বিমান দুঘর্টনার কবলে পড়লে সবার আগে খোঁজা হয় এর ব্ল্যাকবক্স। বিমান পরিচালনায় এই যন্ত্রটি অভূতপূর্ব। এটাকে সবাই ব্ল্যাকবক্স নামে চিনলেও েএর আসল নাম ‘ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার।
নাম কেন ব্ল্যাকবক্স?
বিজ্ঞাপন
দেখতে গাঢ় কমলা রঙের যন্ত্রটিকে কেন ব্ল্যাকবক্স ডাকা হয় তা নিয়ে অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। মূলত আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত করা আছে যে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারের রঙ হতে হবে গাঢ় কমলা বর্ণ। এই গাঢ় কমলা রঙ ব্যবহারের কারণ হলো ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার এ ব্যবহৃত হয় উচ্চ তাপ সহনক্ষম গাঢ় কমলা বর্ণের পেইন্ট, আর এই বর্ণের তীব্রতা এত বেশি যে বিমানের ধ্বংসস্তুপে এটি সহজেই দৃশ্যমান হয়।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ‘ব্ল্যাক বক্স’ শব্দটি মূলত প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয় গণযোগাযোগ মাধ্যমের বহুল ব্যবহারের ফলে।
বিমান চলাচলে ব্যবহৃত পরিভাষা হিসাবে মূলত ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বা সংক্ষেপে ফ্লাইট রেকর্ডার হিসাবেই এই যন্ত্রটির পরিচয় উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তবে এই শব্দটি প্রচলন করার কৃতিত্ব মিডিয়ার একারই কিনা এই নিয়ে ও সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন ভাষাবিদরা।
আরেকটি স্বীকৃত ধারণা অনুযায়ী ব্ল্যাকবক্স শব্দটির উৎপত্তি হয় মূলত প্রথমদিকের বিমান বিষয়ক চলচ্চিত্রগুলো থেকে। যেখানে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখানো হয়ে থাকে নিখুঁত কালো রঙের যন্ত্ররূপে।
বিজ্ঞাপন
তবে ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারকে ব্ল্যাকবক্স হিসাবে ব্যবহারের প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায় বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত সংস্থার। ওই সংস্থার নাম এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্র্যাঞ্চ (এএআইবি)। সংস্থাটির ১৯৫৮ সালের আগস্টের মিটিংয়ে প্রথম শব্দটির ব্যবহার করেন এডোয়ার্ড নিউটন।
কার আবিষ্কার এই ব্ল্যাকবক্স
অস্ট্রেলিয়ার ডিফেন্স সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক ডেভিড ওয়ারেন ১৯৫৭ সালে ব্ল্যাকবক্স বা ফ্লাইট রেকর্ডার উদ্ভাবন করেন। এটি উদ্ভাবনের পর থেকেই বহুল ব্যবহৃত যন্ত্রের মধ্যে একটি হিসাবে পরিণত হয়। এর ব্যবহার শুরু হবার পর বিমান দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পায়। কারণ আকাশ পথে চলাচলকারী দুর্ঘটনাকবলিত বিমানগুলো থেকে ব্ল্যাকবক্স সংগ্রহ করে বিমান দুর্ঘটনার কারণগুলো আরো নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। পরবর্তীতে বিমান তৈরীতে এবং বিমান চালনা প্রশিক্ষণে এই তথ্যগুলো এক ইতিবাচক পরিবর্তন এর সূচনা করে এই ব্ল্যাকবক্স।
এই যন্ত্র কাজ করে কীভাবে
ব্ল্যাকবক্স বা ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার মূলত দুইটি প্রধান অংশের সমন্বয়ে গঠিত। এদের কাজগুলোর মাধ্যমেই মূলত পুরো যন্ত্রটির কাজ জানা যাবে।
১. ককপিট ভয়েস রেকর্ডার
এটি ব্ল্যাকবক্সের প্রধান অংশ এবং এটি মুলত ককপিট বা বিমানের চালনা কক্ষে থাকে। এটি বিমানের চালনাকক্ষের সমস্ত মাইক্রোফোন এবং ইয়ারফোনের শব্দ রেকর্ড করে থাকে। পাইলটদের নিজেদের মধ্যে কথা কিংবা কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে কথার সব কিছুই সংরক্ষিত থাকে ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে। প্রথম দিকের ককপিট ভয়েস রেকর্ডারগুলো অ্যানালগ তারভিত্তিক রেকর্ডিং সিস্টেম ব্যবহার করতো যা সাম্প্রতিক কালের ম্যাগনেটিক টেপ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বা ব্ল্যাকবক্স এর ককপিট ভয়েস রেকর্ডার অংশ
তবে সাম্প্রতিক ক্ষেত্রের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে পানিতে ডুবে যাওয়া বিমানগুলোর ম্যাগনেটিক টেপ থেকে শব্দ পুনরুদ্ধার করা খুবই কঠিন কাজ। তাই বর্তমানে ম্যাগনেটিক টেপ এর বদলে ‘সলিড স্টেট মেমোরি’ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
২. আন্ডারওয়াটার লোকেটর বিকন
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে ডুবে গেলে এই বিকন বা শনাক্তকারীগুলোর সাহায্যে বিমানের ধ্বংসস্তুপ পানির নিচে ঠিক কোথায় আছে তা জানা যায়।
আন্ডারওয়াটার লোকেটর বিকন /পানিতে নিমজ্জন শনাক্তকারী
এই ধরনের বিকন বা শনাক্তকারীতে মূলত লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেটি সচল বিমানে কয়েক বছর পরপর বদলানোর প্রয়োজন হয়ে থাকে। এটিতে থাকে বিল্ট ইন ওয়াটার-সুইচ যা যন্ত্রটি পানিতে নিমজ্জিত হবার সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায় এবং চালু হবার পর সর্বোচ্চ ৩০ দিন নাগাদ সংকেত পাঠাতে পারে। তবে ১ জুলাই ২০১৪ এর পর বানানো সকল উড়োজাহাজে যন্ত্রটিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে যার মেয়াদ ৯০ দিন। এই দুটি অংশ ছাড়াও আরো ক্ষুদ্র কিছু যন্ত্রাংশ ব্ল্যাকবক্সে ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা যন্ত্রটিকে আরো শক্তপোক্ত এবং দুর্ঘটনা ঘটার পরেও টিকে থাকতে সহায়তা করে।
লেজেই কেন এই ব্ল্যাকবক্স
ব্ল্যাকবক্স বা ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার মূলত বিমানের লেজের অংশে স্থাপন করা হয়ে থাকে যার ফলে এটি অনেক মারাত্মক দুর্ঘটনায়ও তুলনামুলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাক।
দুর্ঘটনার পরে খোঁজা হয়
বিমান নিখোঁজ হবার পরেই সকল তথ্য উপাত্ত হাতে নিয়ে শুরু হয় খোঁজাখুজি। ২০১৪ তে নিখোঁজ হওয়া ‘মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের” ফ্লাইট ৩৭০ এর বোয়িং বিমানটি খুঁজতে সারা বিশ্বের অনেকগুলো দেশ একসঙ্গে কাজ করছিলো। কিন্তু আজ অবধি ভারত মহাসাগরে ডুবে যাওয়া এই ফ্লাইট ৩৭০ এর ডানার কয়েকটা অংশ ছাড়া আর কিছুই পায়নি অনুসন্ধানকারীরা।
ব্ল্যাকবক্স ব্যবহার করে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত বিমান খুঁজে পাবার সফলতাও আছে অনেক, ব্রাজিলে ২০০৭ সালে ভুপাতিত হওয়া ‘গল এয়ারের’ ব্ল্যাকবক্সটি খুঁজতে ব্রাজিল সরকার ২০০ আর্মি নিয়োগ দেয় এবং রেকর্ড ৪ সপ্তাহ পর তারা সেটি খুজে পায়।
আন্তর্জাতিকভাবে বিমান চলাচল সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী গড়ে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা হয়ে সম্ভব হয়ে থাকে।
সূত্র: রোর মিডিয়া
এজেড