কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহর পূণ্যভূমি যশোর সদর উপজেলার চূড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রাম। আমারও সৌভাগ্য আমিও এই গ্রামের সন্তান। এজন্য আমি ধন্য। তাই গ্রামের প্রতি রয়েছে আমার দায়বদ্ধতা। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে মেহেরুল্লাহ্ অনষ্ঠানমালা নিয়ে, কিছু স্মৃতিচারণ করতে হলে আমাকে পেছন ফিরে দেখতে হবে এখন হতে ৫৭ বছর আগে। আমি যদি এ সঠিক ইতিহাস না লিখি পরে প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত হবে। আগামী প্রজন্ম তা জানবে না।
এবার ফিরে আসি মূল কথায়। দেশ স্বাধীনতার পূর্বকাল। ৬০ এর দশক হতে আমি শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করি নেশার বশে। আমাদের গ্রামের পাশে বাদিয়াটোলা গ্রাম। এই গ্রামের দাউদ হোসেন যশোর পৌরসভার একজন কর্মচারী। ১৯৬৮ সাল। আমাকে একদিন আমন্ত্রণ জানালেন। কর্মবীর মেহেরুল্লাহ্ প্রতিষ্ঠিত ঝাউদিয়া গ্রামের মনোহরপুর এম.ই স্কুল পরিদর্শন করতে। পরিদর্শনকালে স্কুলের দৈন্যদশা দেখে খুবই খারাপ লাগে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকার স্কুলের বেহাল নিয়ে একটি রিপোর্ট ছাপাই। এর পরবর্তী ১৯৬৮ সালে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যশোর এম এম কলেজ হতে অনার্স (বাংলা) শেষ পর্ব পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের জন্য মাস্টার্স পড়ি।
বিজ্ঞাপন
১৯৬৯ সালে আমি স্থানীয় কাজী নজরুল ইসলাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। এরপর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে আমি গ্রাম ত্যাগ করে ঝিনাইদহ মহকুমার দূর্গাপুর গ্রামে মামা বাড়ি ও শৈলকূপা থানার দোহা নাগিরাট গ্রামে শ্বশুর বাড়ি অবস্থান করি। দেশ স্বাধীনতার পর সপরিবারে গ্রামে ফিরে আসি। কিন্তু আমার মাথায় ওই একই চিন্তা মেহেরুল্লাহ্ প্রতিষ্ঠিত স্কুলের দৈন্যদশার কী উপায় হবে?
১৯৬৭ সালে ৫৭ বছর আগের কথা। আমি তখন এম.এ. কলেজের বাংলা অনার্স ক্লাসের ছাত্র। শরীফ স্যার আমাকে জানালেন ‘মসি’ তোমাকে একটি কাজ করতে হবে।
দুর্বলতাবশত: আমাকে মসিউল না বলে সব সময়ই ‘মসি’ বলেই ডাকতেন স্যার। যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরির ক্রয়কৃত বইয়ের একসেসন এর কাজ তোমাকে করতে হবে। স্যার তখন যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক। এ ব্যাপারে তোমাকে লাইব্রেরিয়ান ফজলুল বারী সব শিখিয়ে দেবেন। আমি তাকে বলে দিয়েছি। প্রতিদিন কলেজ শেষে দুপুরে খড়কী ফুফু বাড়ি হতে খেয়ে বিকেল ৩টা হতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দু’বছর যাবত স্বেচ্ছাশ্রমে এই কাজটি সম্পন্ন করেছি। এর ফলে, স্যার খুশি হয়ে আমাকে কলেজের ছাত্রাবস্থায় পাবলিক লাইব্রেরির সাব-কমিটির সদস্য করে নেন। ঐ সময়ে পাবলিক লাইব্রেরির কমিটিতে ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রউফ স্যার ও অধ্যাপক আব্দুল হালিম স্যার। তারা দুজনও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে, একেবারে মূল কথায়। একদিন স্যারকে বললামঃ যশোর ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে মাইকেল মধুসূদন জন্মবাষির্কী পালন করা হয়। তবে কেন মুনশী মেহেরুল্লাহ’র জন্মবাষির্কী অনুষ্ঠান পালিত হবে না। স্যার বললেন ‘‘খুবই উত্তম কথা বলেছো। আগামী দিনে পাবলিক লাইব্রেরির কমিটির সভায় তুমি বিষয়টি প্রস্তাব করবে। আমি তোমাকে এর আগে আমন্ত্রণ জানাব। ১৯৬৭ সাল হতে প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর মাইকেল মধুসূদন জন্মবার্ষিকী ও ২৬ ডিসেম্বর মেহেরুল্লাহ্ জন্মবাষির্কী যশোর শহরের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বিজ্ঞাপন
১৯৭০ সাল। মেহেরুল্লাহ্ স্মৃতি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে মেহেরুল্লাহ্দ্ধর ছাতিয়ানতলার মাটিতে প্রথম উদযাপন হয় মেহেরুল্লাহ্ অনুষ্ঠান। পল্লী কবি জসিম উদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানাই। চূড়ামনকাটি-ছাতিয়ানতলা স্কুল মাঠে তাঁর আগমনে অনুষ্ঠানটি হয়ে উঠে ছিল জমজমাট। সকালে আমার সাথে গ্রামটি পায়ে হেঁটে দেখতে যান। মেহেরুল্লাহ’র পৈত্রিক ভিটাবাড়ি, তার আমলে খননকৃত পুকুর, সিঁড়ি দেখার পর আমার বোনের বাড়ি হাজির হন। বাড়ির আঙিনায় খেঁজুর গাছের রস খেতে তিনি ইচ্ছা পোষণ করেন। তখন বাজে দুপুর বারোটা। গাছের ওলা রস (দোকাট) প্রাণ ভরে পান করেন। এক পর্যায়ে ঘরের মাচার উপর বসে পড়েন। আমরা যারা সাথে ছিলাম এই দৃশ্য দেখে খুবই আনন্দ উপভোগ করি। ঐ দিন বিকেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় স্যার শরীফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এ দিকে স্যারের চাচা শ্বশুরের মেয়ে শ্যালিকা সাজুর বান্ধবী আমার হবু স্ত্রী (যশোর মহিলা কলেজের সহ পাঠিনী) সাথে পাত্র দেখা পর্বটি পূর্ব নির্ধারণ করে রেখেছেন। তা অবশ্য পরে জানতে পারি।
১৯৭০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ দুপুরে আমার কর্মস্থল কাজী নজরুল ইসলাম কলেজে একটি স্কুটার নিয়ে স্যার হাজির। কোন ভূমিকা না করেই স্যার সরাসরি আমাকে জানান এ বিষয়ে তোমার আব্বার সাথে আমার কথা হয়েছে। ব্যস ঐটুকু। স্যারের অটল বিশ্বাস ছিল আমার প্রতি। তাঁর প্রস্তাব আমার ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য নেই। ঐ দিন সন্ধ্যায় যশোর শহরের পুরাতন কসবা বেগম মিলে আমার শ্বশুরের ভাড়া বাসায় বিয়ের শুভ কাজটি সম্পন্ন হয় এই মেহেরুল্লাহ্ অনুষ্ঠানকে ঘিরে।
এরপর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে দেশ স্বাধীনের পর কোনো অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়টি। ১৯৭৮ সাল। যশোরের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। সাংবাদিকতা সুবাদে তার সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তাকে আমন্ত্রণ জানালাম মেহেরুল্লাহ’র অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণের। কিন্তু সমস্যা হলো: পথে কাঁচা রাস্তার অবস্থা এতটা খারাপ যে জিপ গাড়ি নিয়ে স্কুল পর্যন্ত যাতায়াত অসম্ভব। আমাকে একটি শর্ত দিলেন, স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকাবাসীদের নিয়ে রাস্তা নির্মাণ করতে হবে। তার এই আহবানে সাড়া দিয়ে বাদিয়াটোলা ও ঝাউদিয়া গ্রামবাসীদের নিয়ে রাস্তা নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এর সপ্তাহখানেক পর ঝাউদিয়ায় যশোর এম.এম. কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হাই, শরীফ স্যারসহ যশোরে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে জেলা প্রশাসক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে ইতস্ততঃ করছিলেন। অবস্থা দৃষ্টে আব্দুল হাই স্যার ও শরীফ স্যার বললেন: আমরা মসিউলকে চিনি তার অন্য কোন মতলব নেই। সেকোনো দিন চেয়ারম্যান নির্বাচন করবে না। স্যারদের এই কথায় কাজ হলো ঔষধের মতো। এরপর তিনি যশোর জেলা প্রশাসন হতে স্কুল নির্মাণ ও উন্নয়নে ৫০ হাজার টাকা ও বাস সিন্ডিকেট হতে ১ লাখ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা শিল্প মন্ত্রণালয়ে বদলি হন। আমি প্রধান শিক্ষক শামসুর রহমানকে নিয়ে তার সাথে দেখা করি। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমাদের পাঠিয়ে দেন। স্কুলের নাম পরিবর্তনের। ‘মেহেরুল্লাহ্ একাডেমী” শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর অনুমোদনের চিঠি আমাদের হাতে তুলে দেন।
৮০’ দশকে যশোর জেলা প্রশাসনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) ছিলেন অরবিন্দকর। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে ছাত্রাবস্থায় শরীফ হোসেনে ছিলেন তার শিক্ষক। তিনি তার আদর্শে, চিন্তা, চেতনায় ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত। স্যার ইতোমধ্যে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে বদলি হয়ে আসেন। স্যারকে কাছে পেয়ে আরও অনুপ্রেরণা লাভ করেন। যশোর জেলা প্রশাসন হতে আদর্শ গ্রাম হিসেবে বেছে নেন, কর্মবীর মেহেরুল্লাহর গ্রাম ছাতিয়ানতলা। প্রিয় শিক্ষককে আবার কাছে পেয়ে নতুন করে কর্মপ্রেরণা লাভ করেন তিনি। ১৯৯৬ সাল। কর্মবীরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চূড়ামনকাটি স্কুল ময়দানে আয়োজিত ‘শেকড়ের সন্ধানে” প্রথমবারের মত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি তখন বিআরডিবি’র অতিরিক্ত মহাপরিচালক। অনুষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলঃ আমরা যেন আমাদের শেকড় নিজ স্থান গ্রামকে ভুলে না যাই। অনুষ্ঠানকে সফল করে তোলার জন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী গ্রামের ছেলেদের উপস্থিত হওয়ার চিঠি লিখি ফোনে যোগাযোগ করি। বিশেষ করে ঢাকায় অবস্থানকারীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে তাদের অফিস ও বাসায় সাক্ষাৎ করি। এজন্য আমাকে বহু সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। আমি তখন যশোর শহর থেকে গ্রামে এসে সদ্য বাড়ি নির্মাণ করেছি। অনুষ্ঠানস্থলে মেহেরুল্লাহ’র পরিবারের কর্নেল মেহের মহব্বত আমার মত তিনি বাড়ি নির্মাণের ঘোষণা দেন। পরে ‘মেহের কুঞ্জ’ নামে একটি বাসভবন নির্মাণ করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বলেন, ছাতিয়ানতলা আমার ২য় গ্রাম। অনুষ্ঠানে তাকে গ্রামের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। দর্শক-শ্রোতা তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে তাকে স্বাগত জানান।
২০০৮ সালে কর্মবীরের ১৪৬ তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে মেহের মেলা ও শেকড়ের সন্ধানে ১২ বছর পূর্তি ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি মুন্সী মেহেরুল্লাহ্ কমপ্লেক্সে মেহেরুল্লাহ্ ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠান সকালে উদ্বোধনী পর্বে সভাপতিত্ব করেন কর্নেল মেহের মহব্বত। প্রধান অতিথি হিসেবে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ইউনুসুর রহমান উপস্থিত হতে পারেননি। তার স্থলে যশোর জেলা প্রশাসক আব্দুল মালেক প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক মেজর রাশেদ আলী, প্রবীণ সাংবাদিক জমির উদ্দিন আহমেদ টুন। মুখ্য আলোচক ছিলেন মেহেরুল্লাহ্ গবেষক সাতক্ষীরা শ্যামনগর কলেজের অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলাম। বিকেলে আয়োজিত স্মৃতিচারণ মূলক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অধ্যক্ষ (অব:) একরামূল আজিজ।
১৭ জানুয়ারি ২য় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ছাতিয়ানতলা গ্রামের সন্তান বিআরডি’এর পরিচালক শহীদুল আযম হেলাল। প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রফিকুল ইসলাম সরকার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মুস্তাফিজুর রহমান, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সদস্য সচিব মিজানুর রহমান, বিশিষ্ট সাংবাদিক হারুন জামিল, অধ্যাপক কাজী শওকত শাহী, আমিরুল ইসলাম রন্টু, ওস্তাদ শাহ মো. মোর্শেদ ও মাও. সাখাওয়াত হোসেন। সমাপনী পর্বে সভাপতিত্ব করি আমি মো. মসিউল আযম। প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন যশোর জেলা প্রশাসক নেপুর আহমেদ। বিশেষ অতিথির আসন গ্রহণ করেন আর আর এফ’র নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ বিশ্বাস। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক সামসুজ্জামান, মিজানুর রহমান তোতা সভাপতি যশোর প্রেসক্লাব, শিক্ষক নজরুল ইসলাম বুলবুল, চূড়ামনকাটি প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি হেদায়েত উল্লাহ খাঁন।
এরপর বিভিন্ন সময় যশোরের জেলা প’শাসকগণ মেহেরুল্লাহর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসন গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে মুক্তাদির চৌধুরী, মুহ: ফজলুর রহমান, মুস্তাফিজুর রহমান, আব্দুল ওয়াজেদ।
বিশিষ্টজনদের মধ্যে খুলনার সুন্দরবন বইয়ের লেখক আফম আব্দুল জলিল, অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম, প’খ্যাত সাহিত্যিক হোসেন উদ্দিন হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, সিরাজগঞ্জ জেলার সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর বংশধর সাংবাদিক শামীম সিরাজী (উল্লেখ্য, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর অনল প্রবাহ বইটি কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ্দ্ধর পৃষ্ঠপোষকতায় ছাপা হয়)। জেলা তথ্য অফিসার শেখ হাসান উদ্দিন, যশোর জেলা পরিষদের প’ধান নির্বাহী অফিসার জাবেদ আহমেদ যোগদান করেন। মেহেরুল্লাহর খননকৃত পুকুরটির জরাজীর্ণ সিঁড়ি পুন:সংস্কারের যশোর জেলা পরিষদের অর্থায়নে জাবেদ আহমেদের অবদান চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করা হবে।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার দুজন স্যারকে মেহেরুল্লাহর অনুষ্ঠানে আনার সৌভাগ্য হয়েছে। তাদের আগমনে আমরা ধন্য হয়েছিলাম। অনুষ্ঠানগুলো হয়েছিল শ্রীবৃদ্ধি। এদের মধ্যে একের ভিতরে পাঁচ রচনা বইয়ের লেখক ড. গোলাম সাকলায়েন ও খুলনা জেলার কৃতি সন্তান অধ্যাপক আবুতালেব। যশোর জেলা স্কুলের প’ধান শিক্ষক শেখ মোজাম্মেল হক স্যার স্কুলের সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন কয়েক বার।
ধর্মমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন আল-আজাদ ছিলেন আমার কলেজ জীবনের সহপাঠি। তাকে আমন্ত্রণ জানায় মেহেরুল্লাহ্ একাডেমী আয়োজিত অনুষ্ঠানে। পথিমধ্যে বাদিয়াটোলা মসজিদে নামাজ আদায়কালে ৫০ হাজার টাকাও মেহেরুল্লাহ্ একাডেমী সংলগ্ন মসজিদে ১ লক্ষ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
এছাড়া বিশিষ্ট সমাজ সেবক কাজী শাহেদ আহমেদ ও মেহেরুল্লাহ একাডেমীর বিভিন্ন উন্নয়নের পাশাপাশি এলাকার জনসাধারণের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সুবিশাল পাঠাগার ভবন নির্মাণসহ বই ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন।
পরবর্তীকালে মেহেরুল্লাহ একাডেমীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে যশোর ৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ প্রতিষ্ঠানটির পাঁচতলা ভবন নির্মাণের ভূমিকা গ্রহণ করেন।
সর্বোপরী মেহেরুল্লাহ্ একাডেমীর সার্বিক পূর্ণতা লাভ করে বিএনপি সরকার খালেদা জিয়ার শাসন আমলে। জননেতা তরিকুল ইসলাম ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। পরবর্তী ২০০৩-০৪ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে মেহেরুল্লাহ’র স্মৃতির রক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভ করে। প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সাক্ষর সম্বলিত ডাক টিকেট যুক্ত কয়েকটি খাম তরিকুল ইসলাম যশোরের জেলা প্রশাসকসহ কয়েকজনের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাকে দেন।
তিনি ওই বছরেই মেহেরুল্লাহ একাডেমী হয়ে ছাতিয়ানতলা গ্রামে মেহেরুল্লাহ’র মাজার হয়ে চূড়ামনকাটি বাজার পর্যন্ত রাস্তা পাকাকরণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া জন সাধারণের সুবিধার্থে স্বল্প খরচে যাতে দেশ বিদেশে ফোনে কথা বলতে পারেন এজন্য চূড়ামনকাটি পোস্ট অফিস চত্বরে একটি কয়েন বক্স স্থাপন করেন। মাত্র পাঁচ টাকার কয়েন বক্সে ফেললেই তারা কথা বলতে পারতেন।
তার নির্দেশনায় বিটিভি একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আব্দুল হাই শিকদার বিটিভিতে এর সম্প্রচারে দায়িত্ব নেন। ঢাকার অনুষ্ঠানে অংশ নেন মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক প’খ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গফুর, প’ফেসর শরীফ হোসেন, ইসলামি ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম, তমদ্দুন মজলিশের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুস সামাদ, অধ্যাপক মসিউল আযম কে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু অনিবার্য কারণে আমাকে যশোরে ফিরে আসতে হয়। মেহেরুল্লাহ স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহে ধারণকৃত ছবিসমূহ যা প্রদর্শন করা হবে সেই ঐতিহাসিক স্থান মেহেরুল্লাহর জন্মস্থান মাতুলালয়ের ভিটা বাড়ি বারো বাজার ঘোপ, মেহেরুল্লাহর পৈত্রিক নিবাস ছাতিয়ানতলা ভিটা বাড়ি, খননকৃত পুকুর, মেহেরুল্লাহ্’র মাজার প’ভৃতি স্থানে যাই। পরে যশোর শহরে বসবাসকারী মেহেরুল্লাহর পুত্রবধূ লাইলী বেগমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই এবং তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। আমারও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ‘মেহেরুল্লাহর কথা মালা” নামে কথিকায় আব্দুল হাই শিকদার কৃতজ্ঞতা স্বীকারে আমার নামটি ব্যবহার করেন। পরপর দুই দিন এটি প’চারের ব্যবস্থা করেন। প’তি বছর ডিসেম্বর মাসে ২৬ ডিসেম্বর, ১০ পৌষ শীতকাল এলেই ঝাউদিয়া মেহেরুল্লাহ্ একাডেমীর আশপাশের বাড়িতে রসের পিঠা তৈরির ধূম পড়ে যেত। সন্ধ্যার পর মহিলারা হাঁড়ি ভর্তি পিঠা পাঠিয়ে দিতেন আমাদের কাছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো পিঠা দিয়ে। তখন এটি এলাকায় একপ্রকার রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল।
মেহেরুল্লাহ্ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার কর্ম, আর্দশ আমাদের মাঝে জীবিত রয়েছে। আমাদের কাজ হবে তার আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখা। মেহেরুল্লাহ্ অনুষ্ঠানকে ঘিরে যারা কাজ করেছেন তাদেরকে স্মরণ করা। তাদের অবদানকে চির অম্লান করে রাখা। তাই আজকের দিনে এই হোক আমাদের শপথ- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
পরিশেষে ১৯৯১ সালে শরীফ হোসেন স্যারের লেখা ‘শিকড়ের সন্ধানে যাত্রা” একটি কবিতা অনুষ্ঠানে পঠিত হয় স্যারের উপস্থিতিতে। সেটি হুবহু তুলে ধরা হলো- শিকড় সন্ধানে যাত্রী
অধ্যাপক শরীফ হোসেন
দুঃখীর দারুণ দিন দিন দীর্ঘতর
অধীর অপেক্ষায়
কখন মেঘের ফাঁকে একটু আশার আলো
কোনভাবে কাছে পাওয়া যায়।
অথচ জানেনা তারা
কোন্ পথ সুখ গুলি আনবার পথ। সুখের পায়রা ওড়ে বিলাসের অথৈ আকাশে
আর ভাবে ফুর্তি কত উত্থান
আসলে যা রসাতলে নিশ্চিত পতন সর্বনাশে সুধায় সলিলে।
অথচ বোঝে না তারা
কোন পথ আনন্দের উঠবার দথ।
ভ্রান্তি দর্প দিশেহারা দুদিকের এই সব দিক ভুল দেখে
বেদনার্ত অনেক নাবিক পথ খোঁজে অবিরাম ডুবো পাহাড়ের ভিড়ে
চোরাবালি ঘূর্ণির পারাবারে
চেতনার বাতিঘর জ্বেলে রাখবার মনের গভীরে যত মত তত পথ কত পথ
তারি মাঝে ক্লান্তহীন স্বপ্নবাহী রাহী মানুষের মাপকাঠি পড়ে বাঁচবার মানে পেতে চায়।
খুঁজে চলে মরণ জয়ের রাহা
জানবার জানাবার ব্যাপক সড়ক। মনে তাই কল্পনা কত ভাষা কত সুর
গণ-জ্ঞান আলোড়নে সবাইকে
জড়ানোর সিঁড়ি নির্মাণ
গ্রামে গিয়ে গ্রামে থেকে
লেখাপড়া বলায় সমান। শহরের শত কাজ মৌমাছিদের
গড়ে তোলা নয়মি উচাক
জীবনে জীবন যোগে সুধায় সুধায়
সকলের দিল্ ভরে যাক।
যদি কিছু ফুল ফোটে পথে ঘাটে মনে ময়দানে
যদি কিছু দীপ জ্বলে ভোগবাদী গুহার বিবরে
খানা ডোবা ঝোপ ঝাড়ে বাঁশের ছায়ায় হাজার ধরার নীড়ের মহানদী জেগে উঠে
সমবায় স্রোতে যদি দশদিকে হয় আগুয়ান
সম্পত্তি শাসিত লোভে ছিন্ন ভিন্ন বিনষ্ট সমাজ
যদি জাগে মানুষের সমতার একতার গান
হোক তারা অতি ছোট খুব খাটো শুধু হাতে যেন জন্মায়
ভালোবাসার রেণু মাখা
সঠিক শিকড় আর খাঁটি বীজ
এতো আশা এতো সাধ দিয়েছেন মাবুদ রহিম
মুনাজাত তাঁরি দরবারে তিনিই পূরণ করার
একমাত্র মালিক করিম।
মো. শরীফ হোসেন
২০/০৯/৯১
লেখক: প্রবীণ সাংবাদিক, কলাম লেখক ও উন্নয়নকর্মী।