মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

জেরি মক: একা বিমান চালিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন যে গৃহিণী

এভিয়েশন ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ জুন ২০২২, ০৪:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

জেরি মক: একা বিমান চালিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন যে গৃহিণী

১৯৬৪ সালের কথা। মিশরের একটি ট্যাক্সিওয়ে থেকে বাঁক নিলো 'সেসনা ১৮০' বিমানটি। অন্য ট্যাক্সিওয়েতে থাকা তিন ট্রাক বোঝাই সশস্ত্র সৈন্যদল ধরে নিলেন নিশ্চয়ই কোনো গোয়েন্দা বিমান ঢুকে পড়েছে। উচ্চ শব্দ তুলে তারা ট্রাক থামাল বিমানের কয়েক ইঞ্চি দূরে। বন্দুক হাতে ঘিরে ধরল বিমানটিকে। ভেতরে তাকাতেই চমকে উঠল তারা। বিমান চালকের আসনে বসে আছেন একজন নারী! ১৯৫৩ সালের সেসনা ১৮০’র পাইলট হিসেবে পুরুষকে দেখে অভ্যস্ত তারা। তাই চমকে যাওয়াই স্বাভাবিক। সেই চমক আরও বাড়ল যখন পরে জানতে পারলেন এই নারী পেশাদার কোনো বিমান চালকও নন। জেরি মক নামের ৩৮ বছর বয়সী এই নারী একজন সাধারণ গৃহিণী, তিন সন্তানের মা। 

স্মরণীয় সেই অভিযানের কথা জেরি লিখেছিলেন তার ‘থ্রি এইট চার্লি’ বইতে। ত্রিপলি থেকে কায়রো যাওয়ার পথে কায়রো বিমানবন্দরে নামার বদলে ভুল করে গোপন এক সামরিক ঘাঁটিতে বিমান নিয়ে নেমে পড়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে সহজে মুক্তি পেলেও জেরির যাত্রা কম বিপদের ছিল না। তার পুরনো সেসনা বিমানের পাখায় কখনো জমত বরফ, কখনো ইঞ্জিনে ঢুকে যেত বাকি। এমনকি এন্টেনা মোটরও পুড়ে যাওয়া ঘটনা ঘটেছিল। 


বিজ্ঞাপন


তবে এসব বিপদ থামিয়ে রেখতে পারেনি জেরিকে। সব ঝামেলাকে পাশ কাটিয়ে ২৯ দিন, ১১ ঘণ্টা ৫৯ মিনিটের যাত্রা শেষে জেরির বিমান ফিরে এসেছিল কলম্বাস বিমানবন্দরে। সেদিন ছিল এপ্রিলের ১৭ তারিখ। ওহিয়োর গভর্নর জেমস এ রোডস জেরিকে নাম দিলেন 'ওহিওর সোনালী ইগল'। ১৮ এপ্রিলকে ঘোষণা করা হল ‘জেরি মক দিবস’ হিসেবে।

jerieজেরি যখন বেড়ে উঠছিল তখন মেয়েদের জন্য পুতুল খেলা কিংবা ঘরকন্নার কাজ করা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তার পাশে তেমন মেয়ে শিশু ছিল না। তাই জেরির শৈশব কাটে সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে কাউবয় খেলে। বিদ্যালয়ের নিয়ম ছিল মেয়েরা সেলাই ক্লাস করবে আর 

বিদ্যালয়ে নিয়ম ছিল মেয়েদের জন্য সেলাই ক্লাস, আর ছেলেদের জন্য মেকানিক্স। জেরি বললেন, তিনি সেলাই নয় বরং মেকানিক্স শিখতে চান। তার এমন ছেলেমি মোটেও পছন্দ করতেন না পাড়া-প্রতিবেশীরা। তারা ভাবতেন পরিবারের অতিরিক্ত আদরেই এমনটা হয়েছে। 

তখন জেরির বয়স মাত্র ৭ বছর। ‘ফোর্ড ট্রি-মোটর’ বিমানে ১৫ মিনিটের ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। যার প্রভাব পড়ে ছোট্ট মনে। জেরির কথায় সবাই পাত্তা দিতেন না। তবে যারা মন দিয়ে তার কথা শুনতেন তারা নিশ্চিত ছিলেন, এই মেয়ে বড় হয়ে আর কিছু হোক না হোক পাইলট হবেই। চক্কর দেবে পুরো পৃথিবী। 


বিজ্ঞাপন


jerieবিয়ের আগে জেরির মায়ের পদবী ছিল ‘রাইট’। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় তার নানার পরিবারের পূর্বপুরুষ হতে পারেন এমন শুনেছিলেন তিনি। তবে পাইলট হওয়ার ক্ষেত্রে তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল এমিলিয়া এয়ারহার্ট। তিনি ছিলেন প্রথম নারী যিনি একা আকাশপথে পৃথিবী ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। এরপর আর তার কোনো খোঁজ মেলেনি। 

মাধ্যমিকে থাকতেই বিমান চালনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া শুরু করেন জেরি। এখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। ওড়ার স্বপ্নটা সবসময় জেরির মধ্যে ছিল। সেই স্বপ্নকে বাস্তব করতে যা করা দরকার সব করেছেন তিনি। ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। 

ওড়ার স্বপ্নের মাঝে চোখে ধরা দেয় ভালোবাসা। রাসেল মককে ভালোবেসে ফেলেন জেরি। লেখাপড়া ছেড়ে ঘর বাঁধেন তার সঙ্গে। কিছুদিনের জন্য ছেদ পড়ে স্বপ্নে। 

jerie১৯৫৬ সালে জেরি যখন বিমানচালনা শেখা শুরু করলেন, প্রশিক্ষক, বন্ধুরা সবাই বুঝে গিয়েছিলেন এই মেয়ে ওড়ার জন্যই জন্মেছে। মাত্র নয় ঘণ্টার প্রশিক্ষণের পর একাই বিমান চালিয়েছিলেন এই নারী। লাইসেন্স পান ১৯৫৮ সালে। 

তখনকার চালকরা একই রুটে বিমান চালাতে অভ্যস্ত ছিলেন। এই বাঁধা ধরা নিয়ম ভালো লাগছিল না জেরির। যখন জানতে পারলেন, তাকে সাগরের উপর দিয়ে বিমানচালনা শেখানোর মতো কেউ কলম্বাসে নেই, তখন বিরক্তই হয়েছিলেন। তাই বলে, থেমে যাওয়ার মেয়ে জেরি নয়। 

নিজেই বিভিন্ন রুট খুঁজে বের করতেন বিমান চালনার জন্য। অভিজ্ঞরা অবাক হতেন। রেডিও ছাড়া এই মেয়ে পথ খুঁজে পায় কেমন করে! ১৯৬১ সালে ওহিওর প্রথম নারী বৈমানিক হন তিনি, যার বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনারও লাইসেন্স আছে। 
বিমানবন্দরে চাকরি হলেও খুব একটা কাজ করতে হতো না জেরিকে। একজন নারীর কাছ থেকে বিমান পরিচালনার উপদেশ নেওয়াকে পুরুষ নির্দেশকরা হাস্যকর ভাবতেন। কফি বানানোর মতো ছোট কাজ করতে হতো তাকে। একসময় জেরি কাজ ছেড়ে দেন। বুঝতে পারেন, এটি তার স্বপ্নের চাকরি নয়। 

jerieঘরের কাজেও মন বসে না তার। একদিন স্বামীকে জানালেন, পুরাদস্তুর গৃহিণীর কাজ করে তিনি ক্লান্ত, এখন তিনি অন্যকিছু করতে চান। রাসেলও মজা করে বলেছিলেন, "পৃথিবী চক্কর দাও"। স্বামীর কৌতুক জেরির জেদে পরিণত হলো। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তখনো পর্যন্ত কোনো নারী একা বিমানে পৃথিবী ঘোরেননি। সেই যে এমিলিয়া এয়ারহার্ট হারিয়ে গেলেন, এরপর আর এই এই পথে পা বাড়াননি। নেহাত শখের বশে পৃথিবী ঘোরার ইচ্ছাটা তখন একটা বিশ্বরেকর্ড করার লক্ষ্যে পরিণত হলো।

রাসেলের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ ছিল। ‘দ্য কলম্বাস ডিসপ্যাচ’ তাই জেরির স্পন্সর হতে রাজি হলো। তারপর রুট পরিকল্পনা, দেশে দেশে ছাড়পত্রের আবেদন, যেখানে যেখানে নামবেন সেখানে সময় দেখার লোক নিয়োগ করা, রেকর্ড সংরক্ষণ করার জন্য প্রথমবার ওড়ার সময় লোক ঠিক রাখা এসব কাজ করতে হয়েছিল জেরিকে। সব মিলিয়ে জটিল প্রক্রিয়া পার হতে হয়েছিল তাকে। 

তবে হিসাবে একটা গোলমাল শুরু হয়। জেরির দুই আগেই ক্যালিফোর্নিয়ার নারী জোন মেরিয়াম স্মিথ একই রেকর্ড গড়তে রওনা দেয়। ফলে জেরির শখের পৃথিবী ঘোরার রেকর্ড করার লক্ষ্য পরিণত হয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে। রুট পরিকল্পনায় যতটুকু সময় দেওয়া ছিল এর বাইরে না যেতে বার বার করে জেরিকে বলে দেন রাসেল। যে বিমানবন্দরেই তিনি নামতেন, রাসেল তার সাথে যোগাযোগ করে বলতেন, দ্রুত সব কাজ শেষ করে আবার রওনা দিতে।

ভাগ্য জেরির পক্ষেই ছিল। যান্ত্রিক কিছু ত্রুটির জন্য মেরিয়াম অনেক পিছিয়ে গেলেন। জেরির মতে, তিনি যখন রেকর্ড গড়ে বাড়িতে ফিরে আসেন তখন খবর পান, মেরিয়াম সিঙ্গাপুরে কেনাকাটা করছেন। সেসনা তাকে নতুন একটা বিমান দেয়। বিশ্বরেকর্ড করা পুরোনো বিমানটি এখনও সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে।

jerieরেকর্ড ভাঙার নেশা পেয়ে বসে জেরিকে। একের পর এক রেকর্ড ভাঙতে থাকেন তিনি। সবচেয়ে বেশি সময় একনাগাড়ে বিমান চালনার রেকর্ডটাও তার ঝুলিতে ছিল একসময়। বিশ্ব ভ্রমণের পর জেরি আবিষ্কার করেছিলেন, এটি তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। বরং তিনি সেই প্রথম নারীদের একজন ছিলেন যারা সুপারসনিক গতির বিমান চালনার সুযোগ পেয়েছিল। 

জেরির বিশ্ব ভ্রমণের পর নারীদের জন্য বিমানচালনাকে পেশা হিসেবে নেওয়া আগের থেকে সহজ হয়েছে। মাঝে মাঝেই তিনি তার ভক্তদের চিঠি পেতেন। তাদের চিঠিতে লেখা থাকত কিভাবে জেরি তাদের জীবন বদলে দিয়েছেন। নানা পুরস্কার ছিল তার দখলে। 

জীবনের শেষ দিকে নিঃসঙ্গতা সঙ্গী ছিল জেরির। তার নতুন বাসার পাড়া-প্রতিবেশীরা জানতেনই না যে, এই নারীই একসময় একটি সেসনা বিমান নিয়ে পুরো পৃথিবী পাড়ি দিয়েছিল। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্লোরিডাতে মারা যান জেরি। 
 
তথ্যসূত্র: রোর মিডিয়া 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর