প্রতিবছর ইংরেজি নববর্ষের রাতে ঢাকা মহানগর সিটিতে বায়ু ও শব্দ দূষণ বৃদ্ধি পায়। গত বছর নববর্ষের শুরুতে রাত ১১ থেকে ১২টা পর্যন্ত মাত্র ১ ঘণ্টায় বায়ু দূষণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ এবং শব্দদূষণ বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪২ শতাংশ। তাই নববর্ষ উদযাপনে ‘আতশবাজি-ফানুস’ পোড়ানো বন্ধের সুপারিশ জানিয়েছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ক্যাপস আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশ করা হয়। ‘নববর্ষ উদযাপনের সময় আতশবাজি পোড়ানোর কারণে বায়ু ও শব্দ দূষণের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ এবং আতশবাজি ও ফানুস মুক্ত নববর্ষ উদযাপনের দাবি’তে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত গত ৭ বছরে নববর্ষ উদযাপনের কারনে বায়ুদূষণ বেড়েছে ১৯ শতাংশ। এই ৭ বছরে সর্বোচ্চ দূষণ হয়েছে ২০১৭-১৮ সালে দূষণ বেড়েছে ৬৬ শতাংশ, সর্বনিম্ন দূষণ ছিল ২০২২-২৩ সালে ৬ শতাংশ।
গত ৭ বছর ইংরেজি নববর্ষের রাতগুলোতে নববর্ষ উদযাপনকালীন বায়ু ও শব্দ দূষণের তীব্রতা পর্যবেক্ষণ করে বৈজ্ঞানিক গবেষণার এই ফলাফল তুলে আনে ক্যাপস।
তিনি জানান, ২০১৮-১৯ সালে নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আতশবাজি ফুটানো ও ফানুস উড়ানোর কারণে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৩ শতাংশ। এই বছরে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার আগে পর্যন্ত বায়ুমান সূচক ছিল ১৯৫। ১২টার ১ জানুয়ারি বায়ুমান সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ২৪০। একই ভাবে ২০১৯-২০ সালে দূষণ বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, ২০২০-২২ সালে দূষণ বেড়েছে ৭ শতাংশ। তবে করোনা সময় ২০২১-২২ সালেব ২৪ শতাংশ দূষণ কমে। সে সময় ২০২১ সালে রাত ১২টার আগে বাতাসে বায়ুর মান ছিল ২২৭, রাত ১২টার বায়ুর মান দেখা গেছে ১৭২।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, গত ৭ বছরে ৩১ ডিসেম্বরে বায়ুমান সূচক ছিল গড়ে ২২০, রাত ১২টার পর ১ জানুয়ারি তে বায়ু মান সূচক হয় গড়ে ২৫৯।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)- এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ২০২৪ সালের নববর্ষে রাত ১১ থেকে ১২টার তুলনায় পরবর্তী ১ ঘণ্টার বায়ু দূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ (বস্তুকণা) রেকর্ড হয় ২৪৯ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার যা বায়ুমান সূচকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসাবে বিবেচিত। আতশবাজি, পটকা বা এ-জাতীয় শব্দ সৃষ্টিকারী বস্তু সাধারনত পটাসিয়াম পারক্লোরেট, বিষাক্ত বেরিয়াম নাইট্রেট, পার্লাইট পাউডার, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম খাদ ও মাটি-পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরী হয়। এগুলো পোড়ানোর ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বায়ু দূষণকারী পদার্থ নির্গত করে, যার মধ্যে রয়েছে বস্তুকণার ও বস্তুকণা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, এবং কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। এই দূষকগুলো হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস এবং ফুসফুসের ক্যান্সার সহ বিভিন্ন ধরনের শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।
ক্যাপসের গবেষণা দলের মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখতে পায় যে, রাত সাড়ে ১১ থেকে শুরু করে ভোর ৫টা পর্যন্ত আতশবাজি ও পটকা ফুটানো হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ হয়েছে রাত ১২ থেকে সাড়ে ১২ পর্যন্ত। ২০২৪ সালের শুরুর প্রথম ঘণ্টায় শব্দ দূষণহার তার আগের দিনের (৩০ ডিসেম্বর) তুলনায় প্রায় ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং বেশিরভাগ সময় শব্দের মাত্রা ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবলের মধ্যে ছিল। ৮০ ডেসিবলের অধিক শব্দ মানুষসহ পশু-পাখির কানের বধিরতা সৃষ্টি করতে সক্ষম এমনকি এই শব্দ গর্ভপাত, শিশুমৃত্যু ও বয়স্কদের হার্টের ঝুঁকিও বাড়ায়। নববর্ষের উদযাপনের এই প্রচণ্ড শব্দে পাখিরা উড়া-উড়ি করে এবং গাছে বা বিল্ডিংয়ের দেয়ালে আঘাত পেয়ে নিচে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে এমনকি মারাও গিয়েছে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, নববর্ষ উদযাপনের সময় বায়ু এবং শব্দ দূষণের ফলে মানুষের জীবন ও পরিবেশের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। বায়ুদূষক উচ্চ মাত্রা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ৮০-৯০ ডেসিবলের শব্দ দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আতশবাজি এবং পটকার কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়ে উড়ে যায়। প্রায়ই গাছে বা ভবনের সাথে ধাক্কা খেয়ে তারা আহত হয় বা মারা যায়। ২০২৪ সালের নববর্ষে হাজারো পাখি আহত হয়েছিল। দূষণ সৃষ্টিকারী আতশবাজি ও ফানুসের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এবং অন্যান্য পরিবেশ সুরক্ষা আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আহমেদ কামরুজ্জামান বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২৪ এই সময়ের মধ্যে বায়ুমান সূচক কখনোই ভালো অবস্থানে ছিল না। বায়ুমান সূচক ৫০ এর নিচে থাকলে ভালো বায়ু বলা হয়, সেক্ষেত্রে গত ৭ বছরে নির্দিষ্ট দুই দিনে (৩১শে ডিসেম্বর এবং ১ জানুয়ারি) কখনোই বায়ুমান সূচক ৫০ এর নিচে ছিল না।
সর্বশেষ দুই বছরের পরিস্থিতি জানিয়ে তিনি বলেন, ২০২৩ সালের নববর্ষে রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী ১ ঘণ্টার বায়ু দূষণের পরিমাণ প্রায় ৯১ মাইক্রোগ্রাম (৩৬ শতাংশ) বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ২০২৪ সালের নববর্ষে রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী ১ ঘণ্টার বায়ু দূষণের পরিমাণ প্রায় ৬৪ মাইক্রোগ্রাম (৩৫ শতাংশ) বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ গত ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের প্রথম ঘণ্টায় বায়ু দূষণহার ও দূষকের ঘনত্বের পরিমাণ কিছুটা কম ছিল।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের সম্মেলন কক্ষে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে নিয়মিত টহল ও তল্লাশি চৌকি বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশি তৎপরতাও বাড়ানো হবে জানিয়েছে ডিএমপি কমিশনার।
তিনি আরও জানান, উন্মুক্ত বা খোলা কোনো স্থানে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শহিদুল ইসলাম, অরণ্যক ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক রকিবুল হাসান মুকুল, বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক আশিকুর রহমান সমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ডক্টর মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাশেদুজ্জামান মজুমদার প্রমওখ।
এ সময় মূল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী ওয়াজিহা জামান।
এমআইকে/এএস