রাফিউজ্জামান রাফি
১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৫ পিএম
দেখতে ছবির মতো সুন্দর। তার অভিনীত চরিত্রগুলোও দর্শকের মস্তিষ্কে স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধানো ছবি হয়ে থাকে। বলছিলাম জনপ্রিয় অভিনেত্রী ফারজানা ছবির কথা। ক্যামেরার সামনে দক্ষতার সবকটা পাপড়ি মেলে ধরেন। বিভিন্ন চরিত্রে ছড়ান অভিনয়ের মুগ্ধতা। ঢাকা মেইলের কাছে ফারজানা ছবি খুলেছিলেন মনের আগল।
বেতারে সংবাদ পাঠ কেমন লাগছে?
আমি বরাবরই কণ্ঠাভিনয়, উপস্থাপনা ভালোবাসি। নতুন করে যোগ হলো সংবাদ পাঠ। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিজের পারফর্মেন্স ভালোভাবে উপভোগ করি। আমার কাছে মনে হয় শুদ্ধ উচ্চারণ ও কণ্ঠস্বরের চর্চার জন্য বেতার দারুণ এক মাধ্যম। যারা অভিনয়শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন, করতে চাচ্ছেন কিংবা পর্দার বাইরে বাচিকশিল্পী হিসেবে কাজ করছেন তারা বেতারে নিয়মিত কাজ করলে এই অভিজ্ঞতা কর্মক্ষেত্রে সহায়তা করবে। ছোটবেলা থেকেই বেতারে আবৃত্তি করতাম। পরে একইসঙ্গে অভিনয়, উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠক ও ঘোষক হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। যেহেতু দৃশ্যমাধ্যমে নিয়মিত কাজ করছি সেকারণে যখন-ই সম্ভব হয় বেতারে কাজ করি।
বইমেলা দরজায় টোকা দিচ্ছে। নতুন কোনো বই আসছে?
আমার প্রথম উপন্যাস ‘জলছবি’ ২০২৪-এর অমর একুশে বইমেলায় আসে। পাঠক এত দারুণভাবে গ্রহণ করলেন! শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা দিলেন যে বইমেলা শেষের দিন ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। বইয়ের মাঠ, মেলার মাঠ— সবকিছু ছেড়ে আসার সময় বারবার ভাবছিলাম যে আসছে বছর যেন সুস্থ থাকি, যেন সমানভাবে মেলায় সময় দিতে পারি। এবারও বইমেলায় আমার নতুন বই আসছে। এরইমধ্যে লেখার কাজ শুরু করেছি। কিছুদিন পর সবাইকে জানাব।
অভিনয়ে লম্বা ক্যারিয়ার আপনার। এই সময়ে এসে কী মনে হয়? প্রাপ্তির ঝুলি কতটা পূর্ণ হলো, কতটা অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে?
আমি একজন অভিনয়কর্মী। শিল্পী হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ভ্রমণ করছি। এই ভ্রমণ কবে, কোথায় শেষ হবে কিংবা যখন পৃথিবীতে থাকব না আদৌ কি কাজগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে কি না সেটা জানি না। তবে শিল্পী হওয়া খুব কঠিন বিষয়। একজন মানুষ প্রথমে মানুষ থেকে উন্নত হলে মন মনন চিন্তা চেতনা উন্নত করলে অভিনেতা হতে পারেন আর অভিনেতা হিসেবে অনেক দূর জার্নি করার পর শিল্পী হতে পারেন। আমার সেই জার্নি এখনও চলমান। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব কখনও করি না। তবে মনে হয় আমি অনেক ডাইমেনশনাল ক্যারেক্টারে অভিনয় করতে পেরেছি। মাল্টি ডাইমেনশনাল ওয়েতে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছি দর্শকের কাছে। এটা আমার দারুণ এক প্রাপ্তি। আমার মনে হয় কোনো অভিনয়শিল্পী পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। এক জীবনে অভিনয়ের ক্ষুধা থেকেই যায়। যেদিন এই ক্ষুধাটা আর থাকবে না সম্ভবত সেদিন থেকে দর্শককে আর নতুন কিছু দেওয়া সম্ভব হবে না। তাই আমি চাই আমার এই অপূর্ণতা থাকুক। প্রতিমুহূর্তে একটু একটু করে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়া জারি থাকুক।
আপনি বোধহয় অন্যদের মতো বেশি কাজ করেন না। কেন?
চাই না যে তা নয়। অনেক বেশি কাজ করতে চাই। তবে আমার উপযোগী চরিত্রে। যে ধরনের চরিত্রে আগে কাজ করেনি সে ধরনের চরিত্রে নিজেকে বিকশিত করতে চাই। আমার মাঝে যে মানুষগুলোকে আগে দেখিনি সেই মানুষগুলোকে আবিষ্কার করতে চাই। একই ধরনের গতানুগতিক চরিত্রে অভিনয় করে আনন্দ খুঁজে পাই না। তাই সেসব থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। সেজন্যই হয়তো আপনাদের কখনও কখনও মনে হয় কাজ কম করি। আসলে তা না। প্রত্যেক মুহূর্তেই নিজেকে কোনো না কোনো সৃজনশীল কাজের সঙ্গে জড়িত রাখি। যখন অনেকদিন কোনো ভালো চরিত্র আমার কাছে আসে না তখন গান, নাচের চর্চা, আবৃত্তি করি। আবার যখন কোনো দারুণ চরিত্র আসে তখন লুফে নেই এবং তাতে ডুবে যাই। যখন কোনো চরিত্রকে নিজের মধ্যে নিই এবং তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারি তখন আপনারা আমার প্রশংসা করেন। আমার পরিচালক, চিত্রনাট্যকার প্রত্যেকে। এই প্রশংসার প্রতি আমার লোভ আছে। সে কারণে কোনো ভালো চরিত্র এলে তাতে ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং দীর্ঘদিন কোনো ভালো চরিত্র না এলে অপেক্ষা করি। তাই যখন আমাকে অভিনয়ের কম দেখেন এটা ভাববার অবকাশ নেই যে আমি কাজ করছি না।
আপনাকে দর্শক নতুনভাবে আবিষ্কার করেন ওটিটি মাধ্যমে। অনেকটা সময় বোধহয় সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। কেন?
ওটিটিতে যে ধারায় কাজ হচ্ছিল সেই গতিটা আমার মনে হয় এখন একটু ধীর। ২০২৩, ২০২৪ এর শুরুর দিকে আমরা যেমন অগ্রজ অভিনয়শিল্পীদের সেখানে পেয়েছি তেমনই অনেক নতুন অভিনয়শিল্পীরাও তাদের প্রতিভা দেখিয়েছেন। এই মুহূর্তে তাতে একটু ছন্দপতন ঘটেছে। সম্ভবত সে কারণে আমাদের কম দেখছেন। আবার ভালো কাজ হলে নতুন কোনো ভালো চরিত্রে আমাদের প্রয়োজন হলে নিশ্চয় নির্মাতারা আমাদের ভাববেন। সেই প্রত্যাশা করছি। তবে এ কথা সত্যি যে একজন অভিনয়শিল্পীর প্রতিভা সুষ্ঠু ও সুস্পষ্টভাবে দর্শকদের মাঝে তুলে ধরতে ভালো গল্প, নির্মাতা, পারিপার্শ্বিক সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ। গায়ের জোরে নিজেকে প্রমাণ করার জায়গা এটা না। সে কারণে ভালো চরিত্রের অপেক্ষায় আছি এবং ভালো কাজ, গল্প, নির্মাণশৈলী ও চরিত্র প্রতাশা করছি।
মুক্তামণির কী অবস্থা? সে কবে আসবে?
মুক্তমণি চরিত্রটি আমার ক্যারিয়ার একটি মাইলফলক। এটি করার পর দেশ-বিদেশ যেখানে গেছি দর্শক আমাকে এই নামে ডেকেছেন। এত চ্যানেল, ওটিটি মাধ্যম, সিনেমা, সবার হাতে ফোন— সবকিছুর ভিড়ে একটি চরিত্র দর্শকের মনে জায়গা করে নেওয়া অবশ্যই বড় প্রাপ্তির বিষয়। এমনও হয়েছে দেশের বাইরে গেছি; রাস্তার অপর প্রান্ত থেকে দর্শক মুক্তামণি বলে জোরে জোরে ডেকেছেন। এটা যে একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য কতটা প্রাপ্তির বোঝানোর মতো না। আমিও খুব উপভোগ করেছি। পরিচালক কায়সার আহমেদ এবং চিত্রনাট্যকার শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। তাদের সহযোগিতায় প্রাণবন্তভাবে মুক্তামণি চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলতে পেরেছি। চরিত্রটি একটু একটু করে প্রাণের সঞ্চার করেছি। দর্শকের মস্তিষ্কে গেঁথে থাকুক আজীবন। এটাই চাওয়া। চরিত্রটি আরও প্রলম্বিত করলে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এখনও বুঝতে পারছি না। ‘বকুলপুর সিজন ৩’-এর প্রস্তুতি চলছে। চরিত্রটি নতুন কোনো ডাইমেনশনে এলে দর্শক আবার মুক্তামণিকে দেখতে পাবেন। অপেক্ষা করছি নতুন আঙ্গিকে চরিত্রটি দর্শকের সামনে নিয়ে আসার।
প্রত্যেক অভিনয়শিল্পী-ই চান এমন কিছু কাজ করতে যা তাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখবে দর্শকের মাঝে। আপনি কি এরকম চরিত্র পেয়েছেন?
তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে, কার বা এমন সাধ্য আছে এই মায়াজাল ছিড়ে যেতে পারে— অভিনয় নিয়ে কথা বলতে গেলে গানটি মনে পড়ে। আমার অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠা, পথচলা— সবকিছুর ক্ষেত্রে মনে হয় এই কাজের মাঝে কী অদ্ভুত এক মায়া! একজন অভিনয়শিল্পী পারে এক জীবনে হাজার জীবন ভ্রমণ করতে। এটা কিন্তু আর কোনো পেশায় সম্ভব না। অভিনয় যে শুধুমাত্র পেশা তা কিন্তু নয়। এটি নেশা। মজ্জাগত হয়ে আছে মন, মস্তিষ্কে, স্নায়ুতে আয়ুতে। কখনও কখনও মনে হয় রক্ত সঞ্চালনের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে আছে। নিজেকে প্রতিনিয়ত নানান চরিত্রে দেখতে ইচ্ছে করে। আমাকে অনেকে বলেন, আপনি তো অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে এই চরিত্র কটি কি সব? পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তত ধরনের চরিত্র আছে। এক জীবনে অনেক কিছু করে যাওয়া তো সম্ভব না। কিছু চরিত্র বিশ্বাসযোগ্যতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করে দর্শকের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। এমন কিছু চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি। আগামীতেও অপেক্ষায় আছি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে নিজেকে বিশ্লেষণ করার।
পর্দায় বিভিন্ন চরিত্রে পাওয়া যায় আপনাকে। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ধারণ ব্যক্তিজীবনে কোনো প্রভাব ফেলে?
প্রত্যেক মানুষ সেই কাজটি পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী যে কাজ তাকে তৃপ্তি দেবে। অভিনয় আমাকে সেটা দিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে যে ভাঙাগড়ার খেলা। সেই খেলা আমি খুব উপভোগ করি এবং কখনও ভিন্নমাত্রার চরিত্রগুলো উদযাপন করি। এই ভাঙাগড়ার খেলা ও উদযাপন আমাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। সে কারণেই অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং অভিনয় ছাড়া অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার কথা কল্পনাও করিনি। আমি মনে করি আমার অভিনেত্রী সত্ত্বা আমার ব্যক্তি সত্ত্বাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং এটি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। অভিনয়ের মাধ্যমে আমি এমন সব জীবনে ঢোকার অভিজ্ঞতা অর্জন করছি যেটা অন্য কোনো পেশায় থাকলে সম্ভব হতো না। ওই মানুষগুলোর কাছে যেতে পারতাম না। তাদের জীবন পথ চিন্তা চেতনা অভিনেত্রী হওয়ার কারণেই চিনতে পেরেছি। সে কারণে বরাবরই বলি ফারজানা ছবির অভিনয়সত্ত্বার কাছে তার ব্যক্তিসত্ত্বা কৃতজ্ঞ।
সিনেমার কাজ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম।
আমার শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’। এরপর ‘মা’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করেছি। সবশেষ যে ছবিটি করলাম সেটি অরণ্য আনোয়ারের লেখা ও পরিচালিত ‘হাওর’।
নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আমি একজন পরিশ্রমী অভিনয়শিল্পী। কোনো দৈবভাবে পাওয়া এক্সট্রা অর্ডিনারি মেধার অধিকারী না। কোনো একটি চরিত্রে কাজ করতে গেলে সেটা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা করি।
বর্তমান ব্যস্ততা…
নতুন দুটি ধারাবাহিক নাটকের কাজ শুরু করেছি। বাস্তবভিত্তিক গল্পের কাজ। একটির পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুল। এটি ‘মিলন হবে কত দিনে’। আরেকটি সকল আহমেদের ‘বিশ্বাস বনাম সরকার’। দুটিতে আমাকে দুটি ভিন্ন ধরনের চরিত্র দর্শক দেখতে পাবেন।
আরআর