বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

গল্প

বুলেট বিদ্ধ প্রেম

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী
প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

বুলেট বিদ্ধ প্রেম

॥ ১ ॥
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর দিনগুলো রংধনুর মতো রঙিন ভাবে এগুচ্ছিলো আরিশার। পছন্দের সাবজেক্টে মন দিয়ে পড়াশোনা, খুব ভালো কিছু বন্ধু পাওয়া, শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় নিজের ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলোর ডানা মেলা সবকিছুকেই খুব উপভোগ করছিল সে। ছেলেবন্ধু ছিল না, তবে ক্লাসের একটি ছেলে প্রায়ই মনোযোগ কাড়তো আরিশার। ছেলেটা এতোই কম কথা বলতো যে, কয়েক সপ্তাহ পর তার প্রথম কথা শোনার আগ পর্যন্ত আরিশা ভেবেছিল, ছেলেটি বোধহয় বোবা। ছেলেটার পোশাকেও থাকতো অযত্নের ছাপ, আভিজাত্যের অভাব। সবসময় নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতো, চলাফেরা চাহনীতেও থাকতো ভীতু ভাব।

একদিন কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে, ছেলেটার সাথে কথা বলতে গিয়েছিল আরিশা। কিন্তু ছেলেটা এমন নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল, আর বারবার কপালের ঘাম মুছছিল যে, আলাপ বেশিদূর আগানোর আগ্রহ পায়নি। 


বিজ্ঞাপন


চলে আসার সময় ছেলেটির কথা আরিশার কানে এখনো বাজে। ‘খুব ভালো লাগলো, তোমার সাথে কথা বলে। এ পর্যন্ত কোন মেয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসেনি। আমার বন্ধু এই বইগুলোই সারাদিন আমার সাথে কথা বলে, এজন্য অন্যদের সাথে কথা বলা হয়না আমার।’

ছেলেটা যে মোটেও বাড়িয়ে বলেনি, তার প্রমাণ প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্টেই পাওয়া গেল। প্রথম তো হয়েছেই, তার উপর এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর কয়েকভাবে বিশ্লেষণ করেছিল যে, স্বয়ং ভিসি স্যার তাকে ডেকে বাহবা দিয়েছিলেন। 

ছেলেটার নামটাই তো বলা হলো না। আবীর তার নাম।

॥ ২ ॥


বিজ্ঞাপন


রেজাল্টের পর থেকে আবীরের চারপাশে ছেলেমেয়েদের আনাগোনা বেড়ে গেল। সবাই তার বন্ধু হতে চায়, কেউ কেউ যায় পড়া বুঝে নিতে। আবীর নার্ভাস ভঙ্গিতে কথা বলতো, পড়া বুঝিয়ে দিতো। ক্যান্টিনে একা একা খেতো। কিছুদিনের মধ্যেই তার নাম হয়ে গেলো ‘ভীতু আইনস্টাইন’। 

আমি আবার আমার জগতেই হারিয়ে গেলাম। আবীরের সাথে মাঝেমধ্যে চোখাচোখি হলে, সে একটু হাসি দেবার চেষ্টা করতো, তবে কথা বলার সাহস করতো না।

শুধু একদিন আরেক লাইন কথা বলেছিল, ‘আমার বই বন্ধুরা কিন্তু তোমাকে পছন্দ করেছে। তোমার সাথে গল্প করতে চায়।’

॥ ৩ ॥ 

জুলাই মাসে যখন নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ আর পুলিশ বিজিবি বাহিনী, তখন আমরাও মুখ বুজে এসব অন্যায় সহ্য করে নিতে পারলাম না।

১৭ জুলাই আন্দোলনকে কবর দিতে পেরেছে ভাবা জানোয়ারদের ঘুম হারাম হয়ে গেলো, ১৮ জুলাই আমাদের তীব্র আন্দোলন আর প্রতিবাদে।

বিবেকের তাড়না, অন্যায়ের প্রতিবাদ আর দেশপ্রেমই আমাদেরকে একেকজন অকুতোভয় যোদ্ধায় পরিণত করেছিল। 

ছেলেমেয়ে সবাই আমরা রাস্তায় নামলাম খালি হাতে কিন্তু বুকে বারুদ আর মুখে তীব্র প্রতিবাদ নিয়ে। দফায় দফায় টিয়ারশেল, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড আর জলকামানের আঘাতে পিছু ফিরতে হচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু খানিকটা বিশ্রাম আর আহতদের ফাস্ট এইড দিয়ে কিছুটা সুস্থ করেই আবার বেরিয়ে পড়ছিলাম।

হঠাৎ একসময় লক্ষ্য করলাম, আবীর আমার সামনে। বান্ধবী প্রিয়া বললো, আবীর তো শুরু থেকেই আছে, আর সবসময় আছে তোর আশেপাশেই। কেন, তুই খেয়ালই করিসনি এতোক্ষণ? আসলেই আমি খেয়াল করিনি, ভীতু আইনস্টাইনকে। আর আশাও করিনি এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে সেও আমাদের সাথে আসবে।

॥ ৪ ॥ 

হঠাৎ একসময় শুরু হলো আমাদের ওপর তীব্র গুলিবর্ষণ। আশেপাশে অনেকেই লুটিয়ে পড়ল। আবীর, যে কিনা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাও বলেনি, সে উল্টো ঘুরে আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্যাম্পাসের ভেতর নিয়ে যেতে লাগলো। আমার চোখেমুখে রক্তের ছিটেয় টের পেলাম, আবীরের গুলি লেগেছে। শার্টের দুই হাতা এবং পিঠের অংশ কিছুক্ষণের মধ্যে রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে গেলে বুঝলাম, দুই হাত আর পিঠে গুলি লেগেছে ওর। আমার হাত পিছলে যাচ্ছিলো আবীরের রক্তে।

আবীর ঢাল হয়ে আমার শরীরে ঢুকতে আসা বুলেটগুলোকে নিজ শরীর দিয়ে না ঠেকালে, আমার নামটা হয়তো সেদিন শহীদদের তালিকায় যোগ হতো। আমাকে কোনমতে ভেতরে ঢুকিয়ে, গেইটটা লাগানোর জন্য যেই না ঘুরেছে, ওমনি আরেকটি বুলেট সরাসরি আবীরের মুখে কোথাও আঘাত হানে। একটা চিৎকার দিয়ে, ‘আরিশাকে কেউ দেখে রেখো’ বলেই সে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে এবং পুরোপুরি নিশ্চুপ নিস্তেজ হয়ে যায়।

আমি দেখলাম, আবীরের সারা মুখ রক্তে ভিজে গেছে, চেহারা বোঝার কোনো উপায়ই নেই৷ এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে, আমিও চিৎকার করে জ্ঞান হারালাম।

॥ ৫ ॥ 

জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি, পাশে উদ্বিগ্ন বাবা মা আর কজন বান্ধবী। আমার হাতেও কোন একসময় একটি গুলি লেগেছিলো, কিন্তু আমি টের পাইনি। আবীর কোথায়, আমি ওর কাছে যাবো, বলেই বিছানা থেকে উঠতে গেলাম। কিন্তু তীব্র ব্যথা আর মাথা ঘুরে আবার বিছানাতেই পড়ে গেলাম। বান্ধবীরা বললো, আবীরকে কয়েকজন বন্ধু মিলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, ও ভালো হয়ে যাবে।

আমার দুচোখে তখন পানির বন্যা আর আবীরের কাছে যাবার আকুতি। আমার মন বলছিলো, ও বেঁচে নেই। আর ওকে শেষ দেখাটা দেখতে না পারলে, আমি আজীবন ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে মরবো। আব্বু বললো, মা শান্ত হও। পরিস্থিতি খুব খারাপ। কে কোথায় আছে, খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। তবুও আমি চেষ্টা করছি, আবীরের খোঁজ বের করার।

আমার বাবা খুব বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী। আমি বললাম, বাবা তুমি আজকের মধ্যেই আবীরকে খুঁজে দাও। বাবা আমার মাথায় কিছুক্ষণ পরম মমতায় হাত বুলালেন। তারপর কিছুটা দূরে গিয়ে একের পর এক ফোন করতে লাগলেন। 

॥ ৬ ॥ 

সমস্ত হাসপাতাল, মর্গ কয়েকবার করে খুঁজেও আবীরের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। এদিকে আমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ, কথাও বলতে ইচ্ছে হয় না কারো সাথে। সারাদিন স্যালাইন চলে আর জোর করে নাকে নল দিয়ে খাওয়ানো হয়। এরমধ্যে একদিন স্বপ্ন দেখলাম, কয়েকজন পুলিশ আবীরের নিথর দেহ আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে... আমি চিৎকার করে জেগে উঠলাম।

পাঁচদিন পর একটা আশার খবর পেলাম। বুকে, পিঠে গুলি লাগা আর মুখে গুলির আঘাত পাওয়া এক ছাত্রকে পাওয়া গেছে, কিন্তু মুখে ব্যান্ডেজ থাকায় আর কোনো আইডি কার্ড না থাকায়, তার পরিচয় জানা যায়নি বা কেউ তাকে শনাক্ত করতে পারেনি। আমি বাবাকে বললাম, প্লিজ বাবা আমাকে নিয়ে চলো।

॥ ৭ ॥ 

হাসপাতালটিতে পা রাখার সাথে সাথে আমার হৃদপিণ্ড ভয় আর উত্তেজনায় ধড়ফড় করতে লাগলো। বারবার আল্লাহর কাছে চাচ্ছিলাম, ছেলেটা যেন আবীরই হয়, আর আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ করে দেন। অবশেষে পৌঁছালাম সেই ওয়ার্ডের কাছে, যেখানে যন্ত্রণায় কাতরানো ছেলেটা আবীরও হতে পারে৷ তখন হাঁটার শক্তিও পাচ্ছিলাম না। বাবাকে বললাম, বাবা আমাকে ধরো, আমি পড়ে যাবো। একদিকে বাবা আর একদিকে মা কে শক্ত করে জড়িয়ে বিছানাটার কাছে গেলাম। পুরো মুখে ব্যান্ডেজ, গলা ফুটো করে টিউব ঢোকানো, হাতে বুকে ব্যান্ডেজ জড়ানো একটা মমি যেন শুয়ে আছে।

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ওর হাতটা ধরলাম। তারপর চাদর উঠিয়ে ওর পা টা দেখলাম। পা নাড়ানোর স্বভাব ছিলো বলে, অনেকবার ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর চাহনি দিতাম৷ এজন্য আবীরের পা বেশ পরিচিত ছিলো আমার। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, এই তো আবীর। তোমার মেয়েকে বাঁচাতে যেয়ে আজ নিজে জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে। আমি ওর পাশে থাকবো। ও সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত ওর সেবাযত্ন করবো।

॥ ৮ ॥ 

ডাক্তারের কাছে জানা গেলো, আবীরের অবস্থা খুবই খারাপ। ছররা গুলি নাক মুখ তো চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছেই, দুই চোখেও মারাত্মক আঘাত করেছে৷ আদৌ সে দৃষ্টি ফিরে পাবে কিনা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। নাক মুখে অপারেশন হয়েছে বলে, গলা ফুটো করে টিউব দিয়ে শ্বাস নেওয়ানো হচ্ছে। একটা হাতের ব্লিডিং এখনো বন্ধ করা যাচ্ছে না। হাতটা কেটে ফেলা ছাড়া ওকে বাঁচানো যাবে না হয়তো। শুনে আমি পাথর হয়ে গেলাম। আমার মতো সাধারণ একটা জীবনকে বাঁচাতে যেয়ে একটি অসাধারণ প্রতিভাধর জীবন শেষ হয়ে যাবে? বাবাকে বললাম, তোমার মেয়ের জীবনের দাম কতো তোমার কাছে? বুদ্ধিমান বাবা বুঝে গেলেন, আমি কি বলতে চাইছি। বাবা বললেন, আমি আবীরকে সিঙ্গাপুর পাঠাবো চিকিৎসার জন্য। যতো দ্রুত সম্ভব সব ব্যবস্থা করছি।

॥ ৯ ॥ 

প্রায় দুই মাস হলো আবীরকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে আমরা। আবীরের বাম হাতটা কেটেই ফেলতে হয়েছে। কয়েকবার সার্জারির পর মুখের অবয়ব এখন অনেকটাই ফিরে এসেছে, কথাও বলতে পারে। কিন্তু চোখে এখনো কিছু দেখতে পায় না। চতুর্থবার অপারেশনের পর দুদিনের জন্য কিছুটা দেখতে পেয়েছিল, কিন্তু সেটা আর স্থায়ী হয়নি। ডাক্তাররা মোটামুটি বুঝিয়ে বলেছেন, আরেকবার শেষ চেষ্টা করবেন। তবে এবারও দৃষ্টি ফিরে না আসলে, আবীর চিরকাল আর আলোর দেখা পাবে না।

॥ ১০ ॥ 

দুই মাস আমি সবসময়ই আবীরের পাশে থেকেছি। নিজে ভুলে থাকা এবং ওকে ভুলিয়ে রাখার জন্য কতো যে গল্প করতাম, বিভিন্ন জোকস বলতাম, স্বপ্ন দেখাতাম সুস্থ হয়ে পৃথিবীটাকে নিজের মেধা দিয়ে জয় করার। আবীরের কথা বলতে কষ্ট হতো। ওর দুটো কথা আমার হৃদয়কে চুরমার করে দিতো।

বলতো, আরিশা এখন তোমাকে আমার সারাক্ষণ শুধু প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারি না। যখন চোখ দুটো ভালো ছিল... তখন কেন যে দেখে নিলাম না!

আবার বলতো, এখন তোমার সাথে এতো কথা বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারি না। যখন সব ঠিক ছিল, তখন কেন কথাগুলো মনের সিন্দুকে জমা করে রেখেছিলাম? পড়তে পড়তে কতোবার আনমনা হয়ে যেতাম, তোমার কথা ভাবতাম, বইয়ের পাতায় তোমার মুখ ভেসে উঠতো.... কিন্তু দু পা এগিয়ে, তোমার কাছে কেন যেতাম না?

আবীর দেখতে পেতো না বলে বুঝতো না, আমার চোখের অবিরাম নীরব বৃষ্টিতে প্রায় দিনই আমার জামা ভিজে যেতো। বহু কষ্টে নিজেকে একটু ঠিক করে বলতাম, তোমার সমস্ত অপূর্ণতাগুলো আমি কানায় কানায় পূর্ণ করে দেবো আবীর.... আমার ভালোবাসা দিয়ে। তুমি বিশ্বাস আর ভরসা রাখো। মানুষের একটা প্রাণ একটা শরীরে বাস করে, আর আমাদের দুটি প্রাণ মিলেমিশে না হয় একটা শরীরেই সুখের নীড় বাঁধবে।

॥ ১১ ॥

আরো একমাস পর দেশে ফিরলো আবীর ও আরিশার পরিবার। ডাক্তারদের শত চেষ্টাতেও আবীরের পৃথিবীটা অন্ধকারই রয়ে গেলো। কোনদিন আর সুন্দর এই পৃথিবীতে আবীরের জন্য ভোর আসবে না। সাতদিন আগের শেষ অপারেশনটাও ব্যর্থ হবার পর থেকে আরিশার চোখ যেন সত্যিই জলপ্রপাত হয়ে গেছে। এমনকি ঘুম থেকে উঠেও দেখে বালিশ ভিজে একাকার হয়ে আছে।

এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে, দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় আরিশা। উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে, দেখো আবীর... আমাদের আন্দোলনকে কি অদ্ভুত সুন্দর ভাবে সব দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পরক্ষণেই আরিশা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আবীর বলে, আরিশা তুমি পাশে থাকলে, আমার কোন অপূর্ণতা নেই। তোমার চোখেই পৃথিবীটাকে ঠিক দেখে নিতে পারি আমি। চোখ মুছে আরিশা আবীরকে ছবিগুলো বর্ণনা করতে থাকে... আর আবীরের চোখেমুখে মুগ্ধতা, মুখে প্রশান্তির দ্যুতি ঝলমল করতে থাকে৷

॥ ১২ ॥ 

আরিশার মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে, বাবা তড়িঘড়ি করে ছুটে আসেন, কি হয়েছে? মা বললেন, তোমার মেয়ে পাগল হয়ে গেছে৷ সে ওই অন্ধ পঙ্গু আবীরকে বিয়ে করতে চায় এবং এখনই। তাকে বোঝাও, দুদিনের আবেগ আর জীবনের কঠিন বাস্তবতা এক না। আরিশার বাবা বললেন, মা তুমি অস্থির আছো, এখন এসব কথা ভেবো না। আর ফাস্ট ইয়ারে আমি আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কোন চিন্তাকেই প্রশ্রয় দেব না। পড়াশোনা শেষ হোক, তখন এগুলো ভাবা যাবে।

আরিশা আকুতির স্বরে বললো, না বাবা, আমাকে ছাড়া আবীর অপূর্ণ। এখন প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে ওর পাশে থাকতে হবে। আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে পাশ করবো।

এবার বাবাও রেগে গেলেন। আবীরের জন্য যা যা করা সম্ভব সবই আমরা করেছি। দরকার হলে, আজীবন ওর ভরণ পোষণ এবং পড়াশোনার দায়িত্ব আমি নেব। কিন্তু আমার মেয়ের জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করে দিতে পারবো না। আল্লাহ তোমার হায়াত রেখেছিলেন বলেই তুমি বেঁচে আছো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করো, আবীরের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেবার কথা চিন্তা করো না।

বাবা, মা ... তোমরা বুঝতে পারছো না। জীবন বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা থেকে না, আবীরকে আমি আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। একটা দিনও ওর থেকে দূরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লিজ তোমরা আমার ভালোবাসাকে মেনে নাও।

॥ ১৩ ॥

আবীর বললো, আরিশা তুমি আমাকে বিয়ের কথা ভাবছো? আমি কিন্তু কখনোই ভাবিনি আর ভাবতেও পারবো না।

এসব তুমি কি বলছো আবীর? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? আমি যে তোমাকে কতোটা ভালোবাসি সেটা তুমি অনুভব করোনি?

খুব বেশি ভালোবাসি তোমায় আরিশা, তুমি আমাকে যতোটা ভালোবাসো হয়তো তার চেয়েও বেশি।

দেখো আরিশা, আমি আকাশ ভালোবাসি কিন্তু জানি কোনদিন আকাশ ছুঁতে পারবো না। আমি ঝিরঝিরে মিষ্টি বাতাসকে ভালোবাসি, কিন্তু কখনো বাতাসকে নিজের কাছে আটকে রাখতে পারবো না। আমি সমুদ্র ভালোবাসি, কিন্তু সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারবো না। চাঁদ, মায়ের কোল থেকে আমার ভালোবাসা। কিন্তু চাঁদকে ছুঁয়ে দেখার কল্পনাও কোনদিন করিনি। ভালোবাসলেই পেতে হবে, এমন নিয়ম তো নেই। বরং দূর থেকেই আজীবন গভীরভাবে ভালোবাসা যায়।

দেখো আবীর, আমি আকাশ, বাতাস, চাঁদ কিংবা সমুদ্র নই। তোমার মতোই রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ। আর নারী পুরুষের ভালোবাসা পূর্ণতা পায় বিয়েতে... এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

আবীরকে আর কিছু বলতে না দিয়েই ঝড়ের গতিতে বের হয়ে গেলো আরিশা।

॥ ১৪ ॥ 

প্রিয় আরিশা, 

তোমার ভালোবাসার অন্ধ মানুষটা কম্পিউটারে তোমায় লিখছে। বানান ভুল না ঠিক হচ্ছে সেটা বোঝার সাধ্যও তার নেই। তুমি পাশে নেই, এটা খুব তীব্রভাবে অনুভব করছি।

আমাদের দুজনেরই বয়স এখন ২১। যদি আল্লাহ আরও ৪০ বছরও বাঁচিয়ে রাখেন, আমাকে এই পঙ্গু এবং অন্ধ জীবন নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। গত চার মাস তুমি দিন রাত যেভাবে আমার সেবা-যত্ন করেছো, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছো, প্রতিটা কাজে সাহায্য করেছো, চল্লিশ বছর সেটা করতে পারবে না। পৃথিবীর কেউই পারবে না। কয়েক বছরেই হাঁপিয়ে উঠবে। বোঝা মনে হবে আমাকে। আমি তোমার ভালোবাসার মানুষ হয়েই থাকতে চাই আজীবন। যেদিন থেকে বুঝবো তোমার বোঝা হয়ে গেছি, সেদিন থেকেই জীবনটা আমার অর্থহীন হয়ে যাবে। বেঁচে থেকেও মৃত্যু ঘটবে আমার।

শুধু তোমার কথা বলছি কেন, আর দু এক বছর পর দেশের সব মানুষই ভুলে যাবে জুলাইয়ে আমাদের আত্মত্যাগের কথা। তখন সমাজের করুণার পাত্র আর বোঝা হয়েই থাকতে হবে বাকিটা জীবন। চাকরি পাবো না, অন্ধ বলে ব্যবসাও করতে পারবো না। দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটাতেও হয়তো ভিক্ষা করতে হবে অথবা ডাস্টবিন হাতড়ে পঁচা বাসি খাবার খুঁজতে হবে।

যদি তোমাকে বিয়ে করি, কিছুদিন হয়তো সুখের সাগরে ভেসে বেড়াবো। তারপর যখন উত্তাল সাগর পাড়ি দেবার সময় আসবে, তখন আমাদের ভালোবাসার ঘরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে৷ তার চেয়ে, থাক না ঘরটা কল্পনার জগতেই আজীবন সুন্দর এবং সাজানো - গোছানো - রঙিন। জীবনে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, জানবো আমার মিষ্টি বউ আরিশা ভালো আছে, আর আমাকে সবসময় ভালোবাসছে। 

বিয়ের পর আল্লাহ যদি আমাদের সন্তান দেন, তখন আমার কষ্টগুলোকে কিভাবে ভাগ করে নেবে তুমি? কোনদিন সন্তানদের মুখ দেখতে পারবো না, ওদের হাসি দেখতে পাবো না, ওদের কোলে নিতে পারবো না, ওদের সাথে অন্য বাবাদের মতো খেলতে পারবো না, ওদেরকে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারবো না। এই কষ্টগুলো থেকে তো মুক্তির কোন উপায়ও নেই।

অন্ধ চোখ থেকে আল্লাহ শুধু আলোটাই কেড়ে নেন। সাথে যদি চোখের পানিগুলোও কেড়ে নিতেন, তাহলে খুব ভালো হতো। এই চিঠিটা লিখতে যেয়ে রুমাল এবং টিশার্টটাও ভিজে গেছে৷ ভালোবাসার শেষ উপহার হিসেবে এদুটো তোমায় দিলাম। সারা জীবনের চোখের পানি দিয়ে হয়তো তোমার জন্য একটা দীঘি বানিয়ে রেখে যাবো, যেখানে পদ্ম আর শাপলা ফুল ফুঁটবে শুধু তোমার জন্যই।

আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না। অনেক দূরে পালিয়ে এসেছি আমি, এই চিঠি তুমি পাবার আগেই।

তোমাকে ভালোবেসেছি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। সেজন্যই তোমার আগে মরতে চেয়েছি, তোমায় বুকে আগলে রেখে। এখন আমি কি করে তোমাকে একটা মৃত জীবনের পথে ঠেলে দিতে পারি... বলো? 

আমার এই অন্ধ পঙ্গু জীবনটা যেন পুরোপুরি বৃথা না যায়, পারলে সেই চেষ্টাটা করো। নিজেকে যোগ্যতমভাবে গড়ে তোলো আর দেশের ভবিষ্যৎটাকে সুন্দর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করে যেয়ো।

ইতি,
শুধু এবং শুধুই তোমার আবীর।


লেখক: ডা. এজাজ বারী চৌধুরী 
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও ইউনিট চিফ
ডায়াবেটিস কেয়ার ইউনিট- 
মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড, ধানমন্ডি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর