১.
ঘুম ভাঙ্গা চোখে তাকাতেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে বিধাতা। বিশ্বাস করতে না পেরে নিজের গায়ে চিমটি কেটে নিশ্চিত হলাম, জ্ঞানে আছি নাকি অজ্ঞানে। অজ্ঞান, ঘোরে বা স্বপ্নে নেই নিশ্চিত হয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে খাটের উপর পা গুটিয়ে বসে অপলক নয়নে শুধু বিধাতার স্বরূপ দেখছি। বিধাতা প্রথমেই আমার মৌনতা ভঙ্গের চেষ্টা করলো, চোখের উপর তার নূরের ঝলকানিতে। আমি শুধু সম্মতিসূচক মাথাটা নেড়ে হ্যাঁ বললাম ।
এতক্ষণে বুঝে গেছি, গতকাল তন্দ্রার দাফন শেষে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আসন পেতে বসে ছিলাম বিধাতার কাছে। যারপরনাই আকুতি-মিনতি করছিলাম আমার আরজিটা নিয়ে। আমার আরজিটা হয়তো যুক্তিযুক্ত ছিল বলেই বিধাতার এই উপস্থিতি। আমি অনুনয়ের সুরেই বললাম, আমাকে কি একটা দিন ফিরিয়ে দেওয়া যায় বিধাতা?
বিজ্ঞাপন
-সে রকম কোনো সুযোগ নেই । তাছাড়া কাউকেই এরকম সুযোগ দেওয়া হয়না। আমি অসহায়ের মতো প্রার্থনার দৃষ্টিতে আবারো বিধাতার পানে চাইলাম। বুঝলাম, এবার বোধ হয় বিধাতা আমার আরজিটা অনুমোদন করবে।
স্পষ্ট শুনতে পেলাম, বিধাতা ভারি গলায় বললেন- তুই কি সিওর, একদিন সময় পেলেই তুই তোর সব ঠিক করে নিতে পারবি? আমি আত্মবিশ্বাসি হয়ে দৃঢ়তার সাথে বললাম, হ্যাঁ বিধাতা, আমাকে ২৪ ঘন্টা সময় দিলেই আমি সব ঠিক করে নিতে পারবো বলে আশা এবং বিশ্বাস করি, আমাকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক। বিধাতা রাজি! এরকম বার্তা আকাশে বাতাসের ধ্বনিতে শুনলাম মিনিটখানেক। দু-দিন পর বড়োসড়ো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম আমি, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আশ্বস্ত করলাম নিজেকে।
তন্দ্রা আমার স্ত্রী। ও গতকাল রোড এক্সিডেন্ট করেছিল বেলা ১১টা নাগাত। সংবাদটা সাবলেট ভাবির মোবাইল ফোন মারফত জানার পর অফিস থেকে দ্রুত ছুটি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে। (আমার অফিসটা ঢাকার মিরপুর এরিয়াতে)
হাসপাতালে পৌঁছে, সাবলেট ভাবির মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তন্দ্রার নিকট কেবিনে পৌঁছে গেলাম পাঁচ/সাত মিনিট মধ্যে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো তন্দ্রা। ও আমার হাত ছুঁয়ে অঝোর নয়নে শুধু কাঁদছিল। আমিও কান্না জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, কি করে হলো এটা? তন্দ্রা তখন ভাঙা ভাঙা গলায় বলছিল-
-তোমার জন্যে, সব তোমার জন্যে, তুমি যদি ফস্টি-নস্টি না করতে মেয়েটার সাথে আমার কিছুই হতো না! আমি আজ মরতেও বসতামনা, তাছাড়া কিছুক্ষণ আগে তুমি ফোনে আমাকে যা যা বলেছো কোনভাবেই মানতে পারছিলাম না আমি। নিজেকে অনেক অসহায় ও ছোট মনে হচ্ছিল, পরাজিত হবার ভয়ে প্রস্থান করে বাঁচতে চাচ্ছিলাম, তাই ইমোশন কন্ট্রোল করতে না পেরে রাগের মাথায়...।
বিজ্ঞাপন
এটুকু বলেই জ্ঞান হারায় তন্দ্রা, আমি ডাক্তার ডাক্তার বলে পাগলের মতো ছুটতে থাকি এ কেবিন থেকে ও কেবিনে, ততক্ষণে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়, তন্দ্রার কেবিনের কর্তব্যরত ডাক্তার আমাকে বলে-আই অ্যাম সরি!
কিছু সময় আগের কথা, আমি তখন অফিসে, সকাল ১০:৩০ টা হবে । অফিসের কাজে মোটামুটি ব্যস্ত, হঠাৎই তন্দ্রার ফোন-
-হ্যালো, কি, কিছু বলবে?
-তোমার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল।
-কি কথা?
-তুমি একটু এক সাইডে যাও।
-এক সাইডেই আছি, বলো না কি কথা।
-বাসায় একটা নতুন প্যাকেট দেখলাম, প্যাকেটের গায়ে তোমাদের অফিসের লোগো, প্যাকেটের ভিতর নতুন একটা টি-শার্ট, কোথায় পেলে টি-শার্টটা, এক নিঃশ্বাসে জেদি কণ্ঠে বললো তন্দ্রা।
-ও এই কথা, এটা কোন জরুরি কথা হলো?
-হ্যাঁ, এটা আমার জন্যে খুব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আর টি-শার্টটা কোত্থেকে এলো সেটা জানাও আমার জন্যে খুবই জরুরি।
-টি-শার্টটা শায়লার, ওর স্বামীর জন্যে..., অফিস থেকে ওদের ডিপার্টমেন্টের সবাইকে দিয়েছে, টি-শার্টটা শায়লার স্বামীর শরীরে লাগবে না বলে...
-এমনিতে নাচুনে বুড়ি তার উপর নাতিনের বিয়ে, ঐ ঢেমনিটা টি-শার্টটা তোমাকে দিবে কেন শুনি?
-ভাষা সংযত করো তন্দ্রা, মাথা ঠিক আছে তোমার ?
-আমার মাথা ঠিক নেই, নাকি তোমার মাথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে ডাইনিটা। ডাইনিটাকে পেলে চুলের মুঠি ধওে, বে..ম্যা....
-দেখ তন্দ্রা, এভাবে কথা বললে আমিই ফোনের লাইন কেটে দিতে বাধ্য হবো...
-ফোনের লাইন কাটো, আর যাই করো, তোমার সাথে আর এক মুহূর্ত নয়। আমি বুঝে গেছি তোমার মতো চরিত্রহীনের সাথে ঘর করা আমার দ্বারা সম্ভব নয় । আমি আজকেই চলে যাবো, আর দুদিনের মধ্যে তোমাকে ডিভোর্স লেটারটাও পাঠিয়ে দিব।
-আমার সাথে না পোষালে যেতেই পারো তুমি, সে স্বাধীনতা তোমার আছে। তাছাড়া আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমিই তোমাকে ডিভোর্স দিবো, আজকেই কথা বলে নিবো তোমার বাবা-মা’র সাথে।
-তুমি যা খুশি তাই করো, আমার কোন আপত্তি নেই। মরতে পারো না তুমি, এতো মানুষের মরণ হয়, তোমার হয়না কেন? তুমি মরলে অন্তত আমি তো বাঁচতাম! রাগের মাথায় কথাগুলো বলে আমিই ফোনের লাইন কাটলাম, এ প্রান্ত থেকে।
শায়লা আমার অফিসের মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। শায়লাকে আমার সাথে জড়িয়ে অযথায় সন্দেহ করতো তন্দ্রা, এর পিছনে কোনো যুক্তিযুক্ত প্রমাণ ছিল না তন্দ্রার হাতে। আসলে মোবাইলে এসএমএস পাঠানো শায়লার একটা মুদ্রা-দোষ। ওর ফোনে কোনো বন্ধু-বান্ধবি বা কলিগ ফানি বা ভালোবাসায়পূর্ণ কোনো এসএমএস পাঠালে ও আমাকে সেটা পাঠাবে, তবেই সে খুশি। সাথে সাথে অপরাধীর মতো আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে ছোট্ট শিশুর মতো বলবে, স্যার কিছু মনে নেননি তো ? আমি শায়লার অসহায় চেহারার কাছে কখনোই বলতে পারিনি, তুমি আমাকে আর কখনো এসএমএস পাঠাবে না শায়লা। শায়লা ওর স্বামীর দুর্ব্যবহার আর নির্যাতনের কথাগুলো বলতো আমাকে। ওর অসহায় মুখটার কাছে আমি হেরে যেতাম, আমার বিধবা বোন তুলির কথা ভেবে। তুলি আমার আপন ছোট বোন। ও বিধবা হয়েছে প্রায় ৩ বছর আগে, মাত্র ২১ বছর বয়সে।
২.
আজ ১২:০১ টায় (এ.এম) আমার আবেদিত তন্দ্রাকে ফেরত দিয়েছে বিধাতা, ২৪ ঘন্টার জন্য। আমি সফলভাবে এই ২৪ ঘন্টা অতিক্রম করতে পারলেই আমার তন্দ্রাকে সারা জীবনের জন্য পেয়ে যাবো । নচেৎ আমার প্রার্থনায় প্রাপ্ত এই মিশনটা ব্যর্থ হবে এ জীবনের জন্য। আমি কাউকেই জানাইনি বিষয়টা, শুধু তন্দ্রার সাথে দেখা করে অফিসে এসেছি রাত্রীকালীন ডিউটির পর্যবেক্ষণের জন্য। আমি তন্দ্রাকে ভালোমন্দ কিছুই বলিনি, কারণ ভয়টা তখনও আমার মধ্যে কাজ করছিল, যদি আজ আবার আমার অন্য কোনো ভুলের জন্য তন্দ্রাকে হারাই, তবে বিধাতার কাছে চাইবার বা বলবার আমার আর কোন পথই অবশিষ্ট থাকবে না। অফিসে বসে এক মনে শুধু ভাবছি কীভাবে এই ২৪টা ঘন্টা পার করবো, কীভাবে তন্দ্রাকে ধরে রাখবো, কল্পনার পোকাটা তখনও মাথার ভেতর রঙিন জাল বুননে ব্যস্ত। আমি শুধু সময়টা পার করবার জন্য ঘড়ির সেকেন্ড কাউন্ট করছি পলকে পলকে। হঠাৎ অফিস বয়ের চিৎকারে পুরোটা চৈতন্য ফিরলো আমার-
-স্যার, স্যার, বাটন হোলের নাসিমার মেশিনে হাত কেটে গেছে অনেকখানি, কোনোভাবেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না, কী করবো স্যার?
-কী করবে মানে, তাড়াতাড়ি এখানে নিয়ে এসো মেয়েটাকে।
-ঠিক আছে স্যার ।
অফিস বয় রাশেদসহ ২/৩ জন মহিলা শ্রমিক মিলে নাসিমাকে নিয়ে আসে আমাদের রুমে। গজ কাপড় দিয় হাত বেঁধেও রক্ত বন্ধ হচ্ছিলনা বলে বাধ্য হয়ে শায়লাকে ফোন দিলাম। শায়লা বাসা থেকে এসে নাসিমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে, নাসিমার অবস্থা মোটামুটি ভালো হলে সুপারভাইজার ফারুককে দিয়ে তাকে তার বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। হঠাৎ নিজেকে অনেক ক্লান্ত মনে হওয়ায় হাতঘড়িটা খুলে, পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে, টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুমে গেলাম । আমি ওয়াশরুম থেকে থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে চেয়ারে বসতেই শায়লা বললো-
স্যার কে যেন একটা মহিলা আপনাকে ফোন দিয়েছিল।
একটু পরই তন্দ্রার ফোন-
-হ্যালো, কী ব্যাপার তন্দ্রা, হঠাৎ এতো রাতে ফোন দিলে ?
-এতো রাতে ঐ ডাইনিটা তোমার ফোন রিসিভ করলো কীভাবে ?
-তন্দ্রা হয়েছে কি, রাত্রে হঠাৎ কারখানায় একটা দুর্ঘটনা ঘটায়...
ওপাশ থেকে ফোনের লাইন কেটে দেয় তন্দ্রা । আমি তড়িঘড়ি করে সিকিউরিটি গার্ডকে ডেকে মোটামুটি বন্ধের প্রসেস বুঝিয়ে দিয়ে ফ্যাক্টরি ম্যানেজারকে বলে বাসার পথে রওনা হই দ্রুত। বাসার গেটে নক করতেই সাবলেট ভাবী গেট খুলে দেয়। আমি দ্রুত আমাদের রুমে প্রবেশ করি। রুমের দরজা বন্ধ করে তন্দ্রা তন্দ্রা বলে ডাকতে থাকি। সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় রশি দেওয়া তন্দ্রার লাশটা ঝুলছে, দেখতে পাই স্পষ্ট।
লেখক আরএমজি সেক্টরে হেড অব এইচ আর হিসেবে কর্মরত।
email: [email protected]