ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন
জানুয়ারিজুড়ে একদিনও স্বাস্থ্যকর বায়ু পায়নি ঢাকার মানুষ

সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বা খারাপ বাতাসের শহরের তালিকায় ফের শীর্ষে নাম এসেছে রাজধানী ঢাকার। এমন পরিস্থিতিতে বায়ু দূষণ রোধে বিশেষ অভিযানে নেমেছে সরকার। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে করা হচ্ছে জরিমানা। এমনকি বিষয়টি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি স্ব-প্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপের অগ্রগতিও নজরে রাখছেন হাইকোর্ট।
সাধারণত বায়ুমানের ক্ষেত্রে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক তথা একিউআইয়ের মান ৫০ এ থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর বায়ু বলা হয়। এই মাত্রা ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত থাকলে তা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে ধরা হয় যদিও ব্যক্তিবিশেষে এই মাত্রাও ক্ষতির কারণ হতে পারে। পাশাপাশি ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত মাত্রাকে ‘অরেঞ্জ লেভেল’ ধরা হয়, যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা ক্ষতিকর না হলেও কারও কারও স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এছাড়া ১৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত মাত্রাকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে ধরা হয়। আর একিউআইয়ের মান ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত পৌঁছালে তাকে চরম অস্বাস্থ্যকর হিসেবে ধরা হয়। সেই সঙ্গে ৩০০ এর অধিক মাত্রাকে ‘বিপর্যয়কর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সুইজারল্যান্ডের বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষক সংস্থা- একিউএয়ারের সর্বশেষ তথ্যমতে, সদ্য শেষ হওয়া জানুয়ারিতে একদিনও স্বাস্থ্যকর বায়ু পায়নি ঢাকার মানুষ। এরমধ্যে জানুয়ারির শুরুতে একিউআইয়ের মাত্রা ছিল দেড়শ’র ঘরে। যেখানে ৫ জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমান ছিল ১৫৭ তে। তবে এরপর ধীরে ধীরে ১৮ থেকে ২৩ জানুয়ারির মধ্যে একিউএয়ারের মাত্রা পৌঁছায় ২০০ এর কাছাকাছি।
একিউএয়ারের তথ্য বলছে, পরো জানুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ু একদিনের জন্যও অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে নামেনি। উল্টো বেশ কয়েকদিনই ঢাকার বায়ুমান ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। সেই সঙ্গে এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বিষাক্ত প্লাস্টিকের কণা। এরমধ্যে ২২ জানুয়ারি একিউআইয়ের মাত্রা সর্বোচ্চ ২৭৯ তে পৌঁছায়। এরপর ২৪ জানুয়ারি বৃষ্টি শুরু হলে ঢাকার একিউআইও কিছুটা কমে আসে। তবে পরে ফের এই বায়ুমান ১৭০ এর ওপরে চলে যায়। এই হিসেবে পুরো জানুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ুর মান কোনোদিনই ১৫০ এর নিচে নামেনি। অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর বায়ু পায়নি রাজধানীর বাসিন্দারা।
এ নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং বায়ুমান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘মূলত তিনটি কারণে জানুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ুমান খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। প্রথমত, গত ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের উদ্বোধনের কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। ফলে গত ৭ বছরের মধ্যে ডিসেম্বরে বায়ু মান সবচেয়ে ভালো ছিল। খোঁড়াখুঁড়ির কাজও ওই সময় বন্ধ ছিল। তবে জানুয়ারির শুরুতে এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে ১০০টি জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে।’
ঢাকায় মাত্রাতিরিক্ত বায়ু দূষণের দ্বিতীয়ত কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে বায়ু দূষণ বাড়ে। ডিসেম্বরে উল্টো গরম পড়েছে। আর জানুয়ারির শুরু থেকে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এতে প্রতিবেশী দেশ থেকে দূষিত বাতাস এসেছে। পাশাপাশি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটাও নেওয়া হয়নি।
এছাড়া তৃতীয়ত কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জানুয়ারিতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ১২ কিলোমিটারের মতো। ফলে দূষিত বায়ু নিম্নস্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ কারণে নগরবাসীকে পুরো মাসজুড়েই দূষিত বায়ু গ্রহণ করতে হয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। সে সময় বায়ুমান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বায়ুমান সূচক (একিউআই) বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানানো হয়।
ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, সাধারণত শীতের মৌসুমে গড় বায়ুমান সূচক বাড়তে দেখা যায়। জুন ও জুলাইয়ে বায়ু দূষণ কমে আসে। শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক ঋতু হওয়ায় এই সময়ে ধুলাবালির পরিমাণও বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ইটের ভাটা ও সিমেন্ট কারখানা থেকে উৎপন্ন ধুলার মিশ্রণ ঘটলে বায়ু দূষণ বাড়ে। এতে শীতে আর্দ্রতা কম থাকায় এই সময়ে বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলোর উপস্থিতিও বেড়ে যায়।
এদিকে, ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বায়ু পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুসারে, ২৬ জানুয়ারি সব রেকর্ড ভেঙে বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছায় ঢাকার বায়ুমান। বায়ুদূষণ পরিমাপক সংস্থা এইকিউএয়ারের দূষণ সূচক ৩০০ ছাড়ালেই যেখানে পরিস্থিতিকে বিপর্যয়কর ধরা হয়, সেখানে এই দিনে ঢাকার বায়ুতে একিউআই সূচক গিয়ে পৌঁছায় ৪৫৬ তে।
অন্যদিকে, ঢাকার দূষণ নিয়ে ফলাও করে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর বায়ু দূষণ রোধে বিশেষ অভিযানে নেমেছে সরকার। চলতি ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই এই অভিযান শুরু হয়। যার ধারাবাহিকতায় প্রথম দিনেই দূষণের দায়ে মোট ২৬টি যানবাহন ছাড়াও ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে ভয়াবহ দূষণ রোধে এই ‘অ্যাকশন’ আরও জোরদারের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
/আইএইচ