শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সইচিরো হোন্ডা: মোটরসাইকেল যেভাবে হোন্ডা হয়ে উঠল

অটোমোবাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৪:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

সইচিরো হোন্ডা: মোটরসাইকেল যেভাবে হোন্ডা হয়ে উঠল

রাস্তায় যেকোনো ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল দেখলেই সেটিকে অধিকাংশ মানুষই হোন্ডা বলেন। কিন্তু সব মোটরসাইকেল হোন্ডা নয়। হোন্ডা জাপানের একটি মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড। তবে যেকোনো মোটরসাইকেলকেই হোন্ডা বলা হয় কেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অনেকের মনেই। কীভাবে মোটরসাইকেল হোন্ডা হয়ে ওঠেছে, সেই কাহিনি নিয়েই এই প্রতিবেদন।

সইচিরো হোন্ডা— হোন্ডা কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা এবং মোটরসাইকেল প্রস্ততকারক। বিশ্বের সকলের কাছে এই যানটি পরিচিত করে তোলার কাজটি করেন তিনি। তার নামেই মূলত মোটরসাইকেল হোন্ডা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।


বিজ্ঞাপন


সইচিরো হোন্ডার প্রাথমিক জীবনে শুরু

সইচিরো হোন্ডা ১৯০৬ সালের ১৭ নভেম্বর জাপানে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে সইচিরো তার বাবার সাইকেল মেরামতের কাজে সহায়তা করতেন।

Soichiro Hondaকাজের শুরু

১৯২২ সালে ১৫ বছর বয়সে তিনি কাজের উদ্দেশ্যে জাপানের রাজধানী টোকিওতে যান। টোকিওর ‘আর্টো শুকাই’ নামক একটি গাড়ি মেরামতের দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন হোন্ডা। পাশাপাশি ওই গ্যারেজ মালিকের আরেকটি রেসিং কার ডিজাইনের দোকানের কাজেও সহায়তা করেন। এরপর ১৯২৩ সালের ভূমিকম্পে গ্যারেজে আগুন ধরলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তখন হোন্ডা সাহসিকতার সঙ্গে তিনটি রেসিং কার রক্ষা করতে সক্ষম হন। তাই দোকানের মালিক তার ওপর খুশি হয়ে তাকে রেসিং কার ডিজাইনের কাজে সুযোগ দেন।


বিজ্ঞাপন


১৯২৪ সালের দিকে ‘জাপান রেসিং কার প্রতিযোগিতা’য় প্রথম স্থান অধিকারী দলের গাড়ীর কারিগর ছিলেন হোন্ডা। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে ‘আর্টো শুকাই’ টোকিওর একটি জনপ্রিয় সার্ভিস সেন্টারে পরিণত হয়। এরপর জাপানের বিভিন্ন জায়গায় গ্যারেজটির শাখা খোলা হয়। একটি শাখার প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেন হোন্ডা। ওই সময় তার বয়স ছিল একুশ বছর। তখন সেই সময়ের মাঝে পিস্টন বানানো শিখে যান।

Soichiro Hondaব্যর্থতায় পর্যবসিত

সইচিরো হোন্ডা পিস্টন রিং বানানোর পাশাপাশি ব্যবসায়িক কাজেও দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেন। মূলত এই চাকরি থেকেই তিনি একজন উদ্ভাবক হয়ে যান। নিজের জমানো টাকা এবং স্ত্রীর গহনা বন্ধক রেখে গাড়ির পিস্টন বানানো শুরু করেন। কিন্তু তার পিস্টনগুলো খুব একটা ভালো হচ্ছিল না। তাই তখন তিনি একটি টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন।

এরপর তিনি একটি রেসিং গাড়ি বানানোর কাজে মনোনিবেশ করেন। মূলত ফোর্ডের ইঞ্জিন ব্যবহার করে গাড়িটি বানাতে চেষ্টা করেন। তবে এক্ষেত্রেও তিনি সফলতা পাননি। রেসের মাঠে গাড়ির গতি ১০০ মাইল পর্যন্ত যেতে না যেতেই তা ভেঙে যায়। কিন্তু তাতে থমকে যাননি হোন্ডা। তখন গাড়ির স্পিড মেশিন ঠিক করাতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন তিনি।

১৯৩৬ সালের দিকে তিনি এক কার রেসিংয়ের ময়দানে মারাত্মক ভাবে আহত হন। দুর্ঘটনায় তার এক হাত ভেঙ্গে যায় এবং তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই সময় টয়োটা কোম্পানিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো তার ত্রিশ হাজার পিস্টনের মধ্যে থেকে মাত্র তিনটি কোয়ালিটি কন্ট্রোলে পাশ করে। এছাড়াও টেকনিক্যাল স্কুল থেকে অব্যাহতির নোটিশও হাসপাতালে বসেই পান।

Soichiro Hondaনতুন উদ্যমে আবারও শুরু

সইচিরো হোন্ডা ১৯৩৭ সালে ‘টোকাই সিকি’ নামে একটি কোম্পানি খুলেন। তখন তিনি পিস্টন বানানোর মধ্য দিয়েই কাজ শুরু করেন। তার বানানো ইউনিক পিস্টনগুলোর কোয়ালিটি অনেক বেশি ভালো হয়। সেগুলো তিনি আবারও টয়োটা কোম্পানির কাছে সরবরাহ করতে থাকেন। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হোন্ডা শুধুমাত্র টয়োটা কোম্পানিতেই প্রায় ৪০ শতাংশ পিস্টন সরবরাহ করতেন।

আবারও বাঁধা

১৯৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা বর্ষণে হোন্ডার ‘টোকাই সিকি’ প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে মাত্র সাড়ে চার লাখ ইয়েনের বিনিময়ে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি টয়োটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন।

Soichiro Hondaসফলতার শুরু

সইচিরো হোন্ডা এবার নিজের উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে স্কুটার বানানোর চেষ্টা করেন। নিজের ছোট গ্যারেজে বসেই তিনি স্কুটার বানাতে সফল হন। ১৯৪৬ সালে ১৭০ স্কয়ার ফিটের ছোট গ্যারেজেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘হোন্ডা টেকনোলজি রিসার্স ইন্সটিটিউট’।

মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে মটরাইজড বাইসাইকেল তৈরি এবং বিক্রির কাজ শুরু করেন। তখন টু স্ট্রোক ৫০ সিসি ওয়্যার সারপ্লাস রেডিও জেনারেটরের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হতো। ইঞ্জিন শেষ হয়ে গেলে নিজেই ইঞ্জিনের প্রতিলিপি  তৈরি করতেন। পরবর্তীতে সেগুলো সংযুক্ত করে বিক্রি করেন। এর মাধ্যমেই মূলত প্রতিষ্ঠান লাভবান হতে শুরু করে।

১৯৪৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি রূপান্তরিত হয় ‘হোন্ডা মোটর লিমিটেড’ কোম্পানিতে। কোম্পানিটি প্রথম মোটরসাইকেল তৈরিতে ব্যবহার করেন সাধারণ বাইসাইকেলের ইঞ্জিন। পানির বোতল দিয়ে বানানো তেলের ট্যাঙ্কে জাপানের সহজলভ্য ফির অয়েল নামক বিশেষ তেল ব্যবহার করেন। হোন্ডার উদ্ভাবনী শক্তি আর পরিশ্রমে বানানো ‘Choo-Choo’ নামক ১৫০০টি বাইক খুব দ্রুতই বিক্রি হয়ে যায়!

Soichiro Hondaবাইসাইকেল থেকে মোটরসাইকেল

১৯৪৯ সালে হোন্ডা প্রথম নতুন ধরনের মোটরসাইকেল প্রস্তুত করেন। ডি-টাইপের এই টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনের মোটরসাইকেল ‘ড্রিম’ নাম দিয়ে মার্কেটে নিয়ে আসেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ফোর স্ট্রোক বাইক উৎপাদন শুরু করেন এবং ‘সুপার কাব’ মডেলের একটি বাইক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আনেন। এভাবেই হোন্ডা কোম্পানি ১৯৬৪ সালের মধ্যেই সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারারে পরিণত হয়।

হোন্ডা কোম্পানির সফলতায় ইঞ্জিনিয়ার কিনশিরও কাউয়াশিমা এবং টাকিও ফুজিসাওয়াকে সহযাত্রী হিসেবে পান সইচিরো। এই দুইজন হোন্ডা কোম্পানির ব্যবসা এবং প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় বড় বড় কোম্পানি হোন্ডার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এভাবেই বিশ্বজুড়ে মোটরসাইকেল হোন্ডা হয়ে ওঠে।

Soichiro Hondaসইচিরো হোন্ডা ১৯৯১ সালের ৫ আগস্ট কিডনিজনিত জটিলতায় পৃথিবী ত্যাগ করেন। অটোমোবাইল তৈরির ইতিহাসে হোন্ডা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সইচিরো হোন্ডা থাকবেন চির অমলিন।

এমএইচটি/এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর