হামলা পরিহার করে ব্রিটিশ নৌ এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে একদম গুঁড়িয়ে দেওয়া।

শুরুতে লুফৎওয়াফো ব্রিটিশ জাহাজগুলোতে আক্রমণ করত। পরবর্তীতে রয়্যাল এয়ারফোর্সের ঘাঁটিগুলোও তাদের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। নাৎসিদের পরিকল্পনা ছিল আস্তে আস্তে ব্রিটেনের এভিয়েশন ইন্ড্রাস্টি, মজুদকৃত জ্বালানি এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও একদম ধ্বংস করে ফেলা। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তখনও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ফলে আপাতদৃষ্টিতে সহজ এই লক্ষ্য অর্জন ক্রমশ লুফৎওয়াফোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। কিন্তু নাৎসি বিমানবাহিনীর প্রতাপের সামনে বেশিদিন যে রয়্যাল এয়ারফোর্স টিকবে না, সেটা সহজেই অনুমেয় ছিল। তবে নাৎসিদের সামান্য ভুলে পরিস্থিতি হঠাৎ করে বদলে গেল।

২৬ আগস্ট ১৯৪০, লুফৎওয়াফোর কয়েকজন পাইলটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রচেস্টারে জ্বালানি তেলের বিশাল ডিপো বোম্বিং করে উড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু নাৎসি পাইলটরা টার্গেট খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এদিকে ব্রিটিশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এতদূর চলে এসে খালি হাতে ফিরতে মন চাইল না তাদের। দ্রুত জ্বালানীও ফুরিয়ে আসছিল। ফলে উঁচু বিল্ডিং দেখে নির্বিচারে বোম্বিং করল। দুর্ভাগ্যবশত, জায়গাটা ছিল রচেস্টার থেকে ৩২ মাইল দূরে খোদ ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডন! সাধারণ জনগণের উপর চালানো এই বিমান হামলাকে ইচ্ছাকৃত হামলা আখ্যায়িত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল নাৎসিদের পাল্টা জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ফলে রয়্যাল এয়ারফোর্সও বেসামরিক জনগণের উপর পাল্টা বোম্বিং করল বার্লিনে। এতদিন বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলা করতে নিষেধ করতেন হিটলার। এছাড়া সাদা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী হিটলারের ব্রিটিশদের প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধও ছিল। কিন্তু বার্লিনে হামলার পর উদ্ধত হিটলার লন্ডনকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। ১৯৪০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে লন্ডন এবং অন্যান্য শহরে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ শুরু করল লুফৎওয়াফো। শুরু হল যুদ্ধের নতুন এক অধ্যায়।

warদ্য ব্লিটজ

ব্যাটেল অব ব্রিটেনের শুরুতে নাৎসিদের উদ্দেশ্য ছিল রয়্যাল এয়ারফোর্সকে দুর্বল করে ‘অপারেশন সি লায়ন’ সফল করা। কিন্তু ঘটনা চক্রে সেই উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে গেল লুফৎওয়াফো। সামরিক স্থাপনা যেমন রানওয়ে, ওয়ার্কশপ এবং বিমানঘাঁটিগুলোতে আক্রমণের পরিবর্তে বেসামরিক স্থাপনায় হামলার ফলে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার সময় পেল রয়্যাল এয়ারফোর্স। অন্যদিকে প্রথমবারের মত যুদ্ধের উত্তাপ লাগল সাধারণ মানুষের গায়ে। বোমা হামলা থেকে বাঁচতে ভীত নগরবাসী কখনও সাবওয়েতে, কখনও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে শুরু করল। বোমার আঘাতে মৃত্যু হল অনেকের। হারিয়ে গেল অনেক শিশু। লন্ডন মিউজিয়াম এবং অন্যান্য সংগ্রহশালা থেকে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলা হল। মার্কেট এবং অফিসে অবিরাম বোমা বর্ষণের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন থমকে গেল। চালু করা হল রেশন। অনেক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হল গ্রামের দিকে।

জনমনে তখন সংশয় এবং উৎকণ্ঠা। হিটলার আসলে এটাই চাচ্ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ভয়ে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে বসতে রাজি হবে ব্রিটেন। কিন্তু অচিরেই এতে নাৎসিদের জন্য হিতে বিপরীত হল। যে যুদ্ধটা এতদিন ছিল লুফৎওয়াফো বনাম রয়্যাল এয়ারফোর্সের আচমকা সেটা পরিণত হল লুফৎওয়াফো বনাম ব্রিটেনবাসীর যুদ্ধে। কারণ অস্তিত্বের সঙ্কট মোকাবেলা করতে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না ব্রিটেনবাসীর। সর্বস্তরের ব্রিটিশ নারী ও পুরুষ রয়্যাল এয়ারফোর্সকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সাহায্য করতে শুরু করল। কেউ মিলিটারি ফ্যাক্টরীগুলোতে, কেউ শত্রু বিমান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে, কেউ বোমার আঘাতে জ্বলতে থাকা শহরের আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

রয়্যাল এয়ারফোর্সের প্রধান তখন হিউ ডোডিং। সীমিত সম্পদ দিয়ে তিনি অত্যন্ত কার্যকর এক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দাঁড় করালেন। এই সময়ে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন র‍্যান্ডাল এবং তাঁর পিএচডি ছাত্র হ্যারি বুট ক্যাভিটি ম্যাগনেট্রনের যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছিলেন যা ছিল সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করা রাডারের অন্যতম প্রধান অংশ। এই বিশেষ ধরনের রাডার মিত্রবাহিনীর বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

তাই বলা যায়, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যথেষ্ট অগ্রসর ছিল রয়্যাল এয়ারফোর্স। এদিকে উন্মত্ত লুফৎওয়াফোর ক্ষয়ক্ষতি দিন দিন বেড়েই চলল। ব্যাটেল অফ ব্রিটেনে লুফৎওয়াফোর জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর দিনটি ছিল ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪০। একদিনেই ৫৬টি বিমান হারাল জার্মানরা। অন্যদিকে রয়্যাল এয়ারফোর্স হারাল ২৮টি। এই ঘটনার মাত্র দুই দিন পরেই অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘অপারেশন সি লায়ন’ বাতিল ঘোষণা করেন হিটলার। ক্রমাগত হামলা চালানোর ফলে লুফৎওয়াফোর সামরিক শক্তি ও জ্বালানির নিদারুণ অপচয় হচ্ছিল। ফলে একপর্যায়ে নাৎসিরা বুঝতে পারল রয়্যাল এয়ার ফোর্সের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এই যাত্রায় সম্ভব নয়। তাই ‘অপারেশন সি লায়ন’ বাস্তবায়ন করাও অসম্ভব।

জার্মান হাই কমান্ড অপারেশন সি লায়নের পরিকল্পনা আপাতত বাতিল ঘোষণা করলেও ১৯৪১ সালের মে মাস পর্যন্ত লন্ডন ও অন্যান্য বড় শহরগুলোতে রাত্রিকালীন বোম্বিং অব্যহত রাখে লুফৎওয়াফো, যা দ্য ব্লিটজক্রিগ বা শুধু ব্লিটজ নামে পরিচিত। জার্মান ভাষায় ব্লিটজ শব্দের অর্থ বজ্র আর ক্রিগ মানে যুদ্ধ। রাত্রিকালীন বোম্বিং এর কারণ ছিল রয়্যাল এয়ার ডিফেন্সকে ফাঁকি দেওয়া। তবে ব্লিটজের ফলে নাৎসি জার্মানির শুধু সামরিক শক্তির অপচয় ছাড়া অন্য কোন লাভ হয়নি। ১৯৪১ সালে জুন মাসে রাশিয়া দখলের উদ্দেশ্যে নাৎসিরা সর্বকালের সর্ববৃহৎ স্থল অভিযান অপারেশন বার্বারোসা শুরু করে। বার্বারোসার প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৪১ সালের মে মাসে তারা ব্রিটেন ফ্রন্ট থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে অবসান ঘটে কুখ্যাত ব্লিটজের।

warব্যাটেল অব ব্রিটেনের সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ব্যাটেল অব ব্রিটেনে ৫৪৪ জন ব্রিটিশ ফাইটার পাইলট এবং এয়ার ক্রু নিহত হন। অন্যদিকে নিহত জার্মান পাইলট ও ক্রুয়ের সংখ্যা ছিল ২,৫৮৫ জন। জার্মানদের অধিক প্রাণহানীর মূল কারণ ছিল বিধ্বস্ত জার্মান বিমানগুলোর মধ্যে বোমারু বিমানের সংখ্যা বেশি ছিল। বোমারু বিমানে বেশি সংখ্যাক ক্রু দরকার হত। ফলে জার্মানদের নিহতের সংখ্যাও ছিল বেশি। এছাড়া বিমান বিধ্বস্ত হলে ব্রিটিশ পাইলটরা প্যারাস্যুটের সাহায্যে নিরাপদে নিচে অবতরণ করতে পারতেন, কিন্তু জার্মান ফাইটার পাইলটদের জন্য শত্রু এলাকায় অবতরণ করা ছিল ভয়াবহ বিপজ্জনক ব্যাপার। তা সত্ত্বেও এই যুদ্ধে ৯২৫ জন জার্মান পাইলট ও ক্রু বন্দী হন এবং আহত হন আরও ৭৩৫ জন। অন্যদিকে রয়্যাল এয়ারফোর্সের আহতের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪২০ জন। তবে ৪০ হাজার বেসামরিক ব্রিটিশ এই যুদ্ধে নিহত হন যাদের মধ্যে অর্ধেকই ছিল লন্ডনের নাগরিক। লন্ডন ছাড়াও ম্যানচেস্টার, প্লিমাউথ, লিভারপুর, সাউথ হ্যাম্পটনের মত বড় শহরগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ব্যাটেল অব ব্রিটেন বোমারু এবং ফাইটার মিলিয়ে লুফৎওয়াফো মোট ১,৯৭৭টি বিমান হারায়, অন্যদিকে রয়্যাল এয়ারফোর্স হারায় ১,৭৪৪টি। নিজেদের ভূখন্ডে যুদ্ধ করায় রয়্যাল এয়ারফোর্সের বিমানগুলো জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে জ্বালানী ভরে আবার ফিরে আসতে পারত। কিন্তু সেই সুবিধা লুফৎওয়াফোর ছিল না।

জার্মান যুদ্ধ বিমানগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল মেসারস্মিট সিরিজের বিমানগুলো। অন্যদিকে বোমারু বিমান হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল ডরনিয়ার, হেইনকেল, স্টুকা এবং জাঙ্কার সিরিজের বিমানগুলো। অন্যদিকে রয়্যাল এয়ারফোর্স নির্ভর করত তাদের সুপারমেরিন স্পিটফায়ার এবং হকার হারিকেন বিমানগুলোর উপর।

warতবে ব্যাটেল অফ ব্রিটেনের সবচেয়ে আশ্চর্য হওয়ার মতো তথ্যটি হল, এই যুদ্ধে প্রায় তিন মাসে মোট ৩,৭২১টি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজ অবধি বিধ্বস্ত বিমানের সংখ্যা মাত্র এগারশোর মত!

পরিসমাপ্তি

ব্যাটেল অব ব্রিটেন জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা বোঝার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী উইনস্টন চার্চিলের একটি উক্তিই যথেষ্ট। তিনি ব্যাটেল অফ ব্রিটেনে অংশ নেওয়া রয়্যাল এয়ার ফোর্সের সদস্যদের অভিহিত করেছিলেন ‘দ্য ফিউ’ বা ‘অল্প ক’জনা’ হিসেবে। তিনি বলেছিলেন। অর্থাৎ “মানব সভ্যতার ইতিহাসে এত অল্প কয়জনার কাছে এত বেশী ঋণী আর কেউ হয়নি।

সূত্র: রোর মিডিয়া

এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর