বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শরৎকালে বর্ষার রূপ!

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০২:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

শরৎকালে বর্ষার রূপ!

কখনো টানা আবার কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আকাশে কালো মেঘ জমে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে যখন তখন। বৃষ্টি বিড়ম্বনায় ভোগান্তি বাড়ছে যাতায়াতে। বর্ষার রূপ পুরোটাই যেন ঢেলে দিচ্ছে প্রকৃতি। কিন্তু এখন যে শরৎকাল! 

আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষা ঋতু বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। প্রকৃতিতে এখন ঋতুর রাণী শরৎকাল চলছে। জলবায়ু পরবির্তনে ঋতুর গতিপ্রকৃতিও যেন বদলে গেছে। বর্ষার রূপ মেলছে শরতে এসে।


বিজ্ঞাপন


আবহাওয়াবিদদের মতে— জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে। তারই প্রভাব পড়ছে আবহাওয়ায়। যে কারণে বাংলাদেশের ঋতুচক্রে পরিবর্তন আসছে। 

সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাট পানিতে একাংশ ডুবে গেছে। এর আগে গত দুইদিনও বৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর মতো দেশের অনেক অংশেই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে রাজধানীতে কর্মজীবীরা পড়ছেন বিড়ম্বনায়। গণপরিবহনের সংখ্যা কম যায় আবার যানজটও দেখা দেয়। রাতেও বৃষ্টি হচ্ছে। তবে সেই বৃষ্টিতে রাজধানীবাসী ঘুমিয়ে থাকায় তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্তু দিনের বৃষ্টিতে কর্মজীবীদের পাশাপাশি অন্যান্য মানুষের সমস্যাও দেখা যায়।

বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকালে ফার্মগেট, কলাবাগান, পান্থপথ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার এলাকায় দেখা যায় বৃষ্টিতে মানুষ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে অপেক্ষা করছে গাড়ির জন্য। কোনো কোনো গাড়িতে ভিজেই দৌড়ে উঠতে দেখা যায়।

RR1


বিজ্ঞাপন


খামাড়বাড়ি থেকে বৃষ্টিতে অপেক্ষারত সানোয়ার হোসেন বলেন, ক’দিন ধরে যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে অফিসে যেতেই ভিজে যাই ফেরার সময়ইও বৃষ্টিতে ভিজি। পাশে থাকা সহকর্মী ওয়াদুদ খান বলেন, এটা কি চলছে বুঝি না। শরৎকালে এমন বৃষ্টি আমার বয়সে দেখিনি। অথচ বৃষ্টি যখন হওয়ার কথা তখন বৃষ্টি দেখলাম না। উপস্থিত অন্যরাও বৃষ্টির মধ্যে যোগ দেয় আলোচনায়।

আবহাওয়া অধিদফতর থেকে জানানো হয়, আজ ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া ও বিজলি চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। বৃষ্টির প্রভাব থাকলেও সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। 

আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিজ্ঞানীদের সংগঠন ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক বলছে, জলবায়ুর পরিবর্তন ছাড়া আবহাওয়ার এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। ইউএস ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সসের বিশেষজ্ঞ পিটার গ্লেইকের ভাষ্যে, এই অতি বৃষ্টির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের যোগসূত্র রয়েছে কোথাও না কোথাও। তিনি আরও বলেছেন, যখন খরা বেড়ে চলে, যেমন সাইবেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমে, তখন বৃষ্টি হয় অন্য কোনো অঞ্চলে, সেখানে ভয়ানক বন্যাও ডেকে আনে। পৃথিবীজুড়ে আবহাওয়ার রূপ ভিন্ন হবেই। কিন্তু এই ভিন্নতাকে বাড়িয়ে চরমভাবাপন্ন করে তুলছে জলবায়ুর পরিবর্তন।

এবার বর্ষাকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়নি। আবহায়াবিদরা মনে করছেন— এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এবছর বর্ষার পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে দেশের কৃষিখাতেও পরিবর্তন দেখা যায়। বৃষ্টি নির্ভর আমন চাষাবাদ অনেকস্থানেই সেচে হয়েছে। আবার অনেকস্থানেই বৃষ্টি না হওয়ায় দেরিতে আমন করতে হচ্ছে।

ভাদ্র ও আশ্বিন মাস মিলে শরৎকাল। যা বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়েই হাজির হয়। আকাশে উড়ে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। প্রকৃতিতে নতুন হাওয়া লাগে। প্রকৃতির এই নতুন সাজ বাংলার মানুষের কাছে খুব চেনা। শত বছরের পরিচিত দৃশ্য। এ সময় নাকে ভেসে আসে শিউলি ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণ আর নদীর বালুচরে রাশি রাশি সাদা কাশফুল। বর্ষার জল নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাশফুল জেগে ওঠে।  প্রকৃতি জানান দেয় সাদা মেঘের ভেলায় চেপে শুভ্র কাশফুলের আঁচল উড়িয়ে, শেফালি ফুলের মালা মতিহার বানিয়ে গলায় পরে শরতের আগমন ঘটেছে। সেই সঙ্গে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের শীষে আলতো করে মাথা দুলিয়ে শরতকে আমন্ত্রণ জানায়। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক।

এবারও শরৎ এসেছে, প্রকৃতিও সেজেছে, ফুটেছে কাশফুলও। তবে সাদা মেঘের ভেলা আগের মতো ভেসে বেড়াতে পারছে না। বর্ষারমতো কালো মেঘ হয়েই থাকছে আকাশ। যখন তখন বৃষ্টিতে ফোটা কাশফুল চুপসে যাচ্ছে। ভ্রমণপিপসুরা কাশফুলের দেখতে গিয়ে কাকভেজা হয়ে ফিরছে আর বলছে এটি কি বর্ষাকাল কিনা? এই শরতে কখনো দুপুরের কড়ারোদ আবার ভ্যাপসা গরম হাঁসফাঁস নামাচ্ছে জনজীবনে।

মূলত জলবায়ু আর আবহাওয়ার যে বৈরীতা তা রূপবতী শরৎকে করে তুলছে রূপহীন। তাই শরৎ নিয়ে হতাশাও ঘিরে ধরছে প্রকৃতিপ্রেমীদের।

গবেষক ও উন্নয়নকর্মী ড. মতিউর রহমান উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। এ জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ইতোমধ্যেই আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে অকাল বন্যা হতে দেখেছি, যাতে হাওড়াঞ্চলের ফসল, বিশেষ করে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অস্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে এ বছর কলেরার প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গিসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এ মুহূর্তে মানুষ এবং অন্য সব জীবের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আরও বিধ্বংসী প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

RR22

পূর্ব ঘোষিত পরিকল্পনামাফিক কাশফুল দেখতে যাওয়ার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর। পরে যোগাযোগ করে জানা গেলো বৃষ্টিতে সেই পরিকল্পনা তারা বাতিল করেছে। এর আগেও গত শুক্রবার কেরানীগঞ্জে কাশফুল দেখতে গিয়ে হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে ফিরেছিল শাওন ও তার বন্ধুরা। কাশফুলের সঙ্গে বৃষ্টিভেজা ছবি দিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় লিখেন ‘শরৎকালে কাশফুল দেখতে এসে বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু।’ নগরির অনেকেই শখের বশে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে বের হলে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন। তখন মনে হচ্ছে এটি বর্ষা চলছে নাকি। সরকার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বেকারত্ব-দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা হ্রাস, সামাজিক অবক্ষয়, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনকি জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করছে বলে মনে করেছেন পরিবেশবিদরা। (১৩ সেপ্টেম্বর) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন। 

সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান শামসুদ্দোহা বলেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা না থাকা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পর্যন্ত উন্নয়ন না পৌঁছায় এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও বেশি ভোগান্তি সৃষ্টি করছে। এই পরিবর্তনের কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ও জীবিকার পরিবর্তন আসছে। দুর্যোগে অধিকমাত্রায় বেশি বঞ্চনার শিকার হন নারীরা। 

সংশ্লিষ্টদের মতে— শুধু শরৎই পাল্টে যাচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে এর যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সবখানে।

ডব্লিউএইচ/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর