- এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থায়নে নেই সুস্পষ্ট ঘোষণা
- প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড়ের তাগিদ
- জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ
দেখতে দেখতে জলবায়ু সম্মেলন শেষ সপ্তাহে গড়িয়েছে। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে হওয়া এবারের কপ-২৯ চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন জলবায়ুসংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে সভা-সেমিনার, নানা পর্যায়ে বৈঠক করছেন দুই শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে দাবি দাওয়া পেশ করছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু এখনো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অর্থায়নের সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি কপ থেকে। এখনো ক্ষতিগ্রস্ত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত বিশ্বের সঙ্গে দরকষাকষি করে যাচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে কত অর্থ পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়ার কোনো ইতিবাচক লক্ষণ এখনো নেই। উল্টো বৈশ্বিক উজ্ঞতার জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি কারবারিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরো কপ। কারণ এবারে কবে অংশ নেওয়ার অনুমতি পেয়েছেন এক হাজার ৭৭৩ জন জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট।
অবশ্য কপ-২৯ এর প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা, অর্থায়ন, অভিযোজন তহবিল, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল ও বিশ্বব্যাংক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে সম্মেলনে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, উন্নত দেশগুলোর স্বদিচ্ছার অভাবে ঋণের জালে আটকা পড়ছে জলবায়ু প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। তিনি উন্নত দেশগুলোর কাছে এই সংকট মোকাবেলায় অনুদান চান।
সোমবার (১৮ নভেম্বর) জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্যাভিলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ অ্যাসেসমেন্ট নিয়ে ইভেন্ট করে বাংলাদেশ। যেখানে তুলে ধরা হয় ২০২৪ সালে বন্যার আর দুর্যোগের পরিস্থিতি।
বিজ্ঞাপন
জানানো হয়, এ বছরের কয়েকরটি বন্যায় বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে হয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, ক্ষয়ক্ষতির অর্থ আদায় করতে একটি আন্তজাতিক মানের পরিকল্পনা তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশের এই চিত্রটি যেন বিশ্ব গ্রহণ করে তা নিয়ে কাজ চলছে।। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এখন আর প্রমাণের কিছু নেই। টেবিলের আলোচনা বাদ দিয়ে টাকা ছাড়ে একমত হতে হবে বিশ্ব নেতাদের।
অন্যদিকে প্যারিস ঝলবায়ু চুক্তির আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেটি পূরণ হয়নি। উপরন্তু এই বছর স্বল্পোন্নত দেশগুলো জলবায়ু ক্ষতি মোকাবিলায় বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার দাবি করেছে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনসিটিএডি) মহাসচিব রেবেকা গ্র্যান্সপ্যান বলেছেন, আগামী বছর বরাদ্দ হওয়া উচিত ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, জরুরি প্রশ্ন এটা নয় যে, এই টাকা উন্নত বিশ্ব দেবে কি না। প্রশ্ন কত দ্রুত তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
সেই জরুরি পদক্ষেপ যে নেওয়া হচ্ছে না, সেই আক্ষেপ ঝরে পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চেম্বারের মহাসচিব জন ডব্লিউ এইচ ডেনটনের কথায়। তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট বা গ্লোবাল মেল্টডাউনের মোকাবিলায় সবাই যেমন উদ্যোগী হয়েছিল, জলবায়ু সংকট মেটাতে তেমনই তৎপরতা সবার দেখানো উচিত।
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গতকাল কপ২৯ সম্মেলনে ‘প্রাক-২০৩০ উচ্চাভিলাষ বিষয়ক বার্ষিক উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ২০৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য পূরণে উন্নত দেশগুলোকে দ্রুত নির্গমন হ্রাসে উদ্যোগী হতে হবে এবং প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবায়ুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় মোকাবিলা করছে, তা তুলে ধরে তিনি সমন্বিত বৈশ্বিক উদ্যোগের ওপর জোর দেন।
তিনি উল্লেখ করেন, এই বছর দুটি ভয়াবহ বন্যা বাংলাদেশে ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি করেছে, যা জাতীয় বাজেটের ১.৮ শতাংশের সমান। গত ১৮ মাসে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ১৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটি। এর মধ্যে ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪ শতাংশ হলেও দেশটি চরম ক্ষতির শিকার।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, 'কপ২৯-এর শেষ দিনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সম্মেলনে কোনো কার্যকর চুক্তি না হয়, তবে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার সম্ভাবনা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সম্মেলনে লবিস্টদের সক্রিয় উপস্থিতি জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের প্রভাব ও ভবিষ্যত সুরক্ষার প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরিবর্তে তাকে শক্তিশালী করছে, যা বিশ্ব জলবায়ু সংকট সমাধানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে, নবায়নযোগ্য শক্তির উত্থান এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধিই একমাত্র জলবায়ু সংকট মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। তাই উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনুদান প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য করতে হবে। জলবায়ু সহায়তার ব্যর্থতা অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
তিনি বলেন, আশা করি, দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করবে। এই সম্মেলনের সাফল্য শুধু বর্তমান সংকট মোকাবিলাই নয়, ভবিষ্যতের জলবায়ু নীতির দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করবে।
বিইউ/জেবি