images

জাতীয়

অসময়ের বৃষ্টিতে কৃষকের মাথায় হাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪০ পিএম

বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ কারও কাছে বিনোদনের উৎস, কারও জন্য আবার মহাসর্বনাশ। এই আবহাওয়ায় কেউ বিছানায় হেলান দিয়ে হেডফোনে প্রিয় গান শুনতে ব্যস্ত, কেউ বাসায় খিঁচুড়ি রান্নায় ব্যস্ত, বৃষ্টির ঠান্ডা আবেশে মজা করে খাবে বলে, কেউ আবার ছুটছেন তার ক্ষেতে, কষ্টে বোনা ফসল ভেসে যায় কি না। অসময়ের এই বৃষ্টিতে মাথায় হাত পড়েছে এমন অনেক কৃষকের।

শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় অস্বাভাবিক বৃষ্টি। শনিবারও (১ নভেম্বর) তা অব্যাহত। এদিন সন্ধ্যায় ঝুম বৃষ্টি নেমেছে রাজধানী ঢাকাতেও। তবে অসময়ের এমন বৃষ্টিতে ভদ্রলোকের শহর ঢাকার চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা। ফসল ডুবে এবং ভেসে গিয়ে মারাত্মক ক্ষতির মুখে তারা।

ঢাকা মেইলের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকেই তারই কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো-

naogaon_20251101_124816515

দিনাজপুরে বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ধান-আলু-সবজির খেত 

জেলায় কয়েক দিনের টানা বর্ষণে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে কৃষকদের রোপা আমন ধান, আগাম আলু ও বিভিন্ন মৌসুমি সবজির খেতে পানি জমে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক জমিতে ধানগাছ লুটিয়ে পড়েছে, আর বীজতলা ও সবজি খেতে পানি জমে বীজ পচে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা ইতোমধ্যে ধান কাটা ও ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু টানা বৃষ্টিতে পাকা ধান এখন বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। নিচু জমির অধিকাংশ রোপা আমন খেতে পানি জমে ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আগাম আলু ও সবজি খেতেও একই চিত্র।

বোচাগঞ্জ উপজেলার কৃষক সবুজ রায় বলেন, ‘কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে আমার পাঁচ বিঘা জমির ধান একেবারে লুটিয়ে পড়েছে। বৃষ্টি যদি আরও কয়েক দিন চলে, তাহলে পুরো ফসল শেষ হয়ে যাবে।’

একই এলাকার কৃষক দিনেশ রায় বলেন, ‘বৃষ্টিতে ফসল ডুবে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যে পানি না নামলে ধানগাছ পচে যাবে, পুরো বছরের পরিশ্রম শেষ। আমরা এখন দিশেহারা হয়ে গেছি। সার, বীজ, শ্রম—সবকিছুতে খরচ করেছি ধার করে। যদি ফসল বাঁচাতে না পারি, তাহলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।’

আগাম আলু চাষি আব্দুল মালেক বলেন, ‘আমি দুই বিঘা জমিতে আগাম আলু রোপণ করেছিলাম। ভাবছিলাম এবার আগাম বাজারে ভালো দাম পাব। কিন্তু হঠাৎ টানা বৃষ্টিতে পুরো জমি পানিতে ডুবে গেছে। এখন আলুর চারা পচে যাচ্ছে। পানি না নামলে সব শেষ। সার, বীজ, কীটনাশকে যা খরচ করেছি, সব ডুবে গেল।’

gaibandha_1_20251101_154549569

গাইবান্ধায় মাটিতে মিশে গেছে আমন চাষিদের স্বপ্ন

এই জেলার অধিকাংশ পরিবার কৃষি ফসল উৎপাদন করেই মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেন। অন্যান্য ফসলের চেয়ে সবচেয়ে লাভজনক হচ্ছে- আমন ধানের আবাদ। চলতি মৌসুমে এই আবাদে সার-কীটনাশক প্রয়োগ শেষে দেখা দিয়েছিল বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা। এরই মধ্যে কারেন্ট পোকার আক্রমণ আর হেমন্তের বৃষ্টিতে ধানক্ষেত নুয়ে পড়ে মিশে যাচ্ছে পানিতে। এতে ক্ষতির শঙ্কায় ভুগছেন কৃষকরা।   

শনিবার (১ নভেম্বর) সরেজমিনে গাইবান্ধা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে- রোপ আমন ধানের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। যেখানে ধানের শীষ পরিপক্ব হওয়ার কথা, সে মুহূর্তে পোকার আক্রমণসহ বৃষ্টির পানিতে নুয়ে পড়া ধানগাছ কেটে দেওয়া হচ্ছে গবাদীপশুর মুখে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হেলে পড়া থোড় ধান, আধাপাকা ধানগাছগুলো কেটে গরুকে দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ তা আঁটি বেঁধে বিক্রি করছেন হাট-বাজারে। এই দুর্যোগে কী পরিমাণ ধানের ক্ষতি হয়েছে সেটি জানাতে পারেনি কৃষি বিভাগ। তবে কৃষকরা ধারণা করছেন- পোকা আর বৃষ্টিতে এ জেলায় প্রায় হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হওয়ার পথে।

স্থানীয় কৃষক জহুরুল ইসলাম জানান, ‘এ বছর তিনি দুই বিঘা জমিতে রোপা আমন চাষাবাদ করেছেন। ইতোমধ্যে এ ক্ষেতে থোড় থেকে ধানের শীষ বেড় হয়। এরই মধ্যে বৃষ্টি-বাতাসে তার ২৫ শতক খেতের ধানগাছ হেলে পড়েছে পানির ওপরে। এতে প্রায় ১০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।

আরেক কৃষক জহির উদ্দিন বলেন, শুধু বৃষ্টির পানি নয়, এর আগে কারেন্ট পোকার আক্রমণে আমার ২৫ শতক আমন ধানখেত নষ্ট হয়েছে। এ নিয়ে চরম হতাশায় ভুগছি।

gaibandha_2_20251101_154606069

নওগাঁয় বৃষ্টিতে ধান-আলু-সবজির ক্ষতির আশঙ্কা

আলু চাষ করে গতবছর লোকসানে পড়েন নওগাঁর কৃষকরা। সেই লোকসান পুষিয়ে নিতে এবার আগাম আলু চাষ শুরু করেন কৃষকরা। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কয়েদিনের বৃষ্টিতে ফসলি জমিতে পানি জমেছে। যেসব জমিতে আগাম আলু বপণ করা হয়েছে, সেসব জমিতে পানি জমায় রোপণ করা আলুর বীজ পচে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যে কারণে আলু চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এছাড়াও রোপা আমন ধান ও আগাম শীতকালীন শাক-সবজি ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আলু আবাদের জন্য কোথাও কোথাও প্রস্তুত করা হয়েছিল জমি, কোথায় সদ্য রোপণ করা হয়েছে বীজ। বৃষ্টিতে জমিতেই জমেছে পানি। ফসল বাঁচাতে পানি সরানোর চেষ্টা করছেন কৃষকরা। শুধু আলু খেত নয়, আগাম জাতের শীতকালীন ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, মরিচ, বেগুন, মুলাসহ বিভিন্ন শাক-সবজির গাছও মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। যেসব খেতের সবজি এখনো ভালো রয়েছে, তা রক্ষায় প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন কৃষকেরা। এছাড়াও মাঠের আধা-পাকা ধান হেলে পড়েছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে পানিতে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেল বছর আলুর ভালো দাম না পাওয়ায় এবছর ভালা লাভের আশায় আগাম আলু চাষ শুরু করেন কৃষকরা। তবে কয়েকদিনের বৃষ্টি হওয়ায় আলুর জমিতে পানি জমে। ফলে বৃষ্টির পানিতে একদিকে রোপণ করা বীজ পচে গেলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা। 

অন্যদিকে, অনাবাদী জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের পর বীজ রোপণ কবে করা যাবে তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। শীতকালীন শাক-সবজির জমিতেও দেখা দিয়েছে শিকড় পচে যাওয়ার সমস্যা। পানি দ্রুত না সরলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষকেরা।

home_20251101_124333748

এদিকে বৃষ্টি শুধু ফসলেরই ক্ষতি করেনি, সঙ্গে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষও। শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতভর ভারী বৃষ্টিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পানি ঢুকেছে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি ও ছাত্রাবাসেও।

অধিকাংশ রাস্তায় কোথাও গোড়ালি, আবার কোথাও হাঁটুপানির বেশি জমেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শহরবাসী। তাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত নালা ব্যবস্থাপনা না থাকা, বিদ্যমান নালার অচলাবস্থা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পৌরসভার অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। 

রাতভর বৃষ্টিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে একটি কালভার্ট ভেঙে পড়েছে। শনিবার (১ নভেম্বর) ভোরে বিনোদপুর ইউনিয়নের নলবনা খালের ওপর নির্মিত কালভার্ট ভেঙে পড়ার এ ঘটনা ঘটে। এতে চলাচল বিঘ্ন ঘটছে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।

যাতায়াতের জন্য খালটির ওপর ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩০ টাকা ব্যয়ে লছমনপুর কালভার্টটি নির্মাণ করে শিবগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস। কালভার্টটির ওপর দিয়ে উপজেলার শ্যামপুর, বিনোদপুর ও শাহাবাজপুর ইউনিয়নবাসী যাতায়াত করেন। তবে হঠাৎই সেটি ভেঙে পড়ায় ভোগান্তিতে হাজারো মানুষ।

train5-20251101130732

অন্যদিকে শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাতভর বৃষ্টির কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকাসহ রেললাইনে পানি জমে থাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আন্তঃনগর বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট বিলম্বে ছেড়ে যায়। 

শনিবার (১ নভেম্বর) সিডিউল অনুযায়ী ট্রেনটি সকাল ৬টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও, রেললাইনে পানি জমে থাকার কারণে এটি সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশন ছেড়ে যায়। এতে যাত্রীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে।

এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর শনিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ১২০ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে আরও একটি লঘুচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি ঢাকাসহ পাঁচ বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলেও জানিয়েছে সরকারি সংস্থাটি।

এএইচ