‘বিদ্রোহী’ কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যকর্ম। এমন কবিতা খুব সম্ভাবত সমগ্র পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি বিরল। কবিতাটি কবি নজরুলের গোটা সাহিত্য জীবনের সারাংশ হিশেবে বিবেচনা করা যায়। ভাষাগত দিক ও অন্তর্শক্তিতে কবিতাটি ন্যায়ের পক্ষে এবং অবিচার অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাবের চিরন্তন উৎস। 'বিদ্রোহী' সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জাতির সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-জায়মন। কাজী নজরুল ইসলাম এই কবিতার মাধ্যমে বৃটিশ শাসন-শোষণ, অসহিষ্ণুতা, অত্যাচার, অনাচার, দুরাচার, উৎপীড়ন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক তীব্র গণবিদ্রোহের ডাক দেন। কবিতার শব্দচয়ন, উপমা, ছন্দালংকার, শৈল্পিক গঠন, ভাষাশৈলী, প্রভুত পুরাণের বিপুল প্রয়োগ, চরণে চরণে তীব্র ভাবাবেগ এবং প্রবল শক্তির অনিবার্য সঞ্চার, বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে সূচনা করে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি মূলত একটি সার্থক আধুনিক কবিতা। কবিতাটি একদিকে দেশের পরাধীনতার তীব্রবেদনা, রাষ্ট্র-সমাজের বিপর্যস্ত অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যদিকে সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এক অন্তর্নিহিত যুদ্ধের সুরে লিখিত। এই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে বিরাজমান ছিলো এক অস্থির পরিবেশ ও সর্বত্র দুঃশাসন-অপশাসন, অসাম্য, সাম্প্রদায়িকতা। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল মহাভারতে। দেশবাসীর প্রাণপণ আন্দোলন এবং শহিদি-সংগ্রামে তখন নিশ্চিতভাবে সাহিত্যকর্ম সর্বত্র প্রভাবিত।
বিজ্ঞাপন
কাজী নজরুলও ছিলেন একাধারে দেশপ্রেমিক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত মিলিটারি সদস্য, একজন সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক, সমাজ সংস্কারক এবং গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তাই তাঁর কবিতা সমাজের অন্ধবিশ্বাস, অস্বচ্ছতা, অসাম্য, সাম্প্রদায়িকতা, দুঃশাসন, পরাধীনতা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বজ্রতুল্য প্রতিবাদ। এই কারণেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবির জীবনদর্শন থেকে উদ্ভূত বিশ্বাস, সারাবিশ্বের প্রপীড়িত ও অসহায়ের সপক্ষে সুতীব্র বিদ্রোহের ঐশ্বরিক সুর স্বতঃস্ফূর্তরূপে প্রকাশিত। তিনি বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করেছেন সমগ্র মানব জাতির আত্মসম্মান, মঙ্গল, মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের মাত্র ২২ বছর বয়সকালে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে রচিত। এই সময়কালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং তাদের অদ্ভূত শাসনকৌশলে [ভাগ করো; শাসন করো] ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রধান ধর্ম হিন্দু মুসলিমদের মাঝে দাঙ্গা লেগেই থাকতো। মহাভারতের সকল সম্পদ বৃটিশ বেনিয়া কর্তৃক অপহরণের ফলে উপমহাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে নিপতিত হয় বার বার। দিনে দিনে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র-প্রখর রূপ ধারণ করে। ঠিক সেই সময়ে কাজী নজরুলের কলম থেকে বের হয়ে আসে এটম বোমার মতো অমিত শক্তিপূর্ণ শব্দবোমার সুসজ্জিত বাক্যবিন্যাসের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। তবে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার একটি যোগসূত্র রয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২) দ্বারা কাজী নজরুল ইসলাম দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাই অনেকে মনে করেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব আছে।
অসহযোগ আন্দোলনের সমকালীন যুগে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচিত হয়। এই কবিতায় এই আন্দোলনের সমকালীন ভাবনার প্রতিফলন হইয়াছে কি? ইহার আলোচনার আগে অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে নজরুলের মনোভাবের পরিচয় দিয়েছি। ‘যুগবাণী’ গ্রন্থের মুখবন্ধ প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গে তিনি লিখিয়াছেন, “খুব সোজা করিয়া বলিতে গেলে নন-কো-অপারেশন হইতেছে বিছুটি বা আলকুসী এবং আমলাতন্ত্র ছুটাছুটি করিতে থাকে, এই আমলতন্ত্রও তেমনি অসহযোগিতা বিছুটির জ্বালায় বেসামাল হইয়া ছুটিছুটি আরম্ভ করিয়া দিয়াছে।”
বিজ্ঞাপন
অসহযোগ আন্দোলন সমগ্র ভারতে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করিয়াছিল। আসমুদ্রহিমালচল হইতে কম্পিত হইয়া ওঠে। -- ১৯২২ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাণ-পুরুষ গান্ধীজীর কারারুদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ব্যথিত কবি দেশবাসির চিত্তে মনবল সঞ্চারের জন্য লেখেন “অভয়মন্ত্র” কবিতা। চরকার মাধ্যমে দেশের শৃঙ্খলমুক্ত ত্বরান্বিত হওয়ার বিশ্বাস রুপায়িত হইয়াছে ‘চরকার গান’ কবিতায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কতগুলি ছত্রে অসহযোগ আন্দোলনের সমকালীন ভাবনার প্রতিফলন হইয়াছে।১
বৃটিশ আমলে ভারতের করুণ অবস্থা দীর্ঘমেয়াদি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের কুফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বৃটিশ রাজত্বের অধীনে ভারতবাসীর ওপর যে অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ, উৎপীড়ন, শাসন-ত্রাসন চালানো হয়, তা ভারতীয় ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় হিশেবে আজও চিহ্নিত। বৃটিশরা ভারতের সম্পদ লুঠ করে ও ভারতকে বৃটিশদের হিতার্থে নিয়োজিত এক বৃহত্তম বাজারে পরিণত করে। ভারতের অর্থনীতি খুবই বিপর্যস্ত হয়। কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ে। বৃটিশরা ভারতীয় পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, যার ফলে দেশীয় শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে জাতির জীবনে বার বার নেমে আসে অন্নসংকট এবং দুর্ভিক্ষ। ১৮৪৬ সালের ‘অকাল দুর্ভিক্ষ’, ১৯৪৩ সালের বাংলা দুর্ভিক্ষ অন্যতম। এসব দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। বৃটিশ সরকার দুর্ভিক্ষের সময় সাহায্য ও ত্রাণ প্রদান করেনি। মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় ব্যাপক ক্ষোভ। মানুষ আন্দোলনে নেমে এলে বৃটিশ তস্কর শাসক ভারতীয় জনগণের ওপর নির্মম দমন-পীড়ন চালায়। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড একটি বেদনাদায়ক উদাহরণ। এসব ঘটনায় অনেক নিরপরাধ মানুষ নিহত বা আহত হয়। এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিই ‘বিদ্রোহী কবিতা লেখার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সমকালীন পটভূমিকা আলোচনায় দেখা যাবে যে, পরাধীন ভারতের মর্মন্তুদ-জ্বালা ও বিদেশি শাসকের সীমাহীন অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল ইসলামের ক্ষোভ-রোষ-বেদনা ও বিদ্রোহাগ্নির প্রতিফলন ঘটেছে আলোচ্য কবিতায়। নজরুল ইসলাম ইংরেজের সাম্রজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে চিরকালই কম্বুকণ্ঠ ছিলেন। পরাধীন ভারতে ইংরেজের অত্যাচার-নিষ্পেষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর বজ্রাদগীর্ণ কণ্ঠে বারবার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। ১৯২০-র প্রায় সমাপ্তিতে গৃহীত অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব ও সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অগ্নিগর্ভ মানসিকতার বলিষ্ঠ ও উজ্জ্বল প্রতিভাসন ঘটেছে নজরুল ইসলামের সমালোচ্য 'বিদ্রোহী' কবিতার অগ্নিফুলিঙ্গের ন্যায় ছত্রে ছত্রে।২
‘বিদ্রোহী’ কবিতা উজ্জীবিত, স্বাধীনতার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার এবং ভারতীয় জনগণের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। কবিতাটির প্রেক্ষাপট এবং এর অন্তর্নিহিত ভাবনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৃটিশ শাসনের অধীনে ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম অগ্নি-বারুদের মতো জ্বাজ্বল্যমান। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদ, নজরুলের বিপ্লবী ভাবনায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সত্য প্রতিষ্ঠায় দ্রোহ-শক্তির উন্মেষ ঘটায়। বাইরে শীতের প্রবল প্রকোপেও কবির মনে জ্বলে ওঠে দাউ দাউ করে আগুন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। কোলকাতার ৩/৪ সি লেনের বাড়িতে সৃষ্টি হয় ইতিহাস। সেই ইতিহাস আজও সারা বিশ্বে অদ্বিতীয়। কারণ সেদিন লিখিত হয়, কবিতা ‘বিদ্রোহী’। আজ অব্দি যার দ্বিতীয় আর রচিত হয়নি। এটি সব কবিদের মাস্টার পিচের মাস্টার পিচ। ‘বিদ্রোহী’র স্মৃতিচারণে মোজাফফর আহমদ বলেন-
আসলে “বিদ্রোহী” কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। সব হিসাব খতিয়ে এবং সমসাময়িক ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে বেরিয়ে আসছে যে, এটাই ছিল কবিতাটির রচনার সময়। “বিদ্রোহী” কবিতা প্রথম ছাপা হয়েছিল 'বিজলী' নামক সাপ্তাহিক কাগজে।--আমাদের ৩/৪-সি, তালতলা লেনের বাড়ীটি ছিল চারখনা ঘরের একটি পুরো দোতলা বাড়ী। তার দোতলায় দু'খানা ঘর ও নীচের তলায় দু'খানা। বাড়ীর নীচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতা লেখেন।--রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধু'য়ে এসে আমি বসেছি এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। “বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।৩
ভারতবর্ষে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে বিরাট পরিবর্তন এলেও বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবিদের কলম তখনও নিস্তেজ এবং বাংলা সাহিত্য অঙ্গন কোকিলা সুরে প্রবাহিত। এমন সময় প্রয়োজন ছিলো অসির ঝনঝনা। এবং সময়ের প্রয়োজেন রচিত হলো বিপ্লবী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। স্বাধীনতা আন্দোলনকে করে দিলো ব্যাপক পরিসরে বেগবান খরস্রোতা নদীর মতো। বস্তুত নজরুল ছিলেন সত্যিকারের সুশীল ও প্রগতিশীল। সেই সময়ের এক বিদ্রোহী অগ্নিকণিকাই সৃষ্টি করে এক অমিত নব-জাগরণ।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন অনন্যাসাধারণ বিদ্রোহী লেখক, যাঁর কলম ছিলো সদাতৎপর, অনমনীয় এবং অনপণেয়, সকল শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তাঁর কবিতা শুধু রাজনৈতিক-সামাজিক বিদ্রোহেরই প্রতীক ছিলো না, বরং মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতার পক্ষে বুলন্দ আওয়াজ। মানব ইতিহাসের জঘন্যতম শাসনের এক দুঃখজনক বাস্তবতার বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদস্বরূপ লিখিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। এটি শুধু একটি কবিতা নয়, এটি কবির নির্ভেজাল বিশ্বাসের নামান্তর। কারণ এটি শুধু ঔপনিবেশিক শক্তি ও কুশাসনের বিরুদ্ধেই নয়, এটি সমাজের পশ্চাৎপদতা, অন্ধবিশ্বাস, সামাজিক বৈষম্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে এক অপার শক্তিশালী গণপ্রতিরোধ।
‘বিদ্রোহী’র জনপ্রিয়তা ও গৌরব
‘বিদ্রোহী’ কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে জনপ্রিয়-সার্থক কবিতা। সবকালে সবযুগে এই কবিতাটি প্রাসংগিক। এই কবিতাটি পৃথিবীর সকল ভাষার সকল সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সবচেয়ে বেশি পঠিত ও চর্চিত। ‘বিদ্রোহী’র জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে এর প্রতীকী অর্থ, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে তার সুদৃঢ় অবস্থান। শোষিত নিপীড়িত মানুষের প্রাণের কথাই এই কবিতার মূল ও মৌল বক্তব্য।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুধু ব্যক্তি জীবনের সংগ্রাম নয়, বরং সমাজের সমস্ত শোষণ, বৈষম্য, অত্যাচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রতিরোধের আহ্বান। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, ফ্যাসিবাদি শক্তি, নিঃস্বের রক্তশোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে এবং সব রকম কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এই কবিতার অটল অবস্থান। যখন বৃটিশ শাসন এবং সামাজিক বৈষম্য শীর্ষে ছিলো, তখন কবিতাটি ছিলো এক সশস্ত্র প্রতিবাদ, সাহস এবং প্রেরণা।
রচনাকাল ও একালেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা শুধু শহুরে বা শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না, বরং গ্রামের সাধারণ মানুষের উপরও এর আছে প্রবল প্রভাব। কবিতাটির বিদ্রোহী ও সংগ্রামী ভাবনা গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের মনেও এক ধরনের জাগরণ সৃষ্টি করে। কবিতাটি নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সাহস, শৃঙ্খলা এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে সর্বৈব প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক সহায়ক। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের জন্য সব প্রকাশক ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিচের মন্তব্যে তা প্রখর-দীপ্ত।
'বিজলী'তে 'বিদ্রোহী' সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয়। 'মোসলেম ভারতে'র কার্তিক সংখ্যায় সমালোচনার ছলে কবিতাদুটি মুদ্রিত করতে হয়েছিল। এই কৌশল 'বিজলী' সম্পাদককে বাধ্য হয়ে গ্রহণ করতে হয় কারণ 'বিদ্রোহী' রচনার পরই আফজাল উল হক সাহেব 'মোসলেম ভারতে' ছাপার জন্য নজরুলের কাছ থেকে প্রথম কপি নিয়ে চলে যান। তারপর আসেন 'বিজলী' পত্রিকার ম্যানেজার অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৮৮২-১৯৬২)। তিনি কবিতাটি শুনে 'বিজলী'তে ছাপার জন্য তাঁর কাছ থেকে পুনরায় কপি নিয়ে যান। কবিতাটি এত ভাল লেগেছিল যে তাঁর তর সইছিল না। 'মোসলেম ভারত' প্রকাশ অনিয়মিত ছিল, কবে বেরুবে তার নিশ্চয়তা নেই। অনির্দিষ্ট কালের জন্য কবিতাটি ফেলে রাখা যায় না কারণ কবিতাটির মধ্যে এমন একটা উন্মাদনা আছে যা পড়লেই রক্ত গরম হয়ে উঠবে এবং বাংলা কবিতার মধ্যে একটি সতেজ প্রতিবাদমুখর কণ্ঠের পরিচয় পাওয়া যাবে।৪
‘বিদ্রোহী’ কবিতার জনপ্রিয়তার কারণ হলো এটি গোটা ভারতবাসীর বিপ্লবী চেতনা ও উদ্দীপনা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাস ও দুর্দম সাহস, অপরাজেয় শক্তি, বীরত্বের অবিনাশি গতি, ভাষার শক্তি ও অনুভূতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ইশতেহার, জাতীয়তাবাদী সত্ত্বার উন্মেষ ও বিকাশের দুর্জয় দলিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জনপ্রিয়তার ফল ভারত থেকে ফ্যাসিবাদি শাসন ব্যবস্থার জনক বৃটিশের লেজগুটিয়ে পলায়ন। ফলে দেশের তরুণ-যুবকের আইকনে পরিণত হন কবি নজরুল। রাতারাতি হয়ে যান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অরিন্দম মুখপত্র। দুর্জয়-দর্মদ যুবক কবি নজরুল সেদিন ভারতের মানুষের শিরায় শিরায় স্বাধীনতার অগ্নি জ্বেলে দেন। স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত যে আগুন জ্বলন্ত ও অনির্বাপিত। বিদ্রোহীর জনপ্রিয়তা সেদিন সকল রেকর্ড ভেঙে দেয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের দিন ‘বিজলি’ পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে হয়। পত্রিকা নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যসেনগুপ্ত বুদ্ধদেব বসুসহ সকলেই কবিতাটির প্রেমে পড়ে যান। এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে যায় সেদিন নজরুল। রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি-
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথকেও অতিক্রম করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন। হেমন্তবালা দেবীকে ১৯৩৪, ১৭ই আগস্ট তারিখে লিখিত একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, "তোমার মেয়ে হয়তো আমার কবিতার চেয়ে নজরুলের কবিতা ঢের বেশি পছন্দ করে সে কারণে আমি তাকে বিন্দুমাত্র কম স্নেহ করিনে।" (চিঠিপত্র ৯ম খণ্ড. পত্র সংখ্যা ১৪৭, পৃ ২৫৯, ১৪০৪ সং) রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করলেন নজরুলের তপ্ত প্রাণের নতুন সজীবতাকে, বুদ্ধিদীপ্ত বিশিষ্টতাকে।৫
‘বিদ্রোহী’ কবিতা জাতীয় জাগরণের কবিতা। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের অবিসংবাদিত আলোক বর্তিকা, মানবতার জয়গান প্রতিটি ছত্রে। ‘বিদ্রোহী’ প্রবঞ্চিত-প্রপীড়িত মানুষের জেগে ওঠার হাতিয়ার। ভূখা-নাঙ্গা, অনাহারী, নিঃস্ব-সর্বহারা মানুষের অন্ধকার রাতের প্রদীপ। ‘বিদ্রোহী’ নেতৃত্বশূন্য, দিকহীন জাতির দিশা, পরাধীন জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের পাঞ্জেরী। ‘বিদ্রোহী’ শুধু এই উপমহাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের ভাগ্যাহত, প্রপীড়িত, পরাধীন, নিঃস্ব, সর্বহারার মুক্তির সনদ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মানুষ দ্বারা লিখিত ও মানুষের জন্য লিখিত। অধুনা বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান কবি আব্দুল হাই শিকদারের ভাষায়-
আসলেই নজরুলের 'বিদ্রোহী' সাধারণ একটি কবিতা মাত্র নয়। ‘বিদ্রোহী’ মানুষের হাতে শব্দ দ্বারা নির্মিত গর্ব, অহঙ্কার, পৌরুষ ও শিল্পের সর্বোচ্চ মিনার। ১৩৯ টি পঙক্তি দ্বারা গেঁথে তোলা এ কবিতা বাংলা কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। মানুষ ও মানবতার সবচেয়ে বিশাল ও ঐশ্বর্যশালী সুরম্য ভবন। বাংলা কবিতা মাত্র একবারই সমুদ্রের ভয়াল গর্জন নিয়ে ফুঁসে উঠেছিল, মাত্র একবার বাংলা কবিতার মহিমাময় শির দেখে সম্ভ্রমে মাথা নুইয়ে দিয়েছিল হিমাদ্রীর শিখর, - আর তা বিদ্রোহীর মাধ্যমে।
বাংলা কবিতার ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে দেহের ভিতরে যে এত তেজতপ্ত লাভা থাকতে পারে, ভাষা যে ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন হতে পারে, স্বর্গমর্ত্য টালমাটাল করা ভয়ঙ্কর গতিমান হতে পারে; হতে পারে দুর্দমনীয় দুঃসাহসী, হতে পারে বারুদ ও শিল্পের অনাস্বাদিত রসায়ন, নজরুলের জন্ম না হলে আমরা জানতে পারতাম না। তেমনই অবলীলায় বলা যায়, বিদ্রোহী রচনার পরদিন থেকে বিশ্বসাহিত্য ভাগ হয়ে যায় দু ভাগে, একভাগ যারা বিদ্রোহী পড়েছে, অন্যভাগ যারা বিদ্রোহী পড়ে নি।
বিদ্রোহীর পতাকা হাতে নজরুলের আবির্ভাব না হলে বাংলা কবিতা আজো সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের 'দালাল' হয়েই থাকত। সে পূর্ণ মানুষ হতো না। সে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারত না। স্বাধীন হতে পারত না।
মানুষ ও মানবতার জন্য বিদ্রোহীর চেয়ে বেশি করে বিশ্বসাহিত্যে কোথাও কিছু লেখা হয় নি। সেজন্য একক কবিতা হিসেবে বিদ্রোহী শুধু বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ।৬
‘বিদ্রোহী’র সমালোচনা
সমালোচনা দুই রকম হতে পারে। একটি নজরুলকেন্দ্রিক ব্যক্তিগত সমালোচনা। আরেকটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকেন্দ্রিক। সমকালে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের সাথে সাথে সমালোচনা শুরু হয়। তবে হতাশাজনক বিষয় হলো, সমালোচনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকেন্দ্রিক না হয়ে হলো ব্যক্তি নজরুলেকেন্দ্রিক। সমালোচনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকেন্দ্রিক হলে তা নিম্নরূপ হতে পারতো-
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবিতাটির রয়েছে এক বিশেষ স্থান। এটি সাহিত্যের একটি আঙ্গিকমাত্র নয়, বরং এটি শক্তিশালী বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল প্রকাশ- যা ভারতীয় জনগণকে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সর্বোচ্চ উজ্জীবিত করে। কবিতাটিতে ব্যবহৃত শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ছন্দালংকার সবিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। সমালোচনায় বলা যেত, অত্যধিক কঠোর ও সমরূপ চিত্রকল্পের, কিছুক্ষেত্রে কবিতাটিতে শব্দবাহুল্য ও অসংযম প্রয়োগ দৃশ্যমান, নগ্ন শ্বাসরুদ্ধকর শক্তি (Excessive Emphasis on Raw Power), বাক্যের চেয়ে শব্দের প্রাবল্য বেশি অথবা শব্দনির্ভর কবিতা। কিন্তু সাহিত্যের প্রথাগত সমলোচনা তো হলোই না বরং ‘বিদ্রোহী’ নজরুলের ‘মৌলিক’ রচনা নয়। অথবা হুইটম্যানের কাছে ঋণী বা মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধের অনুকরণ ইত্যাদি বলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে আক্রমণ করা হলো। এ কথা বলাই যায় যে, এটি ছিলো মূলত কাজী নজরুলের উপর সাম্প্রদায়িক পীড়ন ও আঘাত।
কবিতাটির উৎস বা প্রেরণা কি? মোহিতলাল মজুমদার দাবি করেছিলেন, তাঁর গদ্যরচনা 'আমি' নজরুলকে প্রভাবিত করেছে। কেউ কেউ মনে করেন, হুইটম্যানের ‘Song of Myself’ নজরুলের প্রেরণা। যেমন I am large, I Contain muttitudes'-এর সঙ্গে 'বিদ্রোহী'র 'বল বীর/বল উন্নত মম শির' তুলনীয়। মোহিতলালের 'আমি' রচনায় পাই "আমি বিরাট। আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর, নভোনীলিমার ন্যায় সর্বব্যাপী।" এখানে নজরুলের বিদ্রোহী' কবিতার বহু পঙক্তিকে মেলানো যায় ঠিকই। তবে এই আমিত্ববোধ অস্মিতা মোহিতলাল, ওয়াল্ট হুইটম্যান থেকে পাননি, তাও কি জোর করে বলা যায়? কাজেই উত্তমর্ণ বা অধমর্ণ বিবাদ সরিয়ে রেখে বলা উচিত, 'বিদ্রোহী' কবিতাটি কবি নজরুলের কবিপ্রতিভার ও কবিমানসের অভ্রান্ত সাক্ষ্য দেয়।৭
উদ্ধৃতাংশে I am large, I Contain muttitudes' muttitudes শব্দটি লেখকের অনিচ্ছাকৃত ভুল। এখানে শব্দটি হবে multitudes. এই লাইনটি ওয়াল্ট হুইটম্যানের “সং অফ মাইসেল্ফ” কবিতার একটি বিখ্যাত বাক্য। এর অর্থ- বহুজনের ভিন্ন ভিন্ন বা কখনও কখনও পরস্পরবিরোধী, বৈশিষ্ট্য এবং অভিজ্ঞতা একজনের মাঝে কল্পনা। অথবা একজন ব্যক্তিই বিশ্বের সকল নিপীড়িত নির্যাতিত, শোষিত-নিঃশোষিত এবং পরাধীন জাতির প্রতীকে পরিণত হওয়া।
মোহিতলালের ‘আমি’র কিছু অংশ-
আমি বিরাট! আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর ,
নভোনীলিমার ন্যায় সর্বব্যাপী।
আমি ক্ষুদ্র, কিন্তু বিরাটকে আমি ধারণ করিতে পারি।
আমি মরণশীল, কিন্তু অমৃত আমাকে প্রলুব্ধ করিতেছে।
আমি দুর্বল, কিন্তু আমার চিন্তাশক্তি ধরণীকে নব কলেবর প্রদান করে।
আমি সুন্দর! শিশুর মত আমার ওষ্ঠাধর, রমণীর মত
আমার কটাক্ষ, পুরুষের মত আমার ললাট!
আমি দুর্বল অসহায়! আমার হৃৎ-ি আপনি ছিঁড়িয়া ফেলি
আমি মূর্খ, আমি নির্বোধ-আমি উন্মাদ!
বলা হয়ে থাকে মোহিত লালের ‘আমি’ প্রবন্ধের এই ‘আমি সুন্দর! শিশুর মত আমার ওষ্ঠাধর, রমণীর মত আমার কটাক্ষ’! এই লাইনগুলার সাথে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র ‘আমি চিরশিশু চিরকিশোর’ এবং ‘আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি’ এগুলোর মিল আছে। এমন মিলের অনুসন্ধান করলে রবীন্দ্রনাথের কোন লেখাই মৌলিক নয়। কারণ তার সকল লেখাতে মহাভারত, রামায়ণ, গীতা-সংহিতার ভাবগত মিল বিদ্যমান। প্রকৃত সত্য হলো- ‘আমি’ প্রবন্ধের সাথে ‘বিদ্রোহী’র ‘আমি’র কোন মিল নেই। না বাহ্যত, না অন্তঃস্থ, না ভাবগত। বরং মোহিত লাল মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধ ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভয়ের কথা’ গ্রন্থের নিকট ভাবগতঋণী।
বিদ্রোহীর বীরে বিপত্তি ও সমকালে বিতর্ক: কয়েকটি বিরূপ সমালোচনা
‘বিদ্রোহী’ কবিতার সৌভাগ্য এই যে, এটি মোটামুটি হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকবে; যদি না এর মধ্যে কেয়ামত সংঘঠিত হয়। মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা চর্চা ও আবৃত্তি করবেন। নিপীড়িত নিঃস্ব ও পরাধীন জাতি/ খন্ড জাতির সুখ-শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতার জন্য এই কবিতা যুদ্ধাস্ত্র হিশেবে টিকে থাকবে। আর এই কবিতার দুর্ভাগ্য হলো কবিতাটি না বুঝেই অপসমালোচনা করেছেন অনেকেই। সেটি হিন্দু মুসলিম উভয় জাতি-ই। তবে কবিতার চেয়ে কবিকেই বেশি আক্রমণ করা হয়েছে, যা দৃষ্টিকটু ও সু-সৃষ্টি বধের শামিল।

কবি নজরুল এছলামের মধ্যে খাঁটি কবি প্রতিভার উন্মোষ দেখিয়া আমরা বড়ই আশান্বিত হইয়াছিলাম। কিন্তু 'বিদ্রোহী' কবিতা লিখিয়া তিনি আমাদিগকে একেবারেই নিরাশ করিয়াছেন। তাঁহার এই কবিতায় দু'একটা মোছলমানী শব্দ থাকিলেও উহার ভিতরের সব জিনিষটা হিন্দুমতে, বলিতে গেলে উহার কাঠামো হইতে আরম্ভ করিয়া বাহিরের সাজ-সজ্জা পর্যন্ত সবই, হিন্দু ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত। কবি নজরুল এছলামের এই সাহিত্যিক প্রচেষ্টা আমাদিগকে নিতান্ত শঙ্কান্বিত করিয়াছে।
['বঙ্গভাষায় মোছলেম প্রভাব', সৈয়দ এমদাদ আলী, 'সোলতান', ১৭ই ফাল্গুন ১৩৩০; ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৪]৮
অথচ বাস্তবতা হলো মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ও হাদিস গ্রন্থেও মানুষকে অমিত শক্তির অধিকারী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মানব জীবনের সূত্রপাতই হচ্ছে ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক সংগ্রমের মধ্য দিয়ে। কারণ কোটি কোটি শুক্রাণু একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার জন্য ধাবিত হয়। এর মধ্যে একজন শুক্রাণু জয়লাভ করে। মানুষের সৃষ্টিই হচ্ছে সত্যের পথে সংগ্রামের জন্য। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় মানুষের বড়ত্ব বর্ণনা ও সকল দেব-দেবীর তুলনায় মানুষই পূজ্য, এটিই বোঝানো হয়েছে। এসব বিষয় বুঝতে না পেরে শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন-ও বলে ফেলেন- “.... কাজী নজরুলের প্রাথমিক রচনায় অনেক সময় ইসলামী ভাব পাওয়া যাইত। তারপর যখন হইতে তিনি বিদ্রোহী সাজিয়া 'বিধাতার বুকে হাতুড়ী' পিটিতে আরম্ভ করিলেন, সেই সময় হইতেই মুসলমান সমাজ তাঁহাকে বর্জন করিয়াছে।”
১৯২৯ সালে যখন কাজী নজরুল ইসলামকে আলবার্ট হলে জাতীয় সংবর্দনা দেওয়া হবে তখনও মওলানা নজির আহমদ চৌধুরী এর বিরোধিতায় নামেন। অর্থাৎ ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের প্রায় ৭ বছর পরও এরা নজরুলের পিছু ছাড়ে নি। ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থে খান মঈনুদ্দীন লিখেছেন-
দেখলাম: মওলানা নজীর আহমদ চৌধুরী সাহেব (আজ তিনি মরহুম আল্লাহ তাঁর বেহেশ্-নসীব করুন। দাঁড়িয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বক্তৃতা করছেন। তাঁর হাতে নজরুলের বিখ্যাত বই 'অগ্নিবীণা'। তিনি 'অগ্নিবীণা' থেকে উদ্ধৃত করছেন:
"আমি বিদ্রোহী ভৃগ ভগবান বুকে
এঁকে দিই পদচিহ্ন।..."
আর বলছেন: "যে-কবি ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে দুঃসাহস প্রকাশ করেন, আপনারা কি চান তাঁকে জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হোক?"৯
মওলানা নজীর আহমদ চৌধুরী এখানেই থেমে থাকেন নি। তিনি নজরুলকে নিয়ে নিন্দা করেই গেছেন। বস্তুত সাহিত্য সমালোচনা তাদের জন্য নয়। হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও আত্মম্ভিরতাই তাদের সর্বগ্রাসী সম্পদ। তার আরও একটি মন্তব্য।
যে অসংযত-বাক লেখক নিজকে জগদীশ্বর বা রব্বুল আলামীন আল্লার ঈশ্বর বলিয়া প্রকাশ করিতে একটুও দ্বিধা না করেন, যিনি আল্লাহকে 'খেয়ালী বিধি' বলিয়া তাঁহার বুকে পদাঘাত করার এমন অনুপম ধৃষ্টতা করিতে আনন্দ ও গৌরব অনুভব করেন। -এছলামের প্রতি এক রতি মাত্র পরিমাণ শ্রদ্ধা ভক্তি বিদ্যমান থাকিতে কোন মুছলমানই তাঁহাকে আপন বলিয়া গ্রহণ করা ত' দূরে থাকুক- অন্তর হইতে ধিক্কার না দিয়া পারে না। এছলামের চোখে এ অপরাধ অমার্জনীয়। মুছলমান সাহিত্যিকগণ শত কণ্ঠে ধিক্কার দিয়া এই পাপ আদর্শকে জাতির সম্মুখ হইতে দূর করিয়া দিন- ইহাই আমাদের প্রার্থনা। [এছলাম ও নজরুল ইসলাম': নজির আহমদ চৌধুরী, 'মাসিক মোহাম্মদী']৯
কবি গোলাম মোস্তফা-ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূলসুর ধরতে পারেননি। তাই অন্যান্য ধর্মবেত্তাদের মতো তিনিও ‘বিদ্রোহী’কে মনে ও মেনে নিতে পারেননি। তিনি ১৯২৩ সালে ‘বিদ্রোহী’কে লক্ষ্য করে লেখেন কবিতা ‘নিয়ন্ত্রিত’।
ওগো 'বীর'
সংযত কর, সংহত কর 'উন্নত' তব শির!
'বিদ্রোহী'? শুনে হাসি পায়!
বাঁধন-কারার কাঁদন কাঁদিয়া বিদ্রোহী হ'তে সাধ যায়?
সে কি সাজেরে পাগল সাজে তোর?
আপনার পায়ে দাঁড়াবার মত কতটুকু তোর আছে জোর?
(নিয়ন্ত্রিত: রক্তরাগ)
গোলাম মোস্তফা ‘নিয়ন্ত্রিত’ কবিতার মাঝেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেননি। সমালোচনার নামে তিনি কাজী নজরুলকে করেছেন ব্যক্তিগত আক্রমণ। ‘বিদ্রোহী’র অনুকরণে তিনি লেখেন- বনিআদম। কবিতাটি ‘বিদ্রোহী’র ছন্দে লেখার এক প্রকার অপপ্রয়াস বলা যেতে পারে। কারণ কবিতা হিশেবে তা শিল্পিত নয়। সার্থক নয়, একেবারেই। ‘বনিআদম’ কবিতাটি এমন-
আমি শয়তান
আমি আল্লা-না-মানা বিদ্রোহী মহাশক্তি মূর্তিমান।
আমি নূহের প্লাবন ডুবাইয়া দিব বিশ্ব
আমি সাহারা গোষ্ঠীর হাহাকার
ওই শ্যাম-কুন্তল ধরনীকে আমি করিব রিক্ত নিঃস্ব।
আমি আনিব তুফান ঝঞ্ঝা
করিব যখন চাহে এ মন যা
লণ্ডভণ্ড করিয়া দিব আমি সৃষ্টির যত শোভা
আমি রাখব না কিছু সুন্দর মনোলোভা।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার মারাত্মক প্যারোডি করেছেন অশোক চট্টোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস। অশোক চট্টোপাধ্যায় নজরুলের নামকরণ করেন- ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’। শনিবারের চিঠিতে তারা লেখেন-
বন্ধুবর গাজী আব্বাস বিটকেল সমীপেষু
ওরে ভাই গাজীরে
কোথা তুই আজিরে
কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা!
কোথা গিয়ে নিরিবিলি
ঝোপে ঝাড়ে ডুব দিলি
তুই যে রে কাব্যের গগনের সবিতা!
দাবানল-বীণা আর
জহরের বাঁশীতে,
শান্ত এ দেশেতে ঝড় একলাই তুললি,
পুষ্পক দোলা দিয়া
মজালি যে কত হিয়া
ব্যথার দানেতে কত হৃদি দ্বার খুললি।
এছাড়াও সাপ্তাহিক শানিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত দাস ‘ভবকুমার” ছদ্মনামে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি ‘ব্যাঙ’ কবিতা লেখেন। কবিতাটি এমন-
আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাঙ।–
আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই,
আমি বুক দিয়া হাঁটি ইঁদুর-ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।
আমি ভীম ভুজঙ্গ ফণিনী দলিতফণা
আমি ছোবল মারিলে নরের আয়ুর মিনিট যে যায় গণা
আমি নাগশিশু, আমি ফণিমনসার জঙ্গলে বাসা বাঁধি,
আমি ‘বে অব বিস্কে’ ‘সাইক্লোন’ আমি মরুসাহারার আঁধি।
সজনীকান্ত, যোগানন্দ ও অশোক চট্টোপাধ্যায় নজরুলের পেছনে জোঁকের মতো লেগে ছিলো। তাদের আরও একটি প্যারোডি, যা শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত, তা হলো-
আমি বীর!
আমি দুর্জয়, দুর্ধর্ষ, রুদ্র, দীপ্ত, উচ্চশির।
আমি বীর!
দু চোখে আমার দাবানল জ্বলে জ্বল্ জ্বল্ জ্বল্
স্তব্ধ বিশ্ব ইঙ্গিতে ভ্রূকুটির
আমি বীর! আমি বীর!!
ভাবী শ্বশুরের হিসাব খতিয়া
তরুণ-বাঙ্গালী-সাগর মথিয়া
উঠেছি যে আমি নিছক শুদ্ধ ক্ষীর
আমি বীর! আমি বীর!!
আমি ভাঙ্গি বেঞ্চি ও চেয়ার
আমি করিনা কারেও কেয়ার
হৃদি নিয়ে আমি ছিনিমিনি খেলি
লাখ লাখ তরুণীর
আমি বীর!
দুচোখে আমার প্রলয় জ্বলিছে
স্তব্ধ বিশ্ব ইঙ্গিতে ভ্রূকুটির
আমি বীর!!
অনেক সময় অশালীন শব্দব্যঞ্জনাতেও ব্যাঙ্গ করা হয় ‘বিদ্রোহী’কে। যেমন-
‘ভেপসে উঠে খেপলি কেন কী হল তোর খাপ্পা খোকা,
তাবড়া মেরে হাবড়া গেল ঘাবড়ে গিয়ে বাপ খামোখা’
চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-ও বসে থাকেননি। ‘বিদ্রোহী’ পীড়কগোষ্টীর দলে সযোগদানে লেখেন ‘কবি বিদ্রোহী’। তবে এতে যতোটা না প্যারোডি ধর্ম তার চেয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশের প্রকাশ বেশি। এবং ‘বিদ্রোহী’র অনুকরণই প্রধানত উল্লেখ্য:
আমি ভৈরব হাতে বিষাণ,
আমি বিষ্ণুর হাতে চক্র
আমি মহাসিন্ধুর নক্র,
আমি দুষ্টের মুণ্ডিত শিরে ষষ্ঠী ঘোষের তত্রু।
আমি অগ্নি, আমি অগ্নি,
আমি যাহারে বিবাহ করেছি, তাহারি ভগ্নী,
আমি দিনরাত করি খয়রাত
করি কারবার লগ্নি।
আমি দেলখোস,
আমি দেলওয়ার
আমার হস্তে ঘূর্ণিত নিতি হত্যার রাঙা তলোয়ার
আমি ফেরোয়ার, ধূমকেতু মম 'ফলোয়ার';
আমি সূর্য চন্দ্র হাতে লুফে চলি
আমি তাজ্জব খেলোয়াড়।
আমি খোরাসানী ঘোড়া ছুটে যাই টগবগ বগ
পচা ঘায়ে নালী, জুলি আমি চির দগদগ,
আমি ফিরিঙ্গী, আমি মগ
আমি 'চায়না সাগরে' 'টাইফুন'
আমি 'জার্মান ওশানে' মহা 'ফগ।'
মো: গোলাম হোসেন নামীয় এক কবি ‘প্রলয়ের ভেরী’ নামে আরও একটি প্যারোডি ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকা অগ্রহায়ণ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশ করে।
তুমি অহঙ্কার মত্ত ইবলিস!
তুমি রুদ্র পিশাচ শয়তান খাবিস।
তাই, আপনারে ছাড়া কাহারে তুমি কর না কুর্নিশ!...
তুমি শত্রুর সাথে গলাগলি করে মৃত্যুর সঙ্গে ধর পাঞ্জা!
বলি মাঝে মাঝে অভ্যাস আছে খাওয়া কি গাঞ্জা?
তাই নেশার জোরে, মহাঘোরে, হও ‘সাইক্লোন ঝঞ্ঝা!’
‘ইসলাম দর্শন’ কার্তিক ১৩২৯ সংখ্যায় কবি আবদুল হাকিম ‘বিদ্রোহী’র প্যারোডি ‘বিদ্রোহ দমন’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি প্যারোডি ও গালাগাল নির্ভর হলেও কবির কবিত্বশক্তি সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
ওগো বীর-
অসংযত বিদ্রোহী অধীর।
সংযত হয়ে নমিত কর তব গর্বিত উন্নত শির;
শির 'উঁচু নেহারি' তোমারি লাজনত শিষ্টতা ধরণীর।
তুমি বেল্লিক বেঈমান
তুমি নমরুদ, তুমি ফেরাউন, তুমি খোদাদ্রোহী শয়তান।
তুমি স্বজনের অরি কূলের কণ্টক-ভ্রাতৃদ্রোহী বিভীষণ;
তুমি কুলবধূর বস্ত্রাপহারী-দুর্মতি দুঃশাসন।
তুমি দেশের লাঞ্ছনা জাতির গঞ্জনা সমাজের অপমান;
ওরে বিদ্রোহী বেঈমান!
অর্থাৎ, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার কারণে নজরুলকে শয়তান, বেঈমান, ইবলিশ, নাস্তিক, খোদাদ্রোহী, হিন্দুপুজারি গালিতে আক্রান্ত হতে হয়। নজরুল অনিয়ন্ত্রিত ও অসংযত- এমন সমালোচানাও সহ্য করতে হয়। নজরুল রচিত বীর অসহায়-সম্বলহীন। দুর্বল ও পরনির্ভশীল। এ রকম মতামত আরও কেউ কেউ দিয়েছেন। তবে সবকিছু শুনে মহামানবের মতোই আচরণ করেছেন নজরুল। সামান্য ২-১ চরণে সব জবাব দিয়েছেন। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি লেখন-
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
যারা নজরুলকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন তাদেরকে ক্ষমা করে তিনি ‘জীবন-বন্দনা’ কবিতায় লিখেছেন
‘আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাবসম কোনো বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপমণ্ডূক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে,
তারই তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে!
বিদ্রোহীর আরও কিছু তথ্য
১. নবীন কবি নজরুল ইসলামের সুবিখ্যাত 'বিদ্রোহী'র আবেগ সত্যদৃষ্টি স্রষ্টার হাতে নিয়ন্ত্রিত নয়। তাই তার অনেকখানি কাব্য হিসাবে অকিঞ্চিৎকর। -কাজী আবদুল ওদুদ, ১০৩২।

২. 'আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী'-ইত্যাদিতে বিদ্রোহীর স্বভাবসিদ্ধ রুদ্র নর্তনের ব্যাঘাত ঘটিয়াছে। ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হব শান্ত'-এইরূপ অস্বাভাবিকভাবে দমিয়ে যাওয়ায় কবিতার রসভঙ্গ হইয়াছে।'-আবদুল কাদির, ১৩৩২।
৩. নজরুল ইসলামের প্রথম দিককার কবিতা 'বিদ্রোহী' উঁচু দরের কবিতা নয়। নজরুল ইসলাম খুব কিছুদিন জোর গলায় জয়ধ্বনি করলেন, তার অধিকাংশই ফাঁকা আওয়াজ। 'প্রগতি', শ্রাবণ, ১৩৩৬।
৪. 'আমাদের তথাকথিত কোনোও 'বিদ্রোহী' কবি বড় আশায় তাল ঠুকিয়া নকল। পৌরুষের অভিনয় করিতে দাঁড়াইয়াছিলেন। কিন্তু হায়! বুলবুলের গান তাঁহাকে লজ্জাবতী লতার পাশে আনিয়া ফেলিয়াছে।'-নির্মলকুমার ঘোষ দস্তিদার, 'উপাসনা', আশ্বিন, ১৩৩৬।
['মাসিক সঞ্চয়', পৌষ ১৩৩৬]
‘বিদ্রোহী’র ভাবগত ও বাচনিক ঋণ
কেউ কেউ সমালোচনার প্রয়াস পেয়েছেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সাথে হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেল্ফ’-এর ভাবগত ও প্রকাশগত মিল আছে। তবে ভাবগত যেটুকু মিল আছে তা অনুকরণ বলা যায় না। বরং পারস্যের কবি ও দার্শনিক জালালুদ্দিন রুমির ‘সর্বময়’ কবিতার সাথে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সাযুজ্য আছে। ভাবগত ও প্রকাশগত উভয়দিক দিয়েই রুমির ‘সর্বময়’ কবিতার সাথে ‘বিদ্রোহী’র মিল পাওয়া যায়; তবে তা নিতান্তই বাহ্যত। হালকা ও অগভীর। বস্তুত ‘বিদ্রোহী’র স্রোতধারা-প্রবহমানতা ও বিরল প্রকাশ ভঙ্গি নিতান্তই স্বতন্ত্র ও নজরুলীয়। এটি নিঃসন্দেহে মৌলিক রচনা। ‘সর্বময়’ কবিতাটি নিম্নরূপ-
‘সর্বময়’ (রুমী)।
আমি সূর্য কিরণে রশ্মি কণিকা
প্রখর দীপ্ত তপন,
আমি ইঙ্গিতে ওই সুদূর কক্ষে
গ্রহেরে করাই ভ্রমণ!
আমি ঊষার গণ্ডে নব অরুণিমা
সান্ধ্য সমীর হিল্লোল,
আমি তরু শিরে ধীর মর্মর ধ্বনি
ক্ষুব্ধ সাগর কল্লোল!
আমি সৈনিক করে শাণিত কৃপাণ
গর্ব স্ফীত সৈন্য,
আমি বিপুল পুলকে
আপন বক্ষ আপনি করেছি ভিন্ন।
আমি পুত্র বিধূর আর্ত জননী –
জননী কণ্ঠে ক্রন্দন,
আমি যে প্রেমিক-প্রেমের প্রলাপ
প্রিয়ার বুকের স্পন্দন।......
[মোহাম্মদ সুলতান অনূদিত]
‘বিদ্রোহী’র অনুকরণ, প্রভাব-প্রশংসা
‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রভাব শুধুমাত্র সাহিত্যিক দিক থেকে নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্র (জাতি) উভয়ের উপরই গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। কবিতাটি ব্যক্তিগত, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেতনার এক শক্তিশালী বাহক। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি তার বিপ্লবী চিন্তা, শক্তিশালী ভাষা এবং বীরত্বপূর্ণ চিত্রকল্পের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি শুধু কাব্যিক সৃষ্টিই নয়, বরং স্বাধীনতা, সংগ্রাম, প্রতিবাদ এবং ক্ষমতার এক শক্তিশালী প্রতীক। তাই এই কবিতাটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। অনেকেই এই কবিতার ব্যাপক সমালোচনা ও অপসমালোচনা করলেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে অনেকেই অনুকরণ করে কবিতা লেখেন।
'বিদ্রোহী' প্রকাশের আগে তাঁর বহুবিখ্যাত কবিতা 'শাত-ইল আরব (১৩২৭ জ্যৈষ্ঠ মোসলেম ভারত)। 'খেয়াপারের তরণী' (১৩২৭ শ্রাবণ মোসলেম ভারত) 'মোহররম' (১৩২৭ আশ্বিন মোসলেম ভারত) 'আগমনী' (আশ্বিন ১৩২৮ উপাসনা) 'কামাল পাশা' (১৩২৮ কার্তিক মোসলেম ভারত) 'আনোয়ার' (১৩২৮ কার্তিক সাধনা) প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু সেগুলি পাঠকসমাজে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেনি যেমনটি 'বিদ্রোহী' করেছিল। 'বিদ্রোহী' কবিতাই তাঁকে খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছে দিল একরাত্রে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সে সময়কার পরিবেশ যা চাইছিল অর্থাৎ এমন একটা তেজী প্রতিবাদী মন যা সমস্ত প্রকার বাধাবন্ধন সংস্কারকে উচ্ছেদ করে একটি বলিষ্ঠ প্রদীপ্ত প্রত্যাশার তেজোদীপ্ত সুস্পষ্ট বাণীর প্রয়োজন হয়েছিল-'বিদ্রোহী' সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছিল সেদিন পূর্ণমাত্রায়। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সে সময়কার 'most conscious point' এর সর্বাপেক্ষা বলিষ্ঠ কবি ছিলেন নজরুল। 'বিদ্রোহী' পড়ে তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখা হল যেমন, জনৈক শৈলেন্দ্রকুমার মল্লিক ‘বিদ্রোহী বীর’ নামে কবিতা লিখলেন, মোসলেম ভারত-এর ১৩২৮ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ছাপা হল।১০
‘বিদ্রোহী বীর’
শৈলেন্দ্রকুমার মল্লিক
ওগো বিদ্রোহী রণবীর
ওগো চঞ্চল অস্থির
ওগো বঙ্গবাণীর বীণা-বৈঠকে ভেরীনাদ গম্ভীর।
ওগো বিদ্রোহী রণবীর।
ওগো বীর তলোয়ার ভক্ত।
তুমি মহরম খেল জয়গান গাহি মাখি শহীদের রক্ত।
ওগো বিস্ময় বাঙ্গালীর।
ওগো মহামিলনের দীপ্ত মূর্তি হিন্দু-ইসলামীর!
সত্যেন দত্ত বিদ্রোহী' কবিতা পড়ে বিমুগ্ধ চিত্তে লেখেন ‘যৌবন’ নামে কবিতা:
আমি আলেয়ার আলো, আপন খেয়ালে চলি,
ঝঞ্ঝা মানি না, মানি না বাত্যা-ভয়।
আমি উল্কার মতো আপন বেগেতে জ্বলি
পথহারা, নাহি কারো সাথে পরিচয়
আমি পর্বত হতে দুর্জয় বেগে নামি
বাধা বন্ধন দু'ধারে ঠেলিয়া যাই।
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন-
: রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার তখন মধ্যাহ্ন দীপ্তি। দেশের যুবজনের মনে তাঁর আসনও পাকা। তারই মাঝে হঠাৎ আর একটি তীব্র প্রবল তুফানের আপটা কাব্যের রূপ নিয়ে তরুণ মনকে উদ্বেল করে তুলেছিল।...কিশোর জগতে একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল, জেগে উঠেছিল একটি রোমাঞ্চিত শিহরণ। মনে আছে বন্ধুবর কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একটি কাগজ কোথা থেকে কিনে নিয়ে অস্থির উত্তেজনার সঙ্গে আমার সঙ্গে ঘরে ঢুকেছিলেন। কাগজটা সামনে মেলে দিয়ে বলেছিলেন, 'পড়। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি। রাস্তায় কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে এ কাগজ নিয়ে।'... পড়লাম, কবিতার নাম 'বিদ্রোহী।'...
সেদিন ঘরে বাইরে, মাঠে ঘাটে, রাজপথে সভায় এ কবিতা নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শত শত পাঠক পড়েছে। সে উত্তেজনা দেখে মনে হয়েছে যে কবিতার জ্বলন্ত দীপ্তি এমন তীব্র যে ছাপার অক্ষরেই যেন আগুন ধরিয়ে দেবে। গাইবার গান নয়, চিৎকার করে পড়বার এমন কবিতা এদেশের তরুণেরা যেন এই প্রথম হাতে পেয়েছিল। তাদের উদ্দাম হৃদয়ের অস্থিরতাই এ যেন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি। (নজরুল প্রসঙ্গে নজরুল সন্ধ্যা ১৯৬৯)
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬) ‘বিদ্রোহী’র মূল্যায়নে লিখেছেন: কে এ নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে 'উঠল। এমনটি কোনদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি। যেন সমস্ত অনুপাতের বাইরে, যেন সমস্ত অঙ্কপাতেরও অতিরিক্ত।...গদগদ বিহুলের দেশে এ কে এল উচ্চণ্ড বজ্রনাদ হয়ে। আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উদ্দণ্ড মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াল, চোখ কচলে তাকালো সকলে।... একেবারে বিদ্যুৎগতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। শুধু ছড়িয়ে পড়ল না, জীবনদায়িনী চেতনায় সকলকে বিদ্যুদ্দাম করে তুলল।... সবাই জেগে উঠল, উঠে বসল, দাঁড়িয়ে পড়ল, ছুটে এল বাইরে। অকপটে এ আমাদের কবি, আমাদেরই প্রাণের অব্যক্ত ভাষাকে এ ছন্দে স্পন্দে নির্গল করেছে। এই কবিতা লিখেই নজরুল জনমানসের নির্মল অন্তরঙ্গতায় উপনীত হল। (জ্যৈষ্ঠের ঝড়, ১৩৭৬)
বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪): 'বিদ্রোহী' পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিকপত্রে, মনে হলো, এমন কখনো পড়িনি।
‘বিদ্রোহী’র পাঠভেদ:
পত্রিকায় প্রকাশিত 'বিদ্রোহী' কবিতা গ্রন্থলগ্ন করার সময় হুবহু তাই ছিল। অগ্নি-বীণার পঞ্চম সংস্করণে (চৈত্র ১৩৩৮: এপ্রিল ১৯৩১) কিছু কিছু পংক্তি বাদ দেন। যেমন-
‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া’-র পর ছিল-
: হাসি হা-হা হা-হা হি-হি হি-হি,
ত্যাজি বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হাঁকে চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ চিঁ-হিঁ হিঁ-হিঁ
পরিবর্তিত রূপ-
: ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ-মর্ত্য-করতলে
ত্যাজি বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মৎ-হ্রেষা হেঁকে চলে।
ছোটখাট পরিবর্তনও করেছেন যেমন 'আমি প্রভঞ্জনের উল্লাস' এর স্থলে 'আমি' প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস'। 'আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ' এর পর ছিল-
: আমি উত্তাল, আমি তুঙ্গ, ভয়াল মহাকাল,
আমি বিবসন, আজ ধরাতল নভ ছেয়েছে আমারি জটাজাল।
আমি ধন্য। আমি ধন্য!
আমি মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীর, বিদ্রোহী সৈন্য।
আমি ধন্য! আমি ধন্য।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী মনোভাবের মাধ্যমে সমাজের সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, শোষণ, এবং শাসকশ্রেণীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহা-বিপ্লবের ডাক দেন। কবিতাটি যেন এক আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মনির্ভরশীল মানুষের শক্তিমত্তাপূর্ণ কণ্ঠস্বর। এই কবিতায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রতিবাদের পাশাপাশি মানবিক আদর্শের উচ্চারণও প্রবল। প্রেম-প্রণয়, আধ্যাত্মবাদ, গতিবাদ এই কবিতার একক ও অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভাষা এবং তার গঠন একদিকে প্রবল শক্তিশালী, তেমনি প্রগাঢ় আবেগপূর্ণ। ভাষার মধ্যে রয়েছে এক ধরনের চৌম্বকীয় তীব্রতা যা পাঠককে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের অমর সৃষ্টি, যা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে যুগান্তকারী প্রতিবাদ। সময়ের সহাসী ও সেরা উচ্চারণ। স্বাধীনতার অমর বাণী। ‘বিদ্রোহী’তে জাতির আবেগ ও চেতনা দারুণভাবে উঠে এসেছে, যেখানে প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ এক নতুন অভিব্যক্তি ও ফাসিবাদমুক্ত যুগের অরিন্দম ঘোষক। ‘বিদ্রোহী’ একটি নতুন জীবনদর্শন, যেখানে শোষণ, বৈষম্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধের বীরোচিত ঘোষণা জ্বলন্ত লাভার ন্যায়। কবিতাটি আজও মানুষের মনকে উদ্দীপ্ত করে, একটি মুক্ত, সাম্য-সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়পরায়ণ, স্বাধীন-সার্বভৌম এবং ফ্যাসিবাদমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরাণা যোগায় ঘোর অমানিশা, অবিশ্বাস ও নিরাশার মাঝেও।
তথ্য উৎস:
১। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ স্মারক, মধুসূদন বসু, ‘বিদ্রোহী: নজরুলের শ্রেষ্ট কবিতা, প্রথম মুদ্রণ, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮/ ২৫ মে ২০২১, পৃ. ৮৬।
২। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ স্মারক, ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘বিদ্রোহী’, প্রথম মুদ্রণ, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮/ ২৫ মে ২০২১, পৃ. ১৭৯।
৩। মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা, মুক্তধারা, স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ৭৪ ফরাশগঞ্জ, ঢাকা; পৃ. ১৮৯।
৪। আজহারউদ্দীন খান, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, শতদল জানা, সুপ্রিম পাবলিশার্স, ১০এ, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা; অষ্টম সংস্করণ, পৃ. ৮৩।
৫। তদেব, পৃ. ৮৫।
৬। সর্বজনীন নজরুল, আব্দুল হাই শিকদার সম্পাদিত, ‘বিদ্রোহী’ স্কয়ার টাওয়ার, আব্দুল হাই শিকদার, শোভা প্রকাশ, ৩৮/৪ মান্নান মার্কেট (তৃতীয় তলা), বাংলা বাজার ঢাকা-১১০০, ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, পৃ. ২৮।
৭। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ স্মারক, তরুণ মুখোপাধ্যায়, ‘বিদ্রোহী’, প্রথম মুদ্রণ, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮/ ২৫ মে ২০২১, পৃ. ১৪৩।
৮। পূর্বোক্ত আজহারউদ্দীন খান, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, পৃ. ৯১।
৯। যুগস্রষ্টা নজরুল, খান মুহাম্মাদ মঈনুদ্দীন, হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬, কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলকাতা, পৃ. ৯৪।
১০। পূর্বোক্ত। আজহারউদ্দীন খান, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, পৃ. ৮৫।

